1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গে বাংলা পড়া বাধ্যতামূলক

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২৩ মে ২০১৭

ভারতের রাজ্যে রাজ্যে চলছে চাকা ঘোরানোর চেষ্টা৷ কেরালায় সরকার স্কুলে মালায়লম পড়ানো বাধ্যতামূলক করেছে৷ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারও চলেছে সেই পথে৷ তাদের ঘোষণা, সব স্কুলে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা পড়াতেই হবে৷

https://p.dw.com/p/2dQwA
Geigenkinder vom Himalaya
পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং-এ একটি স্কুলছবি: DW/S. Bandopadhyay

মাতৃভাষা নাকি মাতৃদুগ্ধের সমান৷ সদ্যোজাতের জন্য যেমন মায়ের স্তন্যপান এই পৃথিবীতে আসার পর তাকে অপরিহার্য পুষ্টিগুণ জোগায়, তেমনি মাতৃভাষা সেই শিশুর শিক্ষার সোপান৷ একটি শিশু তার পারিপার্শ্বিকতায় যে ভাষার প্রয়োগ বেশি শুনতে পায়, পঠনপাঠনে তার ব্যবহার হলে শিক্ষা অর্থবহ হয়ে ওঠে৷ একইসঙ্গে একেবারে গোড়া থেকে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি সম্পর্কে ভবিষ্যতের নাগরিকের অচ্ছেদ্য বন্ধন গড়ে ওঠে, স্বজাতির জন্য গৌরবের উত্তরাধিকারি হযে ওঠে শিশুটি৷  

আশির দশক পর্যন্ত শিক্ষাবিদদের এই অভিমত নিয়ে বিতর্ক হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু মাতৃভাষার গুরুত্ব কমেনি৷ গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ভারত বিশ্বায়নের পথে চলা শুরু করার পর থেকেই পরিস্থিতি বদলেছে৷ গোটা পৃথিবী যখন একটা গ্রাম, তা-ও আবার ইন্টারনেটে জোড়া, সেখানে বিশ্বজনীন ভাষা হিসেবে ইংরেজির বিকল্প কী-ইবা হতে পারে? বহুজাতিক সংস্থার ভারতে আগমন, তাদের মাধ্যমে সৃষ্ট কর্মসংস্থান, অথবা দেশের যুবা শ্রেণীর বহির্বিশ্বে চাকরিতে নিয়োগ, এসব মিলে ইংরেজির কার্যকারিতা আজ প্রশ্নাতীত৷ এ কারণেই যত দিন যাচ্ছে, ততই দেশে দেশে বিভিন্ন মাতৃভাষার বদলে ‘কেজো’ ইংরেজি বেশি দাম পাচ্ছে

বিশ্বায়নের অর্থনীতিতে যখন বাজারই সবকিছুর নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে, তখন বাবা-মা ছেলে-মেয়েদের ভালো চাকরির উপযুক্ত করে তোলার জন্য ইংরেজির শরণাপন্ন হয়ে পড়ছেন৷ এই অর্থনৈতিক কারণে মাতৃভাষা যখন কোণঠাসা, তখন ভারতের রাজ্যে রাজ্যে চাকা ঘোরানোর চেষ্টা চলছে৷ এই চাকা ঘোরানোর উদ্যোগে বাম থেকে ডান, সবাই একই পথের পথিক৷ ১১ এপ্রিল কেরলের বাম সরকার সব স্কুলে মালায়লম পড়া বাধ্যতামূলক করেছে৷ সেই পথেই চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও৷ ১৫ মে তারা ঘোষণা করেছে, প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠনে বাংলা থাকতেই হবে৷ শুধু সরকারি বা সরকার-পোষিত স্কুলেই নয়, নিখাদ বেসরকারি স্কুলেও বাংলা পড়াতে হবে৷ সুতরাং নামীদামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল যেখানে বাংলা বলার জন্য পড়ুয়াদের নম্বর কেটে নেওয়া হয়, সেখানেও এবার বাংলা পড়াতে হবে৷ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছানুসারে এই সিদ্ধান্তে নেওয়া হয়েছে৷’’ তিনি জানান, প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাষা হিসেবে যে কোনও ভাষা অধিকার থাকছে পড়ুয়াদের হাতে৷ এই তিনটি ভাষার মধ্যে একটি বাংলা হতেই হবে৷

শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য ‘‘আমাদের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে৷ একটি ছাত্রের মধ্যে গোড়া থেকে এই শ্রদ্ধার বোধ গড়ে তুলতে হবে৷ আগে মাতৃভাষা, তারপর অন্য কোনও ভাষা- রাজ্য সরকার এই আবেগটাকে গুরুত্ব দিতে চায়৷ যদি কেরালা, কর্নাটকে সে রাজ্যের ভাষা পড়া বাধ্যতামূলক হয়ে থাকে, তাহলে এ রাজ্যে বাংলা পড়তে সমস্যা কোথায়? সরকারের ধারণা, ইংরেজি শিক্ষার নামে এ রাজ্যের বিভিন্ন স্কুল যাবতীয় পরিষেবা ও পরিকাঠামো ব্যবহার করে বাংলা ভাষাকেই অবহেলা করছে৷ এর ফলে মাতৃভাষা চর্চাই শুধু অবহেলিত হচ্ছে না, বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও সঙ্কটে পড়ছে৷ একটা জাতি তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে৷’’

তৃণমূল সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিরোধীরা বিশেষ হইচই করেনি৷ আচমকা এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্যে অনেকে নিখাদ রাজনীতিই দেখছেন৷ পশ্চিমবঙ্গে বামেদের ক্ষয়িষ্ণু দশার সুযোগ নিয়ে ক্রমশ জনসমর্থন বাড়াচ্ছে বিজেপি৷

ধর্ম সম্পর্কে ততটা স্পর্শকাতর নয় বলেই পরিচিতি ভারতীয় বাঙালিদের৷ তাই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো নেতা এ রাজ্যে জন্ম নিলেও কোনওদিন সংখ্যাগুরুর ধর্মাশ্রিত রাজনীতি হালে পানি পায়নি৷ সেখানেই হিন্দু জাতীয়তাবাদকে নিয়ে এগোতে চায় নরেন্দ্র মোদীর দল৷ তাই এবার রামনবমী কিংবা হনুমান জয়ন্তীতে উল্লাস-উৎসবের আবহ ছিল চোখে পড়ার মতো৷

সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুলে বাঙালি হিন্দুর ৭৫ শতাংশ ভোট নিজেদের দিকে টানতে চাইছে বিজেপি৷ অনেকে মনে করছেন, সেই রাজনীতির মোকাবিলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পাল্টা হাতিয়ার করতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাই হিন্দু আবেগের বিরুদ্ধে তিনি বাঙালি আবেগকে উস্কে দিয়েছেন৷ কলকাতায় ব্যবসায়ী থেকে দিনমজুর, এই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই অবাঙালি৷ তাঁদের আধিপত্য চাক্ষুষ করা বাঙালির ভিতরে সুপ্ত ভাষাকেন্দ্রিক আবেগকে জাগিয়ে তুলছে রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত৷ যারা তৃণমূল সরকারের ঘোর সমালোচক, তাঁদেরও বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘বাংলায় থাকবে অথচ বাংলা পড়বে না, সেটা হয় নাকি?’’ অর্থাৎ, রাজ্য জুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঢেউ তুলতে চাইছে শাসকদল৷ বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদ পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে একজোট করতে চায়, তা সে বাঙালি, ওড়িয়া, মারোয়াড়ি, হিন্দুস্থানি যা-ই হোক না কেন৷ এটা যেন তার বিরুদ্ধে তৃণমূলের পাল্টা অস্ত্র৷ এর ফলে হিন্দু ও মুসলিম বাঙালির মধ্যে ধর্ম নিয়ে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা রুখে দেওয়া যাবে৷

ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্র্রে প্রাদেশিক আন্দোলন হয়েই থাকে৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ‘আমরা বাঙালি’র মতো সংগঠন কখনও কল্কে পায়নি৷ মমতা সেই উগ্র প্রাদেশিকতার পথে গেলেন না, কিন্তু আচমকা বাংলা পঠন পাঠনকে বাধ্যতামূলক করে বাঙালির আবেগকে জাগিয়ে তুলতে চাইলেন৷ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সব মহলই সমর্থন জানাচ্ছে৷ সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন বলেন, ‘‘ভীষণ জরুরি সিদ্ধান্ত৷ এই সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল৷ মাতৃভাষায় পড়াশোনার কোনও বিকল্প হতে পারে না৷’’

একজন ব্যক্তি যে রাজ্যে থাকে, সেই রাজ্যের ভাষা শিখলে তারই সুবিধা: সাবেক বামফ্রন্ট মন্ত্রী

বামপন্থিরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে৷ পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী ও অধ্যাপক শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘একজন ব্যক্তি যে রাজ্যে থাকে, সেই রাজ্যের ভাষা শিখলে তারই সুবিধা৷ কাজের ক্ষেত্রে ভাষার প্রয়োজন হবেই৷'' কিন্তু বিশ্বায়িত দুনিয়ায় ইংরেজি ছাড়া এগোনো যাবে? এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জার্নাল ‘কম্পিউটার জগৎ’-এর উল্লেখ করেন তিনি৷ অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই পত্রিকার সম্পাদক মুস্তাফা আনোয়ার স্বপন মস্কো থেকে রুশ ভাষার ক্র্যাশ কোর্স করেছিলেন৷ তিনি বাংলাভাষায় প্রথম এ ধরনের জার্নাল প্রকাশ করেন৷ তাই বিষয়টা গভীরভাবে বোঝাটাই আসল, ভাষা যা-ই হোক না কেন৷’’

বামফ্রন্ট সরকার অতীতে মাতৃভাষায় শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিল৷ তাঁদের ইংরেজি বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল৷ এ ব্যাপারে প্রাক্তন মন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা মাতৃভাষা বা ইংরেজি কোনওটিরই গুরুত্ব কমাইনি৷ ইংরেজি প্রথমে পঞ্চম শ্রেণি থেকে পড়ানো হতো, পরে সিদ্ধান্ত বদলে প্রথম শ্রেণি থেকে পড়ানো হয়৷ মাতৃভাষা যদি পড়ুয়াকে পিছিয়ে দেয়, তাহলে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়রিংয়ে বাংলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা সফল হতো না৷’’