1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
স্বাস্থ্য

প্রাইভেট হাসপাতালে ৮০ ভাগ প্রসব অস্ত্রোপচারে

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাংলাদেশে সিজারিয়ান বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার বাড়ছে৷ প্রয়োজন ছাড়াই চিকিৎসক ও পরিবার বেছে নিচ্ছেন এ পদ্ধতি৷ এর জন্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর মুনাফার লোভ এবং মা ও তাঁর পরিবারের অসচেতনতাই দায়ী৷

https://p.dw.com/p/2k5yM
ছবি: picture-alliance/D. Karmann

শারমিন আক্তার ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন৷ তিনি প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তাঁর প্রসব হবে নর্মাল বা স্বাভাবিক পদ্ধতির মাধ্যমে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই আশা পূর্ণ হয়নি৷ চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে অস্ত্রোপচার করতেই হয়েছে৷ জানতে চেয়েছিলাম কেন সিজার করতে হলো? জবাবে তিনি জানালেন, ‘‘সন্তান প্রসবের সপ্তাহ খানেক আগে মাথায় অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় বলে চিকিৎসকরা এ রকম সিদ্ধান্ত নেন৷ আমি বিশ্বাস করি চিকিৎসকরা হয়ত সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন৷ তবে আমার পরিচিত কয়েকজনের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা হলো, চিকিৎসকরা তাঁদের বিনা প্রয়োজনে সিজারিয়ানের পরামর্শ দিয়েছেন৷ আমার মনে হয়, এটা হয়ত তাওরা আর্থিক কারণেই করেছেন৷''

শারমিন আরো জানান, ‘‘আবার এমনও দেখেছি যে পরিবারের পক্ষ থেকেই সিজারিয়ান বেছে নেয়া হয়ছে৷ কেউ ভয়ে আবার কেউ অনেকটা ফ্যাশানের কারণে এ রকম করে থাকেন৷ তবে আমি মনে করি সন্তান স্বাভাবিকভাবে ডেলিভারি হওয়াই ভালো৷''

এটা যে শুধু রাজধানী ঢাকার চিত্র, তা কিন্তু নয়৷ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন মাতৃসেবার নামে অনেক ক্লিনিক গড়ে উঠেছে৷ সেসব ক্লিনিকেও গর্ভবতী মায়েদের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবে রীতিমত উৎসাহ দেয়া হচ্ছে৷ ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মা বলেন, ‘‘আমাকে তো রীতিমত ভয় দেখানো হয়েছিল৷ বলা হয়েছিল, সিজার না করলে শিশু মারাও যেতে পারে৷ আমার ইচ্ছা ছিল না৷ কিন্তু করাতে বাধ্য হই৷ কেননা কোনো মা-ই চাইবেন না সন্তানের ক্ষতি হোক৷''

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে বা বিডিএইচএস-এর জরিপে দেখা যায়, দেশে স্বাভাবিক প্রসব ৬২ দশমিক ১ শতাংশ, সিজারিয়ান ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অন্যান্যভাবে ২ দশমিক ৫ শতাংশ সন্তানের জন্ম হয়৷

বিডিএইচএস-এর তথ্য অনুসারে, ‘‘২০০৪ সালে সিজারের মাধ্যমে সন্তান হতো ৪ শতাংশ, ২০০৭ সালে হতো ৯ শতাংশ, এবং পরে ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশে৷ আরো পরে ২০১৭ সালে এই সংখ্যা হয় ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ৷ এই জরিপে স্পষ্ট যে, গত ছয় বছরে সিজারিয়ানের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে৷ এই হিসাবটি হাসপাতাল এবং হাসপাতালের বাইরে জন্ম নেয়া সব শিশুকে গণনায় ধরে তৈরি করা হয়৷

‘চিকিৎসকরা তাঁদের বিনা প্রয়োজনে সিজারিয়ানের পরামর্শ দিয়েছেন’

কিন্তু হাসপাতালে যেসব মায়ের সন্তান হয় সেই চিত্রটি কেমন? বিডিএইচএস-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ১০টির মধ্যে ছ'টি শিশুরই জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে৷ এক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রাইভেট হাসপাতালে৷ সমাজে সবচেয়ে শিক্ষিত ও সচ্ছ্বল পরিবারের ৫০ শতাংশ শিশুরই জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে৷ আর গর্ভবতী মায়েদের সন্তান প্রসব করার স্থানের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ, বেসরকারি হাসপাতালে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ, এনজিও হাসপাতালে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, বাড়িতে ৪২ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং অন্যান্য স্থানে ১ দশমিক ৫ শতাংশ সন্তান প্রসব হয়৷

অন্যদিকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হেল্থ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ‘দেশের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রপচারের মাধ্যমে জন্মদান প্রায় আট গুণ বেড়েছে৷ ২০১৩ সালে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে এক লাখ ৬৬ হাজার ৭২১ জন অন্তঃসত্ত্বা মা ভর্তি হন৷ এর মধ্যে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৬৪ জন শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেয়৷' কিন্তু এদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশের প্রসব স্বাভাবিক ভাবেই করা যেত বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, একটি দেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হার ১০-১৫ শতাংশের মধ্যে থাকা উচিত৷ কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে এই হার ৩৮ শতাংশ৷ বেসরকারি হাসপাতালে ৮০ শতাংশ৷

‘মায়েদের দাবি, চিকিৎসকরা ভয় দেখিয়ে সিজারিয়ানে বাধ্য করেন’

ঢাকাসহ সারাদেশের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের বিভিন্ন দামের প্যাকেজ রয়েছে৷ একদিন থেকে তিনদিনের এই প্যাকেজ নিয়ে রীতিমত প্রচার প্রচারণা চালানো হয়৷ এর খরচ ২০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা৷ তবে সরকারি এবং এনজিও পরিচালিত হাসপাতালে পাঁচ হাজার টাকায় সিজারিয়ান করা হয়৷ উপজেলা পর্যায়ে পাঁচ থেকে ২৫ হাজার টাকা, জেলা পর্যায়ে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা৷

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাংবাদিক জাকিয়া আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘চিকিৎসকরা দাবি করেন, মায়েরা ভয় এবং ফিগার সচেতনতার কারণে সিজারিয়ানের দিকে বেশি ঝুঁকছেন৷ ওদিকে মায়েদের দাবি, চিকিৎসকরা ভয় দেখিয়ে সিজারিয়ানে বাধ্য করেন৷ আসলে দু'টোই ঠিক৷ আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর এখন বড় একটি ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান প্রসব৷''

৭ই এপ্রিল বিডিএইচএস-এর জরিপ প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘‘বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর বাণিজ্যিক মানসিকতার কারণেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার বাড়ছে৷ বড় বড় ক্লিনিক ও চিকিৎসকরা অন্তঃসত্ত্বাকে চটজলদি সিজারিয়ান করার ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহ দিয়ে থাকে৷ এতে দেশে অনেক শিশু আগে জন্ম নেয়৷ নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নেয়ায় এ সব শিশু বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনেক জটিল রোগসহ নানা সমস্যায় ভোগে৷ সমাজ ও দেশ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷''

‘সিজারিয়ান সাধারণভাবে মা এবং শিশু উভয়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে’

মায়েদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সংশ্লিষ্টদের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিলে হয়ত মায়ের কষ্ট কম হয়৷ কিন্তু স্বাভাবিকভাবে একটি শিশু জন্ম দেয়ার পরে একজন মায়ের যে আনন্দ হয়, তা নিতান্তই প্রাকৃতিক, অনাবিল৷''

কুমুদিনী হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাধারণত চার কারণে সিজারিয়ান বাড়ছে – ১. বেশি বয়সে বিয়ে, ২. গর্ভবতী মায়েরা বা তাঁর পরিবার চান তাই, ৩. হেল্থ চেক-আপ এবং ৪. বেসরকারি হাসপাতালের প্রবণতা৷''

তিনি বলেন, ‘‘বাস্তবে যেখানে অস্ত্রোপচারের দরকার সেখানে তা করাতেই হবে৷ কিন্তু এখন একটা প্রবণতা দেখা গেছে মা বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা কোনো কারণ ছাড়াই সিজারিয়ান করাতে চান৷ সেক্ষেত্রে চিকিৎসকদের কিছু করার থাকে না৷ বহু বেসরকারি হাসপাতালেই এহেন সিজারিয়ান প্রবণতা আছে৷ তার কারণও স্পষ্ট৷ সরকারের উচিত এর ওপর মনিটরিং বাড়ানো৷ সিজারিয়ান সাধারণভাবে মা এবং শিশু উভয়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে৷ এতে সন্তানের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে৷''

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘প্রথম সন্তান সিজারিয়ানের মাধ্যমে হলে পরের সন্তানও সিজারিয়ান করাতে হবে, এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা৷ আসলে সিজারিয়ান প্রয়োজন আছে কিনা – তা আসলে একজন সঠিক এবং নির্মোহ চিকিৎসকই বলতে পারবেন৷''

এ বিষয়ে আপনার মতামত লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷