1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গে দায় স্বীকার করে না শাসক দল

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
১৪ অক্টোবর ২০২০

পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক খুন, সংঘর্ষ, বিস্ফোরণ, বোমাবাজি লেগেই আছে। ভোট এলেই বাড়ে। অথচ, তার দায় নেয় না কেউ। সরকারও নেয় না। তৃণমূলও নয়।

https://p.dw.com/p/3jv1x
ছবি: Prabhakar Mani Tewari/DW

পশ্চিমবঙ্গে ভোট এলেই রাজনৈতিক হত্যা হবে, মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়বে, সংঘর্ষ হবে, হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে বিরোধীদের জঙ্গি আন্দোলন হবে, তা রুখতে সরকারের নির্দেশে পুলিশ ভয়ঙ্করভাবে লাঠি চালাবে, গ্যাস, গুলিও চলতে পারে, এ সবই রাজ্যের মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। বিজেপি যবে থেকে রাজ্যে শক্তি সঞ্চয় করেছে, তবে থেকে ভোট এলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়বে, ছোট-খাট সংঘর্ষ হবে, এটাও প্রায় নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। ভোটের দিন এলে গোলমাল আরো বাড়বে, ভোটদাতাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা হবে, মারামারি হবে তাতেও লোকে খুব একটা অবাক হন না। একদা ভোটের আগে ও নির্বাচনের দিন গোলমালের জন্য কুখ্যাত ছিল বিহার ও উত্তর প্রদেশ। এই দুই রাজ্য এখন শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ  তাদের পিছনে ফেলে ক্রমশ আরো অশান্ত হচ্ছে। তাই ভোট আসার এক বছর আগে থেকেই গোনা শুরু হয়, এই মাসে কতজন মারা গেলেন সংঘর্ষে, দুই, পাঁচ, দশ, কুড়ি না কি আরো বেশি। ক'টা সংঘর্ষ হলো, সাত, নয়, বারো না কি আরো বেশি।

আমরা জানি একহাতে তালি বাজে না। তেমনই রাজনৈতিক হত্যা ও সংঘর্ষও একতরফা হয় না। ক্ষেত্রবিশেষে তাতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দুই তরফেরই ভূমিকা থাকে। কিন্তু গণতন্ত্রে সবসময় ক্ষমতায় যে দল আছে, যাঁরা সরকার চালাচ্ছেন, তাঁদের দায় ও দায়িত্ব বিরোধীদের থেকে অনেক বেশি থাকে। আশ্চর্যজনকভাবে এত হত্যা, সংঘর্ষ, ঝামেলা হয়ে যায়, কিন্তু ক্ষমতাসীন দল বা সরকার তার কোনো দায় স্বীকার করে না। বরং তা ধামাচাপা দেয়ার, দায় এড়ানোর চেষ্টা করে যায়। এতেও এখন আর মানুষ আশ্চর্য হন না। আর তারা যত এই কাজ করতে থাকে, ততই সেই অভিযোগগুলি তাদের গায়ে চেপে বসে এবং অনেকসময়ই বোঝা যায়, পুলিশ ও প্রশাসনের উপর তাদের রাশ সম্ভবত আলগা হয়ে গেছে।

সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। ব্যারাকপুরে মনীশ শুক্লার হত্যা। প্রায় থানার সামনে মনীশকে গুলি করে হত্যা করা হলো। বিজেপির একটি মিছিল চলে যাওয়ার পরেই মোটরবাইকে এসে মনীশকে মেরে চলে গেল হত্যাকারীরা। থানার সামনে জনবহুল এলাকায়, রজনৈতিক মিছিল যাওয়ার পর এই ভাবে একজন রাজনৈতিক নেতাকে মারা হলো, তার দায় সরকার নেবে না? না, নেয়নি। বরং তারপর দুইটি জিনিস দেখা গেছে। মনীশ-হত্যার পর বোমার গর্জনে বারবার কেঁপে উঠেছে ব্যারাকপুর। এমনকী থানার ছাদেও বোমা পড়েছে বলে অভিযোগ। ওই যে একহাতে তালি না বাজার ঘটনা। আর দ্বিতীয় ঘটনা হলো, মনীশ-হত্যা নিয়ে তৃণমূল ও বিজেপি নেতাদের আশ্চর্যজনক কথার লড়াই। তাঁদের যুক্তি দেখে চমকে যেতে হয়।

এই লড়াইয়ের একদিকে রাজ্যের মন্ত্রী ও তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম, অন্যদিকে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় স্তরের সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয় ও সাংসদ অর্জুন সিং। বিজেপি-র এই দুই নেতার দাবি, যে অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে তা পুলিশই ব্যবহার করে। ফিরহাদ বলেছেন, যে ধরনের অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে, তা রাজ্যে দুষ্কৃতীদের হাতে থাকে না। শুনেছি অর্জুন না কি শার্প শ্যুটার আনিয়েছিলেন। বিজেপি নেতারা বলছেন, পুলিশের মদতে তৃণমূল খুন করেছে। ফিরহাদ বলছেন, মনীশ আবার তৃণমূলে ফিরতে চেয়েছিল, তাই খুন করা হলো।

ঘটনা হলো, খুনটা হয়েছে। থানার সামনে হয়েছে। তারপর প্রচুর বোমাবাজি হয়েছে। অর্জুন সিং ও মনীশ দুজনেই আগে তৃণমূলে ছিলেন, পরে বিজেপিতে গেছেন। কলকাতার কাছে একটা জায়গায় এই কাণ্ড হয়ে গেল, সরকারের কোনো দায় নেই? আইন-শৃঙ্খলার দায় ও দায়িত্ব তো তাদের! দিন কয়েক পরে দুই জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এখন বলা হচ্ছে, গুন্ডাদের পুরনো ঝগড়ার জেরে খুন হয়েছে মনীশ।

গত কয়েক মাসে বেশ কিছু বিজেপি নেতার দেহ গাছ থেকে ঝুলতে দেখা গেছে।  জুলাই মাসে হেমতাবাদের বিজেপি বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়ের দেহ বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে গাছে ঝুলতে দেখা যায়। গোঘাট স্টেশনের কাছে বিজেপি নেতা গণেশ রায়ের দেহও গাছ থেকে ঝুলছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বিজেপি নেতা গৌতম পাত্রের দেহও তাই। রামনগরের হলদিয়া ২ ব্লকে বিজোপি নেতা পূর্ণচন্দ্র দাসের দেহও একইরকমভাবে ছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তৃণমূল ও সরকার তাদের দায় অস্বীকার করে বলেছে, এই নেতারা আত্মহত্যা করেছেন। হঠাৎ বিজেপি নেতাদের মধ্যে এইভাবে আত্মহত্যার ধুম কেন পড়ল, কেনই বা তাঁরা সকলে আত্মহত্যার জন্য গাছকে বেছে নিচ্ছেন তা নিয়ে মনোবিদরা মাথা ঘামাতে পারেন। বিজেপি প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযোগ করেছে, তৃণমূল তাদের নেতাদের হত্যা করেছে।

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

দুই দিন আগে কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলে একটি ক্লাবের দোতলায় বিস্ফোরণহয়। তাতে দোতলার ছাদের কিছুটা অংশ উড়ে যায়। একদিকের দেওয়ালও পড়ে যায়। ক্লাবটি তৃণমূলের এক নেতার বলে এলাকায় পরিচিত। ক্লাবের সদস্যরা প্রথমে বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে। তারপর বলেন, বাইরে থেকে দুটো বোমা মারা হয়েছিল। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তের পর মনে করছে, বোমা বিস্ফোরণেই ছাদ ও দেওয়াল উড়েছে। এর দায় কে নেবে? রাজ্যের মানুষ জানেন, ভোটের আগে বোমা বানানো হলো রাজ্যে সব চেয়ে বড় কুটির শিল্প। এতে কোনো দলই খুব একটা পিছনে থাকে না বলে অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন। আবার ওই প্রশ্ন আসে, দায় কার? এত বোমা, গুলি, হত্যা কেন দেখবে পশ্চিমবঙ্গ?

সহজ কথা হলো, দায় কেউ নেবেন না। নানান কারণ দেখানো হবে। বলা হবে, বামেদের ৩৪ বছরে কে দায় নিয়েছে? ঘটনা হলো, উত্তর প্রদেশে ধর্ষণ হলে কলকাতায় তৃণমূল রাস্তায় নেমে পড়ে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হলে? সেই দায় এড়ানোর খেলা চলতে থাকে, সেই উদাহরণও তো কম নেই।

বিজেপি-র এক নেতা বলেছেন, তাঁরা ঠিক করে ফেলেছেন, এ বার তাঁদের একজন নেতা বা কর্মী আক্রান্ত হলে, উল্টোদিকের চারজন আক্রান্ত হবেন। ওই বলছিলাম না, এক হাতে তালি বাজে না। দুটো হাতই সমানে এভাবেই তালি বাজিয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে। তবে যে দল ক্ষমতায় আছে, তাদের দায়িত্ব যেমন বেশি, তেমনই এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তার দায়ও নিতে হবে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

কিন্তু ভূতটা যদি সর্ষের মধ্যে থাকে তা হলে কী হবে? তা হলে দায় এড়ানোর খেলা চলতে থাকবে। আগের আমলে হয়েছে, এ আমলে হচ্ছে, পরের আমলেও হবে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এতদিনে জেনে গেছেন, ক্ষমতায় যে দল থাকবে, তাদের দিকেই চলে যাবে বাহুবলীরা, মস্তানরা। তাদের পেশীশক্তির আস্ফালন চলতেই থাকবে।  এটাও সম্ভবত গা সওয়া হয়ে গেছে রাজ্যের মানুষদের।