1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাসচালক জামিরের মৃত্যুতে আমাদের দায়

৩ আগস্ট ২০২০

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যু অত্যন্ত হৃদয়বিদারক একটি ঘটনা৷ ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনার পরপরই এর কারণ গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে শুরু করি৷

https://p.dw.com/p/3gKUp
Bangladesh  | Professor Shamsul Hoques Präsentation über Tareque Masud, Mishuk Munir Unfall
ছবি: Md. Shamsul Hoque

অনুসন্ধানের একদম শুরুতে আমাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছিলেন কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক৷

সাংবাদিকেরা এ ধরনের যে কোনো ঘটনায় দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান৷ তারা পেশাগত প্রয়োজনে দুর্ঘটনাস্থলের ছবি দেখান, বিধ্বস্ত গাড়ি বা রক্তাক্ত দেহ দেখান৷ এই পেশাগত কাজের বাইরেও কয়েকজন সাংবাদিক প্রথম দিনে ঘটনাস্থলের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি আমাকে পাঠিয়েছিলেন৷ কিছু ছবি তোলা হয়েছিল উঁচু গাছ থেকে৷ যেগুলো আমার কাছে ছিল সারকমসটেন্সিয়াল এভিডেন্সের মতো৷ সেসব ছবি দেখে আমি বুঝেছিলাম, এখানে অনেক কিছু বলার মতো বিষয় লুকিয়ে আছে৷

পরের দিন আমি নিজেই দুর্ঘটনাস্থলে যাই৷ এর আগে সাংবাদিকদের কাছ থেকে আরো বেশ কিছু কন্টেন্ট পেয়েছিলাম৷ এর মধ্যে একটি ভিডিও ছিল, যেখানে বাসের উইন্ডশিল্ডের কাছে বসা একজন নারীর কথা ছিল৷ তার সাবলীল বিবরণ থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, দুর্ঘটনাস্থল থেকে অনেক নতুন কিছু পাওয়ার আছে৷ একে একে বিভিন্ন বিষয় যখন আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল, সেই সঙ্গে সাধারণ বিবরণের মধ্যে গোজামিলগুলোও ধরা পড়ছিল৷ তখনো আমি দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটি ভালোভাবে দেখতে পারিনি৷ ওটা একদম চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল৷ মাইক্রোবাসে কে কার পাশে বসেছিলেন সেটা তখনও আমি জানতাম না৷

অনুসন্ধানের পাশাপাশি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের অপেক্ষা করছিলাম৷ ৩ সদস্যের এই কমিটির সঙ্গে আমার একজন সাবেক ছাত্রও যুক্ত ছিলেন, তিনি আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন৷ একই সঙ্গে আমার কাছে যেসব তথ্য-প্রমাণ ছিল সেগুলো একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করছিলাম৷ তবে এর মধ্যে খণ্ড খণ্ড বেশ কিছু মিসিং ছিল৷ এর মধ্যেই ডেইলি স্টারে তারেক মাসুদের সহকারী মনীশ রফিকের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়৷ মনীশ ছিলেন মাইক্রোবাস চালকের ঠিক পাশের আসনে, দুর্ঘটনায় তিনিও সামান্য আহত হন৷ মনীশের বক্তব্য থেকে এমন কিছু বিষয় পাই, যেটি আমার প্রাথমিক অনুসন্ধানকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে সাহায্য করে৷

শেষের দিকে আমার সামনে একটি ধাঁধা মেলানো বাকি ছিল৷ যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগে গাড়ির হার্ড ব্রেক কষার কথা৷ হার্ড ব্রেক অ্যাপ্লাই করলে রাস্তায় একটি স্পিড মার্ক পাওয়া যায়৷ আর সেই স্পিড মার্ক পেলে গাড়ির আসল অবস্থান চিহ্নিত করা যায়৷ অথচ আমি রাস্তায় কোনো স্পিড মার্ক পাইনি৷ আমরা যারা দুর্ঘটনা বিষয়ে কাজ করি, তাদের কাছে বিষয়টি গোলমেলে৷ আমি তখন ভাবার চেষ্টা করছিলাম, বৃষ্টির কারণেই রাস্তায় হয়ত স্পিড মার্ক নেই৷ তবে সেটা মিলছিল না৷ স্পিড মার্ক এমন একটি বিষয় যার কোনো না কোনো চিহ্ন থাকবেই৷ এর মূল কারণ, চাকার প্রচণ্ড ঘর্ষণে রাস্তার পাথর কুঁচি উঠে যায়৷

তাহলে কেন এ ধরনের চিহ্ন নেই- সেটি নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম৷ অবশেষে সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল মনীশ রফিকের সাক্ষাৎকারে৷ তিনি বলেছিলেন, সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল৷ মাইক্রোবাসের পেছন দিকে যাত্রীরা মুখোমুখি বসে তুমুল আড্ডায় মেতেছিলেন৷ তার কথার প্রতিটি বিষয় আমার সামনে একেকটি চিত্র তৈরি করছিল৷ মাইক্রোবাসে মুখোমুখি কী করে বসা যায়! তার মানে সেটির আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছিল৷ মনীশ আরো বললেন, হঠাৎ একটি বাস দৈত্যের মতো তাদের মাইক্রোবাসে আঘাত করে৷

Bangladesh Shamsul Hoque
অধ্যাপক ড. শামসুল হক, সাবেক পরিচালক, দুর্ঘটনা রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েটছবি: Privat

‘হঠাৎ'! আরে হঠাৎ হলেই তো গাড়ির স্পিড মার্ক পাওয়া যায় না৷ কিছু দূর আগে থেকে দেখতে পেলেও হার্ড ব্রেক কষা সম্ভব৷ কিন্তু কী এমন পরিস্থিতি সেখানে তৈরি হয়েছিল যে কারণে বাসটিকে তারা হঠাৎ দেখতে পেলেন!

আমি আবার দুর্ঘটনাস্থলে গেলাম৷ স্থানীয় একজনের বক্তব্য পেলাম৷ প্রথম আলোতেও কয়েকজনের বক্তব্য ছাপা হয়েছিল৷ সব মিলিয়ে পরিষ্কার হলো, ওখানে একটি বড় বাস রাস্তার বাঁকের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটোরিক্সাকে ওভারটেক করছিল৷ ওভারটেক করা বাসটির চালক কিন্তু বাঁকের অন্য প্রান্তে বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটিকে দেখতে পেয়েছিলেন৷ কিন্তু এরপরেও তিনি ক্যালকুলেটেড ঝুঁকি নিয়ে অটোরিক্সাকে ওভারটেক করে আবার নির্ধারিত বাম লেনে নিজের বাসটিকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন৷ মহাসড়কে চলাচলকারী বাস-ট্রাক সাধারণত এ ধরনের হিসেবি ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত৷

অটোরিক্সাকে ওভারটেক করা বাসটির পেছনেই ছিল তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাসটি৷ সামনের বাসটিকে অনুসরণ করে সেটিও অটোরিক্সাকে ওভারটেক করতে ডান লেনে চলে যায়৷ তবে একজন শহুরে চালকের জন্য কাজটি ছিল মারাত্মক ভুল৷ সামনের বাসের মতো তিনি মাইক্রোবাসকে ফের বাম লেনে নিতে পারেননি৷ বরং এই ভুলের কারণেই বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটির সঙ্গে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়৷ উল্টোদিকে আকস্মিক এ ঘটনার জন্য চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাস চালক জামির হোসেনের কোনো প্রস্তুতি ছিল না৷ কারণ, বাঁকের উল্টো দিক থেকে তিনি মাইক্রোবাসটিকে দেখতেই পারেননি৷ আর এজন্যই সেই ‘হঠাৎ' দুর্ঘটনা, যেখানে বাস চালক ব্রেক কষারও সময় পাননি৷

সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে আমি দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটির ‘টার্মিনাল পজিশন'-এর বেশ কিছু ছবি পেয়েছিলাম৷ একটি দুর্ঘটনাকে বিশ্লেষণের জন্য ‘টার্মিনাল পজিশন' খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এটা হলো দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটির চূড়ান্ত অবস্থান৷ দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটির অবস্থান ছিল রাস্তার মাঝ বরাবর৷ মামলার রায়ে বিচারক যেটিকে বলেছেন, অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে মাইক্রোবাসটি তার সঠিক লেইনেই ছিল৷ চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটি রং সাইডে এসে মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা মেরে রাস্তার পাশে চলে যায়৷

এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হল, একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষের পর কোনো মাইক্রোবাস যদি তার ‘সঠিক' লেইনে থাকে (যদিও সেই অবস্থানটিও ছিল রাস্তার মাঝ বরাবর), তাহলে ধরে নিতে হবে দুর্ঘটনার আগের চিত্র ছিল অন্যরকম৷ কারণ, একটি বাসের যে ভর ও গতি তাতে সংঘর্ষের পর মূল অবস্থান থেকে মাইক্রোবাসটির বেশ কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার কথা৷ মাইক্রোবাসের জীবিত আরোহীদের বক্তব্যেও সেটি জানা গেছে৷ ফলে দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটিকে রাস্তার মাঝ বরাবর পাওয়ার অর্থ হলো, প্রকৃতপক্ষে সেটি রং সাইডে ছিল, ধাক্কা খাওয়ার পর এর টার্মিনাল পজিশনটি পাওয়া যায় মধ্য রাস্তায়৷ আর দুর্ঘটনার আগে মাইক্রোবাসটি সত্যিই বাম লেইনে থাকলে, ধাক্কা খাওয়ার পর সেটির রাস্তার কিনারায় বা রাস্তার পাশে চলে যাওয়ার কথা ছিল৷ এটাই হলো বিজ্ঞান৷ অথচ বিচার প্রক্রিয়ায় এই বিজ্ঞানকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি৷

যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানকার রাস্তার বাঁকও ছিল অবৈজ্ঞানিক৷ ১১ ফুট প্রশস্ত ওই রাস্তায় কোনো বাঁক থাকলে রাস্তার বক্রতার ধরন অনুসারে অংশটি অন্তত ১৩ ফুট চওড়া হওয়ার কথা ছিল৷ বাস্তবে যা ছিল না৷ একইসঙ্গে বাঁকটিতে গাছপালা থাকায় দৃষ্টিসীমা ছিল একদম কম৷ ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যেসব ব্ল্যাকস্পট ছিল, এই বাঁকটি তার একটি৷ মানিকগঞ্জের জোকায় তখন প্রতি বছর তিনটির বেশি করে দুর্ঘটনা ঘটছিল৷ এখন সেখানে ডিভাইডার করা হয়েছে, রাস্তা চওড়া হয়েছে, ফলে এখন আর সেখানে দুর্ঘটনা হচ্ছে না৷ দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসের অবস্থা দেখে পরিষ্কার বোঝা গেছে, বাসের সঙ্গে এর মুখোমুখি নয়, বরং আংশিক মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল৷ ডিভাইডারবিহীন একটি সড়কে এ ধরনের আংশিক মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে হলে দুটি যানের যে কোনো একটিকে রং সাইডে থাকতে হয়৷ এ ক্ষেত্রে মাইক্রোবাস ও বাসের অবস্থান ও সংঘর্ষে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় মাইক্রোবাসটিই ওভারটেক করতে গিয়ে রং সাইডে ছিল৷ দুর্ঘটনার পর সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি ও মানিকগঞ্জ জেলা পুলিমের প্রতিবেদনেও বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে৷ তবে মামলার বিচারের ক্ষেত্রে সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়নি৷     

Bangladesh  | Professor Shamsul Hoques Präsentation über Tareque Masud, Mishuk Munir Unfall
মাইক্রোবাসটিই ওভারটেক করতে গিয়ে রং সাইডে ছিল৷ছবি: Md. Shamsul Hoque

দুর্ঘটনার পরিস্থিতি পুনর্নির্মাণের পর আমি প্রেজেন্টশনটি কিছু সাংবাদিককে দিয়েছিলাম৷ তবে সেটি কোথাও প্রকাশিত হয়নি৷ অন্যদিকে, বাস চালক জামির হোসেনের বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জের আদালতে মামলার বিচারও শুরু হয়ে গিয়েছিল৷ এরই মধ্যে একদিন ব্র্যাকে একটি সেমিনারে আমি অনুসন্ধানটি সবার সামনে উপস্থাপন করলাম৷ সেখানে ক্যাথরিন মাসুদের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেনও ছিলেন৷ অনুষ্ঠান শেষে সারা হোসেন বললেন, আমি যে বিষয়টি বের করেছি সেটির সঙ্গে তাদের ভিন্ন মত নেই, তবে তাদের ফাইন্ডিংস আলাদা৷ আমি তখন তাকে বলিছিলাম, আপনার এবং  আমার পেশাগত দূরত্ব বিশাল৷ আপনি আপনার জায়গা থেকে কখনোই বাস চালকের বাইরে যেতে পারবেন না, কিন্তু আমার বিশ্লেষণের পরিসর আরো বিস্তৃত৷ এরপর সারা হোসেনের টিম আমার কাছে এসেছিল, আমাকে সাক্ষ্য দিতে মানিকগঞ্জের আদালতে যেতে বলা হয়েছিল৷ তবে আমি তখন বলেছিলাম, একজন শিক্ষক হিসেবে দিনের পর দিন আমার পক্ষে মানিকগঞ্জে গিয়ে সাক্ষ্য দেয়া সম্ভব নয়৷ তাছাড়া, আমি তখন ভেবেছিলাম, আদালত নিশ্চয়ই দুর্ঘটনার সব দিক চুলচেড়া বিচার বিশ্লেষণ করেই রায় দেবে৷

তবে ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার পর হতভম্ব হয়ে গেলাম৷ একজন আমাকে রায়ের কপি এনে দিলেন, সেটি পড়ে বিস্ময় ও হতাশা তৈরি হল৷ একটি সড়ক দুর্ঘটনার বিচার ও সাধারণ বিচারের মধ্যে যে মাত্রাগত পার্থক্য থাকার প্রয়োজন, সেটি রায়ে দেখতে পাইনি৷ মনের মধ্যে ছটফট অবস্থা তৈরি হলো৷ পুরো বিষয়টি আবার নতুন করে কীভাবে সবার সামনে আনা যায় সেই চেষ্টা শুরু করলাম৷ মিডিয়াতে বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই একটি রক্ষণশীলতা দেখা যাচ্ছিল, ফলে সেখানকার অনেকেই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে চাইলেন না৷ কেউ কেউ এমনও বললেন, আমি বাস চালকের পক্ষে কাজ করছি৷ আমি বারবারই বলেছি, আমি সব সময়ে বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করি৷ এখানে বিজ্ঞান কথা বলছে, আমি নিজে কিছু বলছি না৷ এটা কার পক্ষে যাচ্ছে, বা বিপক্ষে যাচ্ছে- সেটা কোনো বিষয় নয়৷

যাই হোক, এরপর বাধ্য হয়ে অনেক চ্যানেল ঘুরে অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলাম৷ এটা গত বছরের গোড়ার দিকের কথা৷ সময়টি আমার জন্য কঠিন ছিল৷ কারণ, একজন শিক্ষক কোনো একজন বাস চালকের পক্ষে কথা বলছে- সেটা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার সামর্থ্য আমাদের এই সমাজের বেশিরভাগেরই নেই৷ কিন্তু আমার শুধু মনে হচ্ছিল, একটি অন্যায় হয়ে যাচ্ছে৷ সেটা জেনেও চুপ করে থাকা আরো ঘোরতর অন্যায় হবে৷ এ কারণে আমি নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করেছিলাম৷

আইনমন্ত্রী অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি৷ আমি তার সামনে দেড় ঘণ্টার একটি প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলাম৷ ভূমিকা দেয়ার পর তাকে চারটি বা পাঁচটি দিক থেকে ভুল দেখাচ্ছিলাম৷ হিসাব কষে মন্ত্রীকে দেখিয়েছিলাম, জামিরের বাস বেপরোয়া গতিতে চলছিল বলা হলেও বাস্তবে এর গতি ছিল নিয়ন্ত্রিত সীমার মধ্যেই৷ আইনমন্ত্রী প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়ার সমস্যাটি ধরে ফেললেন৷ উনি বললেন, সড়ক দুর্ঘটনার মতো বিষয়গুলোকে সাধারণ মামলার মতো করে বিচার করা তো মোটেই ঠিক হচ্ছে না৷ আমি উচ্চ আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলাম৷ তবে তখনই জানলাম, কোনো মামলা উচ্চ আদালতে যাওয়ার পর নতুন করে সাক্ষী যুক্ত করা যায় না৷ এটা করতে হলে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন পড়ে৷

সেদিনের আলোচনায় আমার আগ্রহকে বিবেচনায় নেয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলাম৷ তবে সাক্ষী হিসেবে পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত এখন কী পর্যায়ে আছে- জানি না৷ এরই মধ্যে গত ১ আগস্ট মারা গেলেন চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের চালক জামির হোসেন৷ ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন সাজা পাওয়ার পর থেকে তিনি কাশিমপুর কারাগারে বন্দি ছিলেন৷ জামির ও বাস মালিকের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের আরেকটি মামলার রায়ও দিয়েছে হাইকোর্ট৷ যে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে বিবাদি পক্ষ৷

জামির হোসেন যে মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান, সেটির বিচার চলেছে অন্য আর দশটি সাধারণ মামলার মতোই৷ তবে সড়ক দুর্ঘটনার বৈশিষ্ট্য নানান কারণেই আর সব ঘটনা থেকে আলাদা৷ একটি হত্যাকাণ্ডের বিচারে যেমন শুধু সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রায় দেয়া হয়, সেখানে সড়ক দুর্ঘটনার বিচারে সাক্ষীর বাইরেও পারিপার্শ্বিক আরো অনেক কিছু বিবেচনায় নেয়া দরকার৷ জামিরের মামলায় আদালত ‘সর্বোৎকৃষ্ট সাক্ষী' হিসেবে যাদের বিবেচনা করেছে, তারা সবাই মাইক্রোবাসের আরোহী৷ দুর্ঘটনার সময় তারা হয় উল্টো দিকে ঘুরে আড্ডা দিচ্ছিলেন, নয়ত ছিলেন একদম পেছনের সিটে৷ অথচ যিনি মাইক্রোবাস চালকের একদম পাশের সিটে ছিলেন, তার সাক্ষ্য নেয়া হয়নি৷ কোনো বাসযাত্রী বা স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীও নেই সাক্ষীর তালিকায়৷

যে কোনো অসুখের কারণ বের করা গেলে তাকে নির্মূল করা সহজ হয়৷ এটা বিজ্ঞানের একটি অসাধারণ গুণ৷ আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কেন হয়- তার একটি মাত্র উপসর্গের দিকেই আমরা সাধারণত নজর দিয়ে থাকি৷ সেটি হলো দুর্ঘটনার সব দায় কেবল গাড়ি চালকের৷ পেশাগত জায়গা থেকে আমি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে অনেকদিন ধরে কাজ করছি৷ এটি করতে গিয়ে দেখেছি, দুর্ঘটনার বাকি যেসব নিয়ামকগুলো আছে সেগুলো বেশিরভাগ সময়েই বিবেচনার বাইরে থেকে যায়৷ অথচ নিরাপদ সড়কের জন্য সমন্বিত একটি কার্যকর কৌশল প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট সবার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা দরকার৷ তা না হলে জামির হোসেনের মতো চালকেরা সোশাল ক্রসফায়ারে পড়তেই থাকবেন, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলো কখনো দূর হবে না৷        

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান