1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ঝুঁকি

৩ মে ২০১৮

নানা নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা৷ প্রশাসন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন৷ আরও আছে মামলার ভয়৷ সবসময় পাশে থাকে না প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো৷

https://p.dw.com/p/2x4la
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার প্রতিবাদে এভাবেই সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানিয়েছেনছবি: Badruddoza Babu

গত মার্চের ঘটনা৷ স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বরিশালের পুরাতন বিউটি হলের সামনে ডিবি পুলিশের এক অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন স্থানীয় সাংবাদিক সুমন হাসান৷ অভিযানের বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বাকবিতণ্ডা হয়৷ এক পর্যায়ে পুলিশ তাঁকে নির্যাতন করা শুরু করে৷ তাঁকে বেধড়ক মারধর ও অণ্ডকোষ চেপে ধরা হয়৷ তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন৷ পরে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে জ্ঞান ফেরার পর আবারো নির্যাতন করা হয়৷ পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেন৷

সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল ছবি তোলার সময় গুলি খেয়ে মারা যান৷ কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন যে, তাঁকে ইচ্ছে করেই গুলি করা হয়েছিল, যদিও বিষয়টি পুরোপুরি প্রমাণিত হয়নি৷

মফস্বলের সাংবাদিকদের ওপর পুলিশ ও প্রশাসনের কোনো কোনো সদস্যের নির্যাতনের অভিযোগ প্রায় ওঠে৷ শুধু তাই নয়, স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও আক্রোশের শিকার হন অনেকে৷

মফস্বলের সাংবাদিকতা

এই আক্রোশের চিত্র কতটা বদলেছে, তা জানতে ডয়চে ভেলে যোগাযোগ করে প্রথম আলোর সাংবাদিক টিপু সুলতানের সঙ্গে৷ পেশাগত দায়িত্ব পালন করার ‘অপরাধে' ২০০১ সালের ২৫ জানুয়ারি ফেনীতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীর নেতৃত্বে তাঁর ব্যক্তিগত সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা টিপু সুলতানকে নির্মমভাবে পেটায়৷ হাত-পা গুঁড়িয়ে দেয়৷ এত বছর পর এখনো তাঁকে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা নিতে হয়৷ ‘‘অবস্থা খুব একটা পাল্টায়নি,'' টেলিফোনে বলছিলেন টিপু৷ ‘‘একটা সময় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে চরমপন্থিদের ব্যাপক উৎপাত ছিল৷ তাদের হামলায় মারাও গেছেন কোনো কোনো সাংবাদিক৷ আহত হয়েছেন অনেকে৷ সে ধরনের পরিস্থিতি এখন আর নেই৷ কিন্তু সাংবাদিকদের ওপর চাপ অব্যাহত আছে,'' জানান টিপু সুলতান৷

‘যারা প্রকৃতই সাংবাদিকতা করতে চান তাঁদের ওপর অনেক চাপ’

তিনি মনে করেন, মফস্বলের সাংবাদিকতা এখনো কঠিন৷ ‘‘মফস্বলে দু'ধরনের সাংবাদিক আছেন৷ এর মধ্যে যারা প্রকৃতই সাংবাদিকতা করতে চান তাঁদের ওপর সব রকমের চাপ রয়েছে৷''

টিপু সুলতান বলেন, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রশাসনের যারা অন্যায় বা দুর্নীতির সঙ্গে যু্ক্ত সবার আক্রোশের শিকার হন মফস্বলের সাংবাদিকরা৷ ‘‘এখন সাংবাদিক হত্যা বা শারীরিক নির্যাতনের সংখ্যা হয়তো কমেছে, কিন্তু মিথ্যা মামলা দেয়ার ঝুঁকি রয়েই গেছে৷ এছাড়া ৫৭ ধারা তো তাদের জন্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র,'' মন্তব্য টিপুর৷

৫৭ ধারার খড়গ

গেল কয়েক বছরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় সাংবাদিক হয়রানির ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো৷ ২০১৫ সালে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখালেখির কারণে সিনিয়র সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করা হয়৷ পরে অবশ্য মামলা তুলে নেয়া হয়৷ গত বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে ২৩ জন সাংবাদিক ৫৭ ধারার মামলার শিকার হয়েছেন৷

গত বছর ৩ জুলাই ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার পর যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার নাজমুল হোসেনসহ চারজনের বিরুদ্ধে দিনাজপুরে এই ধারায় মামলা হয়৷ ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাবার সময় একজন বিচারক যাত্রাপথে যে সুবিধা পাচ্ছেন এবং অন্য সাধারণ মানুষ যেভাবে যাচ্ছে, সে বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন নাজমুল তাঁর স্ট্যাটাসে৷ তাতেই সংক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়৷

‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এসব আইনের অপব্যবহার হয়’

ডয়চে ভেলের সঙ্গে বুধবার আলাপকালে নাজমুল জানান, এখন তিনি দিনাজপুরে অবস্থান করছেন৷ কারণ, মামলা তুলে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে৷ ‘‘বাদী বলছেন যে, তিনি তখন সংক্ষুব্ধ ছিলেন৷ এখন আর নন৷ তাই মামলা তুলে নিচ্ছেন,'' বলছিলেন নাজমুল৷ ‘‘আসলে মামলার পর অনেক সাংবাদিকসহ দু'একজন মন্ত্রী আমার পাশে দাঁড়ান৷ তাই এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে,'' মনে করেন তিনি৷

তবে নাজমুল মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই ধারাসহ ব্রিটিশ আমলের বেশ কিছু আইন এবং পাস হবার অপেক্ষায় থাকা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কয়েকটি ধারা অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে৷ ‘‘অনেকেই এগুলোর অপব্যবহার করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেন, যেটি খুবই উদ্বেগের বিষয়,'' বলেন তিনি৷

ব্যক্তিগত আক্রোশের জায়গা থেকে অনেকেই এমন করতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন নাজমুল৷ তবে তিনি স্বীকার করেন, অনেকের ক্ষেত্রে হয়রানির মাত্রা অনেক বেশি হয়৷

কার পাশে কে দাঁড়াবে

একাত্তর টিভির সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনও মনে করেন, নির্যাতিত সব সাংবাদিক সমান মনোযোগ পান না৷ এই বিভাজন মানতে পারেন না তিনি৷ ‘‘প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলো কার পাশে দাঁড়াবে সে বিষয়টি অনেক সিলেক্টিভ৷ সাংবাদিক হিসেবেই যে পাশে দাঁড়াবে তা হয় না,'' ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন নাদিয়া৷

২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ‘নারী' বলে হামলার শিকার হন তিনি৷

নাদিয়ার মতে, সমাজে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা আছে, যার কারণে মানুষ পক্ষে, বিপক্ষের বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না৷ ‘‘পক্ষে, বিপক্ষের বাইরেও যে বস্তুনিষ্ঠতা বলে একটি বিষয় আছে, তা যেন সমাজ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে৷ সংবাদ বিপক্ষে গেলে সেটা মেনে নেয়ার মানসিকতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে৷ এমন চলতে থাকাটা সমাজের জন্য ভয়ংকর৷''

‘পক্ষে, বিপক্ষের বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না’

২০১৩ সালের ঘটনার পর তাঁর পেশাগত কাজের ধারায় তেমন কোনো পরিবর্তন না এলেও তিনি মনে করেন, এখন ‘ঝুঁকির' বিষয়টি মাথায় নিয়েই কাজ করতে হয়৷ ‘‘আতঙ্ক কাজ না করলেও একটু এগিয়ে গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করছি৷''

নাদিয়া মনে করেন, শুধুমাত্র সাংবাদিকদের একক প্রচেষ্টা ও আগ্রহের কারণে সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা এখনো বজায় আছে৷ মালিকপক্ষ কিংবা রাষ্ট্রের নানা যন্ত্রের চাপ নিয়ে তাঁরা নিজেদের আগ্রহে কাজ করে যাচ্ছেন৷

সেল্ফ সেন্সরশিপ

একটু এগিয়ে গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে নাদিয়ার ‘সাবধানতা সাংবাদিকতা' সর্বত্রই বিরাজ করছে বলে মনে করেন টিপু সুলতান৷ তিনি বলেন যে, প্রভাবশালী মহলের চাপে পড়ে অনেক সময় সাংবাদিকরাই সেল্ফ সেন্সরশিপ অবলম্বন করেন৷ ‘‘আমি এমন অনেক ঘটনাই জানি যে, মফস্বলের অনেক সাংবাদিক ভয়ে কিংবা বিপদে না পড়ার জন্য অনেক সংবাদ করতে পারেন না৷ শুধু মফস্বলে কেন, এটা ঢাকাতেও হয়৷ প্রতিটি গণমাধ্যমেই কমবেশি হয়৷ এমনকি মফস্বলের সাংবাদিক হয়তো পাঠালেন, কিন্তু নানা কারণে হয়তো তা ছাপানোই হয় না,'' বলছিলেন টিপু৷

‘‘বাংলাদেশের দু'টি স্বনামধন্য পত্রিকার বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া হলো৷ দেশীয় কোনো গণমাধ্যম তা নিয়ে সেভাবে রিপোর্ট করেছে? মানুষ তা জানতে পারছে বিদেশি সংবাদমাধ্যম থেকে,'' মন্তব্য তাঁর৷

তিনি মনে করেন, সার্বিকভাবে সাংবাদিকতার পরিস্থিতি উন্নয়নে সাংবাদিক নেতারাও ভূমিকা রাখতে পারছেন না৷

সাংবাদিকদের দলাদলি

অন্যান্য পেশার মতো রাজনৈতিক কারণে সাংবাদিকরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন এই তিন সাংবাদিক৷ ‘‘সাংবাদিকদের এই দ্বিধাবিভক্তির কারণে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের চাপ আগে যতটা ছিল, এখন তার থেকে বেশি হবার সুযোগ তৈরি হয়েছে,'' বলে মনে করেন টিপু সুলতান৷ ‘‘মূলত রাজনৈতিক কারণেই এটি হচ্ছে৷ কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিগত সুবিধাও নিয়েছেন৷ কেউ কেউ প্রতিবাদ করেন৷ কিন্তু খুব ক্ষীণ কণ্ঠে৷''

এই পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে শঙ্কা তাঁর৷ নাদিয়াও মনে করেন, সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠনগুলো সাংবাদিকদের কল্যাণে ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না৷ ‘‘নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে আমরা কাজ করছি৷ শারীরিক নিরাপত্তার অভাব তো আছেই, প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি দেয়া হয় না, চাকরির নিরাপত্তার অভাব, এসবের মধ্য দিয়েই নানান বাধা উপেক্ষা করে আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়,'' বলেন নাদিয়া শারমিন৷

বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কতটা মুক্ত ও স্বাধীন? মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷