1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রাণের মেলা একুশে বইমেলা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩০ জানুয়ারি ২০১৭

বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা একুশের বইমেলা নামেই পরিচিত৷ এই মেলা বাঙালির প্রাণের মেলা – লেখকের মেলা, প্রকাশকের মেলা, পাঠকের মেলা৷ এই মেলাকে কেন্দ্র করেই প্রকাশিত হয় শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ সৃজনশীল বই৷

https://p.dw.com/p/2WPfD
একুশে বইমেলা ২০১৬
ছবি: DW/M. M. Rahman

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ‘বইমেলার ইতিহাস ও নতুন আঙ্গিকে বইমেলা' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন৷ সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা সাহেব যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, তখন তিনি বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা'-র আয়োজন সম্পন্ন করেন৷ কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দু'জন ছাত্র নিহত হয়৷ ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি৷ ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়৷ এরপর প্রতিবছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করে৷''

২০১৪ সাল থেকে এই বইমেলা বর্ধমান হাউজ থেকে সম্প্রসারিত হয়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বিস্তৃত হয়৷ এই মুহূর্তে প্রকাশকদের স্টলগুলো সোহরাওয়ার্দি উদ্যানেই স্থান দেয়া হয়েছে৷ আর বর্ধমান হাউজ এলাকায় লিটল ম্যাগ, মিডিয়া এবং বাংলা একাডেমিসহ অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়৷ সব মিলিয়ে এখন তিন শতাধিক প্রকাশকের প্রায় চারশ' স্টল থাকে মেলায়৷ অন্যসব বইমেলা প্রকাশকরা করলেও একমাত্র ব্যতিক্রম হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা৷ এটা বরাবরই বাংলা একাডেমি আয়োজন করে আসছে৷

১৯৮৪ সালের আগেও এই বইমেলার কিছু ধারাবাহিকতা আছে৷ ১৯৬৫ সালে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের তখনকার পরিচালক, কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীন তখনকার পাবলিক লাইব্রেরিতে (এখন ঢাকা বিশ্বদ্যালয় লাইব্রেরি) শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছিলেন, যাকে ঢাকার প্রথম বইমেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ তারপর ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রথম একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলারও আয়োজন করা হয়েছিল৷

শামসুজ্জামান খান তাঁর প্রবন্ধে আরো লিখেছেন, ‘‘ওই বছর বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন৷ তাঁর দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও ওভাবেই তাঁদের বই নিয়ে বসে যান৷ ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বিশাল জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেলার উদ্বোধন করেন৷ সে উপলক্ষ্যে নিজামী, চিত্তবাবু এবং বর্ণমিছিলসহ সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান৷''

সেই মেলা, এই মেলা

গত বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালে, বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৪৪৪টি৷ এছাড়া একাডেমির নজরুল মঞ্চ ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যান অংশে মোট ৫৩৫টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে৷ আর বই বিক্রি হয়েছে মোট ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকার৷

২০১৪ সালের বইমেলায় মোট ১৬ কোটি  টাকার বই বিক্রি হয়েছে৷ মেলার পরিসর ও প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়, ২০১৫ সালে তুলনায় ২০১৬ সালে প্রায় দ্বিগুণ বই বিক্রি  হয়৷ মেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, ‘‘বাংলা একাডেমি থেকে  প্রকাশিত বইয়ের চাহিদা থাকে সব সময়ই৷ গত বছর মেলায় বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়নসহ বিভিন্ন স্টল ও বিক্রয় কেন্দ্র থেকে একাডেমির বিক্রিত বইয়ের পরিমাণ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা৷ ২০১৫ সালে ১ কোটি ৫৮ লাখ এবং ২০১৪ সালে ১ কোটি ১৮ লাখ ঢাকার বই বিক্রি করেছে বাংলা একাডেমি৷''

বইমেলা প্রাঙ্গনের মোট আয়তন চার লাখ ৭৮ হাজার বর্গফুট৷ গত বছর মেলায় ৬৫১টি ইউনিটে মোট ৪০১টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন অংশ নেয়৷ এর মধ্যে প্যাভিলিয়ন ১৫টি, চার ইউনিটের স্টল ১৯টি, তিন ইউনিটের স্টল ৩৭টি, দুই ইউনিটের স্টল ১৩৪টি ও এক ইউনিটের স্টল ছিল ১৯৬টি৷ এর বাইরে বহেরা তলায় ছিল লিটল ম্যাগের ৯০টি স্টল৷ এবারও আয়োজন একইরকম বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ৷

আলোচিত শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন আহসান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এই বইমেলা এখন সৃজনশীল প্রকাশকদের বই প্রকাশের প্রধান টার্গেট৷ এই মেলাকে কেন্দ্র করেই সারা বছরের শতকরা ৯০ ভাগ সৃজনশীল বই প্রকাশ হয়৷ তাই আমরা মেলার জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি৷ এবারও চার শতাধিক প্রকাশক প্রায় চার হাজার বই প্রকাশ করবেন বলে আশা করছি৷''

রবিন আহসান

তিনি জানান, ‘‘এটা প্রকাশকদের মেলা নয়, বাংলা একাডেমির মেলা৷ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস, ঐাতহ্য৷ তাই এই মেলার একটা ভিন্ন মাত্রা আছে৷ এটা আমাদের জাতীয় ঐহিত্য৷''

রবিন আহসান আরো জানান, ‘‘এই মেলায় শুধু বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষার বই থাকে৷ বিদেশি ভাষা বা বিদেশি প্রকাশকদের এখানে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই৷''

তরুণ এই প্রকাশক জানান, ‘‘বইমেলায় নতুন বই আসে, নতুন লেখকরাও আত্মপ্রকাশ করেন৷ আর পাঠকরা নেন নতুন বইয়ের ঘ্রাণ৷ এবার আমি কমপক্ষে ৩০টি নতুন বই নিয়ে আসছি৷ এর মধ্যে নতুন লেখকদের বইও আছে৷''

প্রসঙ্গত, বাংলা একাডেমির একটি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় এ বছর শ্রাবণ প্রকাশনীকে মেলায় স্টল বরাদ্দ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল একাডেমি কর্তৃপক্ষ৷ শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদের মুখে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে শ্রাবণ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়৷ এ প্রসঙ্গে রবিন আহসান বলেন, ‘‘বইমেলা হলো মুক্তবুদ্ধির মেলা৷ এখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এগিয়ে যাবেই৷''

প্রাণের মেলা

‘‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের প্রাণের মেলা'' বললেন কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এই মেলাকে সামনে রেখেই অধিকাংশ লেখক তাঁদের লেখা তৈরি করেন৷ তাছাড়া প্রবীণের সঙ্গে নতুন অনেক লেখকেরও আবির্ভাব হয়৷''

সেলিনা হোসেন বলেন, ‘‘এই মেলা পাঠক সৃষ্টি করে পাঠক ধরে রাখে৷ ডিজিটাল এই যুগেও বইমেলার আকর্ষণে পাঠকরা ছুটে আসেন, নতুন বই ছুঁয়ে দেখেন, কেনেন৷ নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হন তাঁরা৷ এই মেলা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষে অনেক বড় ভূমিকা রেখে আসছে৷''

সেলিনা হোসেন

তাঁর কথায়, ‘‘শিশুদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে এই মেলার বড় ভূমিকা আছে৷ মেলায় চালু করা হয়েছে শিশুপ্রহর, অর্থাত শিশুদের বইয়ের জন্য আদালা চত্বর৷''

সেলিনা হোসেন বাংলা একাডেমি পরিচালনা পর্ষদেরও সদস্য৷ তাই বাংলা একাডেমির ভূমিকা নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে৷ তিনি জানান, ‘‘বাংলা একাডেমি রাত-দিন কাজ করছে এই মেলাকে সফল করতে৷ এর নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য সবদিক নিয়ে কাজ করছেন তারা৷''

এবার বইমেলায় নতুন লেখক হিসেবে প্রথম বই নিয়ে আসছেন সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবু৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বইমেলায় আমি আমার প্রথম বই নিয়ে আসছি কয়েকটি কারণে৷ এই মেলায় পাঠকের সবচেয়ে বড় সমাবেশ ঘটে৷ এই মেলাতেই পাঠকরা নতুন লেখকদের বই খোঁজেন৷ তাই পাঠকের কাছে পৌঁছানোর এর চেয়ে সহজ পথ আর নেই৷ বিজ্ঞাপন লাগে না, প্রচার লাগে না৷ ভালো বই হলে পাঠক লুফে নেন৷''

নিরাপত্তা

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সম্প্রসারণের পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে, বইমেলা চলাকালে মেলা থেকে বের হওয়ার পর জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়৷ এর আগে ২০০৪ সালে বইমেলার বাইরে হামলার শিকার হন প্রথাবিরোধী লেখক অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ৷ পরে তিনি জার্মানিতে মারা যান৷ রবিন আহসান বলেন, ‘‘বইমেলার ভিতরের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংকট নাই৷ তবে বাইরের নিরাপত্তা আরো বাড়ানো দরকার৷''

মাসুদুর রহমান

বইমেলার নিরাপত্তা পরিকল্পনা সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বইমেলার প্রতিটি গেটে ডিজিটাল নিরাপত্তা তল্লাশির ব্যবস্থা থাকবে৷ মেলার ভিতরে এবং বাইরে থাকবে পর্যাপ্ত সিসি টিভি ক্যামেরা৷ মেলায় সার্বক্ষণিক আমাদের নিয়ন্ত্রণকক্ষ কাজ করবে৷ বাইরে উঁচু ভবন থেকে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাও থাকবে বরাবারের মতো৷ আমরা মেলা এবং মেলার বাইরে আশেপাশের এলাকা নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে ফেলব৷''

জানা গেছে, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার আওতায় থাকবে বইমেলা প্রাঙ্গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান৷ বিভিন্ন পয়েন্টে থাকবে র‌্যাব ও পুলিশের চেকপোস্ট৷

এর বাইরে বইমেলায় পাইরেসি, নকল বই বা মেলার নীতিমালা ভঙ্গ কেউ করছেন কিনা তা দেখতে একাডেমির আলাদা টিম কাজ করবে আগের মতোই৷

বইমেলা শুধু বইমেলা নয়, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে আয়োজন করা হয় ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিভিত্তিক আলোচনা সভা এবং অনুষ্ঠান৷ তাতে বিদেশি লেখকরাও অংশ নেন৷ এছাড়া এই মেলা চলাকালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়৷ বরাবরের মতো  এবারও প্রধানমন্ত্রী ১ ফেব্রুয়ারি মেলার উদ্বোধন করবেন বলে খবর৷

বন্ধ, আপনি কি বইমেলা যাবেন? কার বই আপনার সবচেয়ে প্রিয় লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য