1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ফেসবুক ভাইরালের ভাইরাস

জাহিদ হোসেন
৩০ আগস্ট ২০১৯

ফেসবুক ব্যবহারকারিরা প্রায়ই দাবি করেন দেশের অনেক অপরাধ সামাজিক এই যোগাযোগ মাধ্যমে আসার কারণেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আসছে৷ এসব অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে খুব জোর ভূমিকা রাখছে৷ তাদের এই কথার সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই৷

https://p.dw.com/p/3OkPp
প্রতীকী ছবিছবি: Getty Images/AFP/M. Kiran

তবে অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে কখনো কখনো আমরা অন্য একটি অপরাধ করছি কিনা তা ভেবে দেখার অবকাশ আছে৷

সংবাদ মাধ্যমে প্রায়ই খবর পড়ি৷ ফেসবুকে ভাইরালের হুমকি দিয়ে তরুণীর শ্লীলতাহানি৷ এধরনের খবর থেকে বুঝি যখন কোন কিছুর মধ্যে একটা ‘ক্ষমতা' তৈরি হলে তার চরিত্র ক্ষমতার স্বাভাবিক ‘চরিত্র' হয়ে যায়৷ ফেসবুক তাই একদিকে যেমন অপরাধিদের শাস্তির দুয়ার খুলে দিচ্ছে৷ অন্যদিকে অপরাধীদের অপরাধ করার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে৷

মানুষ ছুড়ি চাকু বন্দুক রামদা এমন নানা অস্ত্র দিয়ে যেমন হুমকি দিচ্ছে৷ আজকাল ফেসবুক ভাইরালও তেমনি এক অস্ত্র হয়ে উঠেছে৷ আর সব অস্ত্রের মতোই এই অস্ত্র ব্যবহার তাই শতর্কতা দাবি করে৷ 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শুধু যোগাযোগ আর তথ্য আদান প্রদানের বাইরে গিয়ে যখন ব্যক্তির সিদ্ধান্ত দেয়ার প্রধান এবং অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে তখন বিপদের ঝুকি বাড়ে৷ বিশেষ করে অপরাধের মতো ক্ষেত্রে৷ যেখানে অভিযুক্তের পক্ষে ওকালতি খুব একটা চোখে পরে না৷ সেখানে যুক্তিতর্কের মধ্যে তথ্য প্রমাণ ছাড়াই সিদ্ধান্ত পৌছে যাচ্ছেন সবাই৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রায়ালের আসাছে তাৎক্ষণিক রায়৷

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার কারনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব রায় প্রভাবিত করছে প্রশাসনকে এমনকি কখনো কখনো বিচারকেও৷ একটা যুক্তি এখন প্রবল হচ্ছে৷ সরকার যা কিছু ভালো করছে, বিশেষ করে অপরাধ দমনে তার বলতে গেলেই সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চাপে৷ একথা অনেকাংশে সত্যও৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই শক্তি নিয়ে ব্যবহারকারিদের মধ্যে একটা গৌরব বোধ আছে৷ এবং এর মাধ্যমে তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করছেন বলে গর্ব করেন৷

কোনটা বড় অপরাধ তা যেনো এখন নির্ভর করছে ঘটনার ভয়াবহতার চাইতেও ওই ঘটনার ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আছে কি নেই তার ওপর৷ গত কয়েক বছরের একটা সাধারণ হিসেব যদি নেন তাহলে হলে দেখা যাবে তনু বা রূপা হত্যার মতো খুব কম ঘটনাই অপরাধির বিচারের জন্য মানুষকে এক করতে পেরেছে যে ঘটনার কোন ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেই৷

নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে অত্যন্ত নারকীয়ভাবে৷ কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি ওসি মোয়াজ্জেমের ছড়িয়ে দেয়া ভিডিও না থাকলে হয়তো এ নারকীয় হত্যা পাড়া গায়েঁর বাইরে বের হতেই পারতো না৷ দেশকে আলোড়িত করার প্রশ্নই ওঠে না৷

ওই যে যে বল্লাম তনু কিংবা রূপা ছাড়া এ সময়ের আলোচিত অধিংশ অপরাধই আমরা কোন না কোনভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পেয়েছি৷ যত বড় অপরাধই হোক না কেনো প্রশাসনকে চাপে ফেলতে ভাইরালই মোক্ষম অস্ত্র৷ মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমও অধিকাংশ সময় নিজেরা এজেন্ডা সেট করে দিতে পারছে না৷ বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ঢেউয়ে নিজেদের ভেসে নিয়ে যাচ্ছে৷

যে কোন বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিচারের বিষয়ে আমি সতর্ক থাকার পক্ষে৷ কেননা বিচার যারা করছেন তাদের যে কলেকটিভ মনোভাব দেখি তা কোনভাবেই জুডিশিয়াল বলা যাবে না৷ ফেসবুক আমাদের সমাজের একটা বৈশিষ্ঠ্য খুব নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে৷ বেশিভাগ ক্ষেত্রেই আপনি যদি মানুষে কমেন্ট পড়েন দেখবেন সেটানে এমন একটা নোংরা, অশ্লীল আর অসংবেদনশীল বেহায়া চেহারা৷ সেটা শুধু একজন দুইজন না, দেখা যায় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবার৷যেখানে ফুটে ওঠে গোটা একটা সমাজের বিশ্রি চেহারা, নিচু মানসিকতা৷ এমন মানুষরাই বিচার করছেন৷ সেখানে বিচারের স্বাভাবিক নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান কল্পনা করা যায় না৷

যে সমাজের মানুষকে পাশের মানুষের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে খুব একটা দেখি না৷ একটা ভদ্রতার দোহাই দিয়ে প্রয়োজনীয় অপ্রিয় সত্য পর্যন্ত আমরা বলি না৷ ফেসবুক কিভাবে যেনো আমাদের ভদ্রতার সেই পর্দা সরিয়ে দিতে পেরেছে৷ যাকে চিনি না জানি না তার ওপর কেমন হামলে পরছি!

রুচিহীন বলে বিস্তারিত বলছি না৷ কিন্তু রিফাত হত্যার পর যখন আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে আসামি করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রেখে থাকলে দেখেছেন মানুষের অধিকাংশ প্রতিক্রিয়াই সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, জেন্ডার অসংবেদনশীল এবং আইনগতভাবে মানহানির অপরাধ৷ সেদিকে নজর দেয়ার কেউ নেই৷ আবার যারা ব্যবস্থা নিতে পারেন তাদের দায়িত্ব দিলে তারা মানাহানিকর বক্তব্যের বিরুদ্ধে নয় কোমর বেধে নেমে পড়বেন বলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে৷ 

Zahid Hossain,
জাহিদ হোসেন, সাংবাদিকছবি: privat

প্রথাগত বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনের উদাসীনতা, গণতন্ত্রিক স্পেস কমে আসা যখন আমাদের চারদিকের বাস্তবতা তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা মানুষের খুব প্রসংশনীয় উদ্যোগ৷ এ অস্ত্র যে কার্যকর তাতে সন্দেহ নেই৷  আশঙ্কার কথা  অপরাধীরাও এর ব্যবহার খুঁজে পেয়েছেন৷ গত কয়েকদিনে একাধিক ধর্ষণ, ছাত্রীকে ব্ল্যাকমেইল এমনকি প্রবাসীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য ফেসবুক ভাইরালের হুমকি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের খবর দেখলাম৷

ফেসবুক ভাইরাল সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিষেধকের ভূমিকা অব্যাহত রাখবে নাকি অপরাধের নেটবাহী ভাইরাস হিসেবে ব্যবহার হবে তা নির্ভর করবে ব্যবহারকারিদের ওপর৷ রাতারাতি পুরো সামাজের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হয়তো করা কঠিন৷ কিন্তু ফেসবুক ভাইরাল যেনো ভাইরাস না হতে পারে তার এন্টি ভাইরাস খুজে বের করার উদ্যোগ নেয়ার এখনই সময়৷ আর সে উদ্যোগ এই মাধ্যম ব্যবহারকারিদের নিতে হবে ৷ সরকার বা পুলিশ দায়িত্ব নিলে তারা আমূল উপড়ে ফেলার দিকে ঝুঁকবেন৷ কেননা সরকার জানে, সামাজিক বিচারই তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের শেষ যুদ্ধ৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷