1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাপ্রেমী বিদেশিরা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা আছে অনেক বিদেশির৷ তাদের কেউ কেউ ভাষার টানেই স্থায়ী হয়েছেন বাংলাদেশে৷ ভালোবেসে ফেলেছেন এখানকার সংস্কৃতি আর জল-হাওয়া৷ বাংলার জন্য আছে তাদের গভীর ভাবনাও৷

https://p.dw.com/p/3Y6mE
ছবি: Sazzad Hossain

একজন লুসিওর গল্প

‘‘কষ্ট পাই এই দেশের বাংলাভাষীরা যখন বাংলা বলতে গিয়ে তার মধ্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন৷ অনেকে রেগে গেলেও ইংরেজি বলেন৷ তারা মনে করেন ইংরেজি বললে গুরুত্ব বাড়ে৷ আমার কষ্ট হয়, যে দেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখে৷’’

কথাগুলো কোন বাংলাদেশি নন, বললেন একজন বিদেশি৷ নিজেও তিনি পরিস্কার বাংলাতেই কথা বলেন৷ আলাদা করে বোঝার উপায় নেই যে তিনি ইটালির নাগরিক৷ বোঝা যাবেই বা কী করে! এই দেশের ভাষা, সংস্কৃতিকে যে তিনি নিজের প্রাণেই ধারণ করেছেন! বলছি লুসিও বেনানিতির কথা৷ তার বয়স এখন ৬৪ বছর৷

কুড়ি বছর আগে এসেছেন বাংলাদেশে৷ এরপর থেকে ঢাকার বস্তি আর পথশিশুদের নিয়েই আছেন৷ তাদের শিক্ষা, খেলাধুলা, খাবারের ব্যবস্থা করেন নিজস্ব উদ্যোগে৷

কষ্ট পাই এই দেশের বাংলাভাষীরা যখন বাংলা বলতে গিয়ে তার মধ্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন: লুসিও

তিনি ভাষাকে দেখেন ভালোবাসার একটি মাধ্যম হিসেবে৷ ভালোবেসে ফেলেছেন বাংলাকেও৷ তাই প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করেন না৷ বাংলাতেই কথা বলেন, লিখেন৷ এমনকি গাইতেও পারেন৷

তিনি বলেন, ‘‘গান আছে তো ‘আমি কি ভুলিতে পারি’৷ এই গানে যা বলা হয়েছে তা-ই করতে হবে৷ দেশকে ভালোবাসতে হবে৷’’

কিভাবে শিখলেন বাংলা ভাষা? তার জবাব, ‘‘এটা আমি নিজেই চর্চা করে শিখেছি৷ কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নয়৷ শুরুতে এখানকার বন্ধুদের সহায়তা নিয়ে বর্ণমালা শিখেছি৷ তারপর আমি চর্চা করেছি৷ এটা আমাকে শিখতে হয়েছে৷ কারণ, যাদের আমি ভালোবাসি, তাদের ভাষা বাংলা৷ এই ভাষা না জানলে আমি ভালোবাসা প্রকাশ করবো কিভাবে?’’

তার মতে স্কুলে গিয়ে ভাষা শেখা যায়, কিন্তু চর্চাই প্রধান৷ তারপরও বাংলা সম্পর্কে তার কৌতুহল আর জানার আগ্রহের শেষ নেই৷ ‘‘আমি বইপত্র পড়ি৷ চর্চা করি৷ তারপরও আমি বলতে পারি না যে, আমি বাংলা ভাষা পুরোপুরি শিখতে পেরেছি,’’ বললনে লুসিও৷

লালন প্রেমে বাংলা প্রেম
লালনের গান ভালোবেসে ২০১৬ সালে এই দেশে এসেছেন ফ্রান্সের দেবোরা এলিয়েট৷ নিয়েছেন নতুন নাম, দেবোরা জান্নাত৷ বিয়ে করেছেন বাংলাদেশেরই এক বাউল সাধককে৷ নাম ফকির রাজন শাহ৷ নিজেও হয়েছেন বাউল৷

লালনের গান বুঝতে হলে আমাকে তো বাংলা শিখতেই হবে: দেবোরা জান্নাত

কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়াতে থাকেন তিনি৷ সেখানেই কাটাতে চান বাকি জীবন৷

লালনের গানের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায় ফ্রান্সে থাকতেই৷ সেখানে থেকেই তিনি বাংলা ভাষা শেখার চেষ্টা করেছেন৷ এই দেশে এসে রপ্ত করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে বর্ণমালা মুখস্থ করি৷ আমার দেশে একজনের সহায়তা নেই৷ এখন বাংলাদেশে থেকে চর্চার মাধ্যমে শিখছি৷ লালন সাঁইর গানের ভাষা কিন্তু অত সহজ না৷ বাংলাদেশের অনেক মানুষও তা বুঝতে পারে না৷ আমি সেই ভাষাও এখন বুঝি৷ আর আমি কুষ্টিয়ায় থাকি, কারণ, এখানকার বাংলা শুদ্ধ বাংলা৷ লালনের গান বুঝতে হলে আমাকে তো বাংলা শিখতেই হবে৷’’

বাংলাকে ‘মধুর ভাষা’ মনে করেন তিনি৷ তার মতে, এদেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে৷ ভাষা টিকিয়ে রাখতে এই লড়াইটা অব্যাহত রাখতে হবে৷ নয়তো বিশ্বায়নের এই  যুগে বাংলা কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে৷ তিনি বলেন, ‘‘ভাষা শিক্ষার মাধ্যম৷ এই দেশে গ্রামে ও শহরে শিক্ষায় পার্থক্য আছে৷ এটা দূর করতে হবে৷’’

বিদেশিদের বাংলা শেখার আগ্রহ বাড়ছে
মানবতার সেবা, গবেষণা বা সাহিত্য বা এদেশের গানের প্রেমে পড়ে বাংলা ভাষা শিখছেন এমন আরো অনেক গল্প আছে৷ তাদের অধিকাংশই বাংলা শিখেছেন নিজস্ব উদ্যোগে৷ তবে এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও বাংলা শেখার সুযোগ রয়েছে৷ এরকম একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ‘লার্ন বাংলা’৷ বেশ কয়েক বছর ধরে তারা বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখাচ্ছে৷

প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, তারা চার মাসের ‘ফাউন্ডেশন কোর্স’ পরিচালনা করেন৷ আছে ‘অ্যাডভান্স কোর্সও’৷ চার মাসের কোর্স করলেই বিদেশিরা কাজ চালানোর মতো বাংলা বলতে ও লিখতে পারেন বলে জানান তিনি৷ তাদের প্রতিটি কোর্সে কমপক্ষে ৩০ জন বিদেশি বাংলা শেখেন৷

লার্ন বাংলার তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৫০টি দেশের বিদেশিরা এই প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা শিখেছেন৷ তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার নাগরিকই বেশি৷ তবে আজকাল ভারতীয় নাগরিকরা বেশি আসছেন বাংলা শিখতে৷

সেই কর্মকর্তা আরো জানান, ‘‘বিদেশিরা যারা এখানে বাংলার চর্চা করেন তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথেও একাত্ম হয়ে যান৷ একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে যান৷ দল বেধে পহেলা বৈশাখে শাড়ি পরেন৷’’