1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিজেপি এলো বঙ্গে

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা
২৪ মে ২০১৯

২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টি৷ মাত্র পাঁচ বছরের তফাতে সেই আসনসংখ্যা বেড়ে হলো ১৮!‌ এবার বিজেপির লক্ষ্য রাজ্য বিধানসভা৷

https://p.dw.com/p/3IznS
ছবি: DW/S. Bandopadhyay

শেষ দফার নির্বাচনি প্রচারে পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, রাজ্যের অন্তত ৪০ জন তৃণমূল বিধায়ক বিজেপিতে আসার জন্যে পা বাড়িয়ে আছেন৷ ভোট শেষ হওয়ার পরই সেটা বুঝতে পারবেন৷ এ কথার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ তখনো তিনি রাজ্যবাসীর কাছে আবেদন জানিয়ে যাচ্ছেন, এবারে বাংলার ৪২টা আসনের মধ্যে ৪২টাতেই তৃণমূল প্রার্থীদের জেতাতে৷ ‘‌বেয়াল্লিশে বেয়াল্লিশ’— এই ছিল মমতার ভোটের স্লোগান৷ সরাসরি বারণ করেছিলেন কংগ্রেস, বামফ্রন্ট বা বিজেপি-বিরোধী অন্য কোনো দলকে ভোট দিয়ে ভোট না নষ্ট করতে৷ কিন্তু ২৩ মে ভোটগণনা যত এগিয়েছে, ততই স্পষ্ট হয়েছে যে বাঙালি ভোটাররা কেউ তাঁদের ভোট নষ্ট করেননি৷ মমতার সরকারের গত ৮ বছরের তুঘলকি শাসনে বিরক্ত এবং বিক্ষুব্ধ মানুষ দলে দলে ভোট দিয়েছেন এই মুহূর্তে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপিকে৷ শক্তিহীন, অস্তিত্বহীন বামপন্থি, বা দুর্বল কংগ্রেস, কাউকে ভোট দিয়ে তাঁরা নিজেদের ভোট নষ্ট করেননি৷ ফলে দিনের শেষে গতবারের ৩৪টা আসনের চেয়েও এক ডজন আসন কম পেয়ে দৌড় শেষ করেছে তৃণমূল৷ কংগ্রেস পেয়েছে একটিমাত্র আসন, সে-ও সাংগঠনিক জোরে নয়, বরং বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে অধীররঞ্জন চৌধুরির একার ক্ষমতায়৷ আর একটি আসনও না পেয়ে স্রেফ ধুয়েমুছে গেছে বামফ্রন্ট৷

Indien Wahl 2019 | Westbengalen, Anhänger der Bharatiya Janata Party
ছবি: DW/S. Bandopadhyay

ভোটের শতাংশের হিসেবে যদিও দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের ভোট কিন্তু ধরে রাখতে সফল হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ কিন্তু ব্যাপক হারে ভোট কমেছে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের৷ ফলে ভোটের আগে যে সম্ভাবনার কথা শোনা গিয়েছিল যে, বাম ভোট এবার রাম ভোটে বদলে যাবে, কার্যত সেটাই হয়েছে৷ এবং তার জন্য বামপন্থিদেরই এখন দোষ দিচ্ছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা৷ যে বামপন্থি দলগুলোকে সাইনবোর্ডে পরিণত করার ডাক দিয়েছিলেন তাঁদের নেত্রী৷ যে বামপন্থিরা তৃণমূলের দাপটে এবং নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতায় শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে সব আসনে প্রার্থীই দিতে পারেনি৷ কিন্তু তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে গত আট বছরে স্বাভাবিক নিয়মেই জমে ওঠা ক্ষোভ তা হলে কোথায় যাবে?‌ সেই ভোট পেয়েছে বিজেপি, যে বাস্তবিকতার আঁচ তাদের নেতারা আগেই পেয়েছিলেন৷ এ কারণে ভোটের ফলাফলে গেরুয়া প্রবণতা নিশ্চিত হওয়ার পরই পশ্চিমবঙ্গে দলের দায়িত্বে থাকা বিজেপি নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয় নিরুত্তাপ মন্তব্য করেছেন, ‘‘‌মমতাজি লড়াই করেন৷ আর আমরা নির্বাচনকে খেলা হিসেবে দেখি৷ পশ্চিমবঙ্গেও আমরা খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়েই ভোটে নেমেছিলাম, কিন্তু উনি লড়াই করে গেছেন৷’’

পশ্চিমবাংলায় বিজেপির এই অভূতপূর্ব উত্থান খুবই খারাপ লক্ষণ এবং এর জন্য তৃণমূল কংগ্রেসকেই সম্পূর্ণত দায়ী করছেন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র৷ বর্ষীয়ান এবং অভিজ্ঞ এই রাজনীতিক নাম না করেই বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের একদা বন্ধুত্বের তীব্র সমালোচনা করেছেন৷ বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে দুর্বল করার জন্য যারা একসময় বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, আজ তাদেরই অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বসেছে৷ অন্যদিকে বিজেপির উত্থান মানে রাজ্যে আরো বেশি সাম্প্রদায়িক বিভাজন, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাও আরো বাড়বে, যা পশ্চিমবঙ্গের জন্যে আদৌ ভালো হবে না৷ নির্বাচনের আগে বামফ্রন্ট যে শেষপর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে যেতে রাজি হলো না, সেটা এই বিপর্যয়ের আরো এক কারণ বলে মনে করেন সোমেন মিত্র৷ তার জন্য তিনি দায়ী করছেন বামপন্থি নেতাদের হামবড়া ভাব এবং উন্নাসিকতাকেই৷

বামপন্থিরা এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি৷ রাজ্য রাজনীতিতে তাদের এই অস্তিত্বহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া নিয়ে এখনো বাম নেতারা চুপ৷ প্রথা মেনে উচ্চতর নেতৃত্ব এবং ভারপ্রাপ্ত কমিটির বৈঠক, আলোচনার পরই নিশ্চিত জানা যাবে, কেন এই বিপর্যয় হলো বলে তারা মনে করছে এবং ভবিষ্যৎ নিয়েই বা তারা কী ভাবছে৷ চুপ করে আছেন আরো একজন৷ তিনি মমতা ব্যানার্জি৷ গণনার দিন যখন বঙ্গে বিজেপির সুদূরপ্রসারী প্রভাবের ছবিটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে, মমতা টুইট করে বলেছিলেন, ‘‘‌বিজয়ীদের অভিনন্দন, কিন্তু যারা হেরেছে, তাদের সবার পরাজয় হয়নি৷ আমরা ফলাফলের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করব, তারপর নিজেদের মতামত জানাবো৷’’

আসলে তৃণমূল নেত্রী সম্ভবত খতিয়ে দেখবেন, তিন বছর আগেও যে বিপুল জনাদেশ পশ্চিমবঙ্গে তাঁর দল এবং সরকারের পক্ষে এসেছিল, এত দ্রুত তাতে ভাঙন ধরল কেন!‌ বিজেপির ভাগে রাজ্যের ১৮টি লোকসভা আসন, অর্থাৎ প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রের আওতায় ৭টি বিধানসভা আসনের হিসেবে মোট ১২৬টি বিধানসভা আসন৷ বিধানসভায় মোট আসনের সংখ্যা ২৯৪৷ যদি নরেন্দ্র মোদীর দাবিমতো তৃণমূল বিধায়করা দল ছেড়ে বিজেপিতে চলে যেতে থাকেন, তা হলে সরকার পড়ে যেতে কতক্ষণ!‌ বিজেপি নেতারা এর মধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, এবার তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়বেন৷ বিজেপি কর্মী–সমর্থকেরা রাস্তাঘাটে, হাটেবাজারে, সোশাল মিডিয়ায় সে-কথার পুনরাবৃত্তি করছে ঘন ঘন৷ বিজেপির দেশজোড়া নির্বাচনি সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারিগর যিনি, দলে নরেন্দ্র মোদীর পরেই যাঁর গুরুত্ব এবং ক্ষমতা, সেই অমিত শাহ ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে এসে বলে গেছেন, এবার লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সরকার৷ শুক্রবার বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ নির্বাচনের পর প্রথম আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলনটি করেন৷ সেখানে তিনিও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন, এরপর রাজ্য বিধানসভায় ‘‘‌যা হওয়ার তাই হতে যাচ্ছে৷’’‌
পশ্চিমবঙ্গে এবার বিজেপির এই বিপুল উত্থানের দায় বামপন্থিদের, কারণ, তাদের ভোটারদের তারা ধরে রাখতে পারেনি৷ বাম ভোটাররাই তৃণমূলকে ডোবাতে দলে দলে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে৷ তৃণমূল কংগ্রেসের উচ্চতম নেতৃত্ব থেকে সাধারণ সমর্থক এখন এই ষড়যন্ত্রের তত্ত্বেই বিশ্বাস রাখছেন এবং বামেদের দোষারোপ করছেন৷ শুক্রবার দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে, দলত্যাগী তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের ছেলে শুভ্রাংশুকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে গিয়ে দল–সভাপতি পার্থ চট্টোপাধ্যায় ফের সে-কথাই বলেছেন৷ বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষকে সেই প্রসঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলনে সরাসরি প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘‌নিজের পরাজয়ের জন্য অন্যকে দায়ী করাটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷ পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে৷ মানুষ যোগ্য বিরোধী শক্তি খুঁজছিলেন৷ তাঁরা যেদিন বিজেপির ওপর আস্থা রেখেছেন, বিজেপিকে বিশ্বাস করেছেন, ভোট দিয়েছেন, পরিবর্তন হয়েছে৷ যেরকম সিপিএমের বিরুদ্ধে যোগ্য বিকল্প হিসেবে মমতাকে লোকে বেছে নিয়েছিলেন, আজকে মমতার বিকল্প হিসেবে তাঁরা বিজেপিকে বেছে নিয়েছেন৷’’