1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বদলাচ্ছে আত্মহত্যার সংজ্ঞা, বাড়ছে সংখ্যাও

১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

ভারতে আত্মহত্যা বন্ধ করতে নানা পর্যায়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে৷ আত্মহত্যার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বিস্তর আলোচনা চলছে৷  

https://p.dw.com/p/46sEr
ছবি: Lehtikuva Sanna Heikintalo/dpa/picture alliance

রিং হচ্ছে তো হচ্ছেই৷ অন্যপ্রান্তে উত্তর দেওয়ার কেউ নেই৷ বেশ কয়েকবার সেই নম্বরে ফোন করার পর ফের ইন্টারনেট ঘাঁটতে শুরু করলাম৷ পাওয়া গেল আরো বেশ কয়েকটি নম্বর৷ দ্বিতীয় নম্বরে ফোন করতেই উল্টো দিক থেকে স্বয়ংক্রিয় কণ্ঠ বলে উঠল-- নম্বর ব্যস্ত৷ কিছুক্ষণ পর ফোন করতে হবে৷ তৃতীয় নম্বরের অভিজ্ঞতাও একই৷

প্রতিটি ফোনই করেছিলাম এই লেখার স্বার্থে৷ ভারতে আত্মহত্যার পরিস্থিতি নিয়ে ব্লগ লিখতে গিয়ে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছি৷ সরকারি এবং আধা-সরকারি অনেকেই দাবি করেছেন, দেশে এখন বহু হেল্পলাইন নম্বর আছে৷ আত্মহত্যা বন্ধ করার জন্যই এই হেল্পলাইন নম্বরগুলি খোলা হয়েছে৷ আত্মহত্যামুখী ব্যক্তি ওই নম্বরে ফোন করলে অথবা আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার ফোন করলেও সাহায্য মিলবে৷ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হলো, ফোন পাওয়াই কার্যত ভাগ্যের ব্যাপার৷ 

সম্প্রতি এই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে৷ কারণ চলতি বাজেট অধিবেশনে ভারত সরকার জানিয়েছে, আত্মহত্যা রুখতে গোটা দেশে ২৩টি নতুন হেল্পলাইন তৈরি করা হচ্ছে৷ প্রশ্ন উঠছে, নতুন করে হেল্পলাইন তৈরি না করে যে নম্বরগুলি ছিল, সেগুলিকেই সক্রিয় করলে হতো না? নতুন হেল্পলাইনের ভবিষ্যতও আগেরগুলির মতোই হবে না তো?

বিশিষ্ট মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘আত্মহত্যার সঙ্গে অবসাদ শব্দটিকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়৷ অবসাদ থেকে আত্মহত্যার মানসিকতা তৈরি হতে পারে৷ কিন্তু যারা আত্মহত্যা করেন, তারা কেবল অবসাদ থেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেন, এমন ভাবা ঠিক নয়৷’’ অনুত্তমার বক্তব্য, আত্মহত্যা আসলে একটা ইমপাল্স৷ এক বিশেষ মানসিক পরিস্থিতিতে মানুষ আচমকাই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন৷

প্রশ্ন হলো, আচমকা যিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তিনি কি হেল্পলাইনে ফোন করবেন? সাহায্য নেওয়ার কথা ভাববেন? অনুত্তমার বক্তব্য, অনেক সময়েই আত্মহত্যা করতে যাওয়ার আগে ব্যক্তি একটা শেষ সুযোগ তৈরির চেষ্টা করেন৷ হয়তো একবার কারও সঙ্গে কথা বলার কথা ভাবেন৷ কিন্তু তখন যদি ফোনই কাজ না করে, তাহলে আর কিছু করার থাকে না৷ সে কারণেই সামাজিক পর্যায়ে সাহায্যের রাস্তাগুলি আরো সহজ এবং সচল করা উচিত৷ বাস্তবে যা সেভাবে হচ্ছে না৷

মনোসমাজবিদ মোহিত রণদীপ আবার আত্মহত্যাকে কেবলই একটি মানসিক সমস্যার অবস্থান থেকে দেখতে চান না৷ আত্মহত্যা অনেক সময় সর্বোচ্চ প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও উঠে আসে৷ অথবা এর সঙ্গে জুড়ে থাকে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি৷ বছরের পর বছর যে আলু চাষি ফসলের দাম পাচ্ছেন না৷ দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়ছেন৷ তিনি যখন আত্মহত্যা করেন, তখন তা কেবলমাত্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আটকে থাকে না বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন মোহিত৷ বিষয়টি তখন এক সামাজিক সংকটের জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়৷ আত্মহত্যা সেখানে একটি স্টেটমেন্ট হয়ে যায়৷ কৃষক আন্দোলনের সময়েও দেখা গিয়েছিল একাধিক কৃষক আত্মহত্যা করেছেন৷ সেটা ছিল তাদের স্টেটমেন্ট৷ ‘‘হেল্পলাইন তৈরি করে এই আত্মহত্যা বন্ধ করা যায় না৷ এই আত্মহত্যা বন্ধ করার জন্য সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন৷ সরকার যা এখনো পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি৷’’ মোহিতের অভিযোগ, যে কৃষক আন্দোলন নিয়ে এত ঘটনা ঘটল৷ যার জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চাইলেন এবং আইন বাতিল করলেন, তিনি কিন্তু এখনো তার পুরনো মতেই অনড়৷ সে কারণেই উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে ফের তিনি নিজের পুরনো অভিমতকেই ভালো বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন৷ এটাই প্রমাণ করে, কৃষক আত্মহত্যা কমানোর সদিচ্ছা সরকারের নেই৷

স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

তবে একটি কথা প্রায় সব বিশেষজ্ঞই বলছেন৷ আগের চেয়ে আত্মহত্যার কথা এখন অনেক বেশি জানা যায়৷ এর অর্থ এই নয় যে, আগে আত্মহত্যা কম হতো৷ এর অর্থ, আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা রিপোর্ট হচ্ছে বেশি৷ মানুষ এবিষয়ে সচেতন হয়েছেন বেশি৷ সচেতনতা বাড়লে, সমস্যার সুরাহাও সহজ হয় বলে তাদের বক্তব্য৷

অনুত্তমার মতে, দীর্ঘদিন আত্মহত্যা একটি সামাজিক ট্যাবু হয়ে ছিল৷ ধীরে ধীরে সেই ট্যাবু ভাঙছে৷ আইনত আত্মহত্যার চেষ্টা এখন আর অপরাধ নয়৷ পুলিশকে সহযোগিতা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ এগুলি ভালো দিক৷ কিন্তু সমাজের সব স্তরে কি সেই ট্যাবু ভেঙেছে৷ অনুত্তমা, মোহিত দুইজনেই মনে করেন-- ভাঙেনি৷ আত্মহত্যার চেষ্টা করেও বিফল হওয়া কোনো ব্যক্তি যখন হাসপাতালে ভর্তি হন, চোখ খুলেই তিনি প্রথম দেখেন চিকিৎসক এবং নার্সকে৷ অনেক সময়েই দেখা যায়, তারা কিছু না জেনেবুঝে ওই ব্যক্তিকে জ্ঞান দিতে শুরু করেন৷ একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করা ব্যক্তির কাছে ওই জ্ঞান ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে৷ একই কথা প্রযোজ্য পুলিশের ক্ষেত্রে৷ পুলিশও জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করে৷ ফলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে যারা কাজ করছেন, তাদেরকেও সচেতন হতে হবে, শিক্ষিত হতে হবে৷ ভারতে এটা এখনো একটি বড় সমস্যা৷

আত্মহত্যার সংজ্ঞা নিয়ে আসলে গোটা পৃথিবীতেই এখন নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে৷ ভারতেও তা নিয়ে বিস্তর যুক্তিতক্কো চলছে৷ খোঁজার চেষ্টা চলছে আত্মহত্যার পিছনে রয়ে যাওয়া সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি৷ এসব চলবে৷ নিশ্চয় চলবে৷ কিন্তু গোড়া কথা আগে৷ আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি সাহায্যের ফোন করলে যেন একবারে যোগাযোগ করতে পারেন৷ অন্তত একটা প্রাণ তো বাঁচানো যাবে!