1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিপন্ন প্রবাসী ভারতীয় শ্রমিক

গৌতম হোড়
১০ জুলাই ২০২০

বিদেশে চাকরি হারিয়ে অসহায়, দেশে ফিরেও শান্তি নেই৷কাজ ফিরে পাবেন কিনা সে বিষয়েও আছে সন্দেহ৷করোনাকালে প্রবাসী ভারতীয় শ্রমিকরা সব মিলিয়েই খুব বিপন্ন৷ 

https://p.dw.com/p/3f6Fx
Indien Wanderarbeiter verlassen Neu Delhi wegen der Corona Pandemie
ছবি: Reuters/A. Abidi

এক দুই-লাখ নয়, ১ কোটি ২৬ লাখ ভারতীয় বিদেশে গিয়ে কাজ করেন৷ এই সংখ্যাটা অনেক ছোট দেশের জনসংখ্যার থেকে বেশি৷ তার মধ্যে প্রায় ৯০ লাখ লোক কাজ করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ  ছয়টি উপসাগরীয় দেশে৷ করোনার ফলে তাঁদের একটা বড় অংশ কাজ হারিয়েছেন৷ তাঁরা দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল৷ এখন আর মাস গেলে মাইনে নেই৷ অথচ, প্রতিদিনের খরচ আছে৷ যতদিন কাজ ছিল, ততদিন তাঁদের সমাদরের শেষ ছিল না৷বিদেশে প্রচণ্ড পরিশ্রম করার পর মাস গেলে হাতে যখন অর্থ আসতো, তখন অনেক দুঃখ ভুলে যেতেন৷ কিন্তু কাজ হারানোর পর দেশে ফিরতেও তাঁদের কম হয়রানির মুখে পড়তে হয়নি৷ মাদ্রাজ হাইকোর্টে একটি মামলার সূত্রে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, এ পর্যন্ত মোট পাঁচ লাখ তিন হাজার ৯৯০ জনকে দেশে ফেরানো সম্ভব হয়েছে৷ এরপরও অপেক্ষার লাইনটা বিশাল৷  

করোনার গোড়া থেকেই সরকার অনেক ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তার মধ্যে প্রথম ভুল পদক্ষেপ হলো, চার ঘণ্টার নোটিশে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া৷ পরিযায়ী শ্রমিকরা দেশের অন্য রাজ্য থেকে ঘরে ফিরবেন, বিদেশে থাকা কর্মী ও ছাত্ররা দেশে ফিরবেন, সেই কথাটা মাথাতেই রাখা হয়নি৷ কেন রাখা হয়নি, সেই প্রশ্ন তুলে লাভ নেই, কারণ, এতদিন ধরে আমরা এটা জেনে গিয়েছি, ভারতে যখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার অনেক সময়ই অগ্রপশ্চাত ভাবা হয় না৷ প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা  ঠিকভাবে খতিয়ে দেখা হয় না৷ করোনাকালেও বারবার তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে৷ লকডাউন যখন হলো, তখন দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা মাত্র পাঁচশ৷ যখন তুলে দেওয়া হলো, তখন করোনার তাণ্ডব বাড়ছে৷ পশ্চিমের দেশে করোনা একেবারে ওপরে পৌঁছে যখন কমছে, তখন লকডাউন তোলা হয়৷ ভারতে হলো উল্টোটা৷

নোটবন্দি বা জিএসটি চালুর কাহিনি একই৷ সিদ্ধান্ত নিয়ে বারবার নিয়মে বদল করতে হয়েছে৷ আর তার ফল ভোগেন সাধারণ মানুষ৷ এ ক্ষেত্রেও সব চেয়ে বেশি ভুগেছেন দেশের ভিতরের পরিযায়ী শ্রমিক এবং বাইরে থাকা কর্মী, যাঁরা কাজও হারালেন,  আটকে পড়লেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে ভারতে লকডাউন শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ থেকে৷ আর বিদেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের আনার জন্য বিমান পাঠানো শুরু হয় ৭ মে থেকে৷ অর্থাৎ, দেড় মাস ধরে বিদেশে ভারতীয় কর্মীদের বড় অংশ প্রবল কষ্ট এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটিয়েছেন৷ আর এই যে পাঁচ লাখ কর্মীকে বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, তাঁরা তো একদিনে আসতে পারেননি৷ দুই মাস ধরে আনা হয়েছে৷ এখনো লাখ লাখ লোক অপেক্ষা করে আছেন, কবে তাঁরাও সুযোগ পাবেন দেশে ফেরার৷ দেশে ফেরার একমাত্র উপায় দূতাবাসের কাছে নাম লিখিয়ে রাখা৷ তারপর কবে এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ বিমানে জায়গা হবে তার অপেক্ষা করা৷ কারণ, বিদেশের সঙ্গে বিমান পরিষেবা শুরু হয়নি৷ শুধু এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ ফ্লাইট ভারতীয়দের নিয়ে ফিরছে৷ একটা বিমানে কতজন আর ফিরতে পারেন৷ ১৭০ থেকে ২২০ জন৷ ফলে বাকিরা কবে ফিরতে পারবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই৷  

বিদেশে যে ভারতীয়রা শারীরিক পরিশ্রমের চাকরি করেন, তাঁদের সংখ্যা বেশি৷ কাজ চলে যাওয়ায় তাঁরা বিপর্যয়ের মুখে পড়লেন৷ দেশে ফিরতে চেয়েও ফিরতে পারছেন না৷ ছটফট করছেন৷ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তামিলনাড়ু ফিরেছেন দুই শ্রমিক রাজা ও জাস্টিন৷ দুজনেই নির্মাণ শিল্পে শ্রমিকের কাজ করতেন৷ জাস্টিনের কাজ শেষ হয়ে গেছিল৷ বাড়ি ফেরার সময় লকডাউন শুরু হয়৷ বিমান চলাচল বন্ধ৷ ফলে ফিরতে পারেননি৷ কোম্পানি অস্থায়ী শিবির করেছিল৷ থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল৷নিজেদের পয়সায় রান্না করে খেতে হয়েছে৷ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটতো৷ রাজার অভিজ্ঞতা একই৷ লকডাউনের পর সংস্থা বন্ধ৷ কিন্তু ফেরার পালা আসছে না৷

তাঁরা ফিরতে পেরেছেন৷ কিন্তু এরকম লাখ লাখ কর্মী এখনো ফেরার দিন গুনছেন বেঙ্গালুরুতে থাকেন মাজহার৷ তাঁর ভাই এবং একাধিক আত্মীয়স্বজন দুবাই, আবুধাবিতে আছেন৷ মাজহার বলছিলেন, উপসাগরীয় দেশে অন্যের ভরসায় না থেকে ভারতীয়রাই একে অন্যকে সাহায্য করছেন৷

যাঁরা অপেক্ষাকৃত ভালো চাকরি করেন, ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আছেন, তাঁরাই অন্যদের রাখছেন৷ খাওয়াচ্ছেন৷ তঁদের বেতন কমেছে৷ বাড়িতে আর টাকা পাঠাতে পারছেন না৷ কিন্তু তাঁদের অবস্থা ওই শ্রমিকদের মতো নয়৷ ফলে এইভাবে তাঁরা রক্ষা করছেন নিজের দেশের লোককে৷ হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ বা ফেসবুকে অনেকে জানাচ্ছেন, তাঁরা এক বা দুই জনকে বাড়িতে রাখতে পারেন৷ প্রশ্ন হলো, এভাবে কতদিন টানা যাবে?

আর যাঁরা ফিরলেন, তাঁদের কী অবস্থা? ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার পর পরিবার আনন্দিত৷ তাঁরাও দেশে ও ঘরে ফেরার স্বস্তি পেয়েছেন৷ কিন্তু তাঁদের চিন্তা যায়নি, বরং বেড়েছে৷ সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা৷ তাঁরা একটা কথা বুঝেছেন, উপসাগরীয় দেশে তাঁরা আবার আগের মতো ফিরতে পারবেন কিনা সন্দেহ৷ তেলের দাম কমে যাওয়ার পরে থেকেই কোম্পানিগুলি চাপে ছিল৷ করোনার পর সেই চাপ অনেকটা বেড়েছে৷ কুয়েতের মতো অনেক দেশ নিয়ম করে বিদেশের কর্মীসংখ্যা বেঁধে দিচ্ছে৷

কুয়েত একটা বিল এনেছে৷ খসড়া বিলে বলা হয়েছে, কুয়েতের জনসংখ্যার ১৫ শতাংশের বেশি ভারতীয় সেখানে কাজ করতে পারবেন না৷ বিল পাস হলে ৮০ হাজার কর্মরত ভারতীয়কে কুয়েত ছাড়তে হবে৷ কুয়েতের এমপি-রা দাবি করেছেন, অন্তত আগামী এক বছর সরকারি কোনো চাকরি যেন বিদেশিদের দেওয়া না হয়৷ এবার উপসাগরীয় বাকি দেশগুলো একই সিদ্ধান্ত নিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল অনেক দিন থেকেই বিদেশি-নির্ভরতা কমাবার কথা বলছে৷  কারণ, এই দেশগুলিতে কাজ কমছে৷ দেশের লোককে কাজ দিয়ে তারপর বিদেশিদের নিয়োগের দাবি উঠছে৷ এই দেশগুলির অর্থনীতি পুরোপুরি অশোধিত তেলের দামের ওপর নির্ভর করে৷ তেলের দাম না বাড়লে এসব দেশও বেকায়দায় পড়ে৷ তেলের দাম অনেক দিন ধরেই তাঁদের প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম৷   

আর এর প্রতিক্রিয়া পড়ছে ভারতে৷ সাংবাদিক ববি ঘোষ লিখেছেন, ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে সব চেয়ে বেশি আর্থিক সমস্যায় পড়বে কেরালা৷ উপসাগরীয় দেশে কেরালার প্রায় ২৫ লাখ লোক কাজ করতেন৷ কেরালার জিডিপি-র এক তৃতীয়াংশ আসত তাঁদের পাঠানো টাকা থেকে৷ কেরালাতে অন্তত পাঁচ লাখ লোক এখন ফিরবেন৷ অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যাটা আরো অনেকটাই বাড়বে৷

এবার বিদেশেকাজ হারানো লোকেরা যদি ভবিষ্যতে আর সেখানে ফিরতে না পারেন, তা হলে চাপটা পড়বে রাজ্যের ওপর৷ এই লোকেরা দেশে ফিরে কী করবেন? তাঁরাও চাকরি খুঁজবেন৷ লকডাউনের পর ভারতে ১২ কোটিরও বেশি মানুষের চাকরি গিয়েছে৷ তার সঙ্গে বিদেশ ফেরত ভারতীয়দের সংখ্যাটাও যুক্ত হবে৷

ভারত থেকে সব চেয়ে বেশি লোক কাজের খোঁজে বিদেশে যান কেরালা থেকে৷ তারপরেই আছে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রর মতো রাজ্য৷ এসব রাজ্য আর্থিক দিক থেকে কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ তার থেকেও বেশি ক্ষতির মুখে পড়বেন, ওই মানুষগুলি, যারা নিজেদের শ্রম দিয়ে দুইটি পয়সার মুখ দেখেছিলেন৷ পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছিলেন৷ করোনা, লকডাউন এবং অর্থনীতির বেহাল অবস্থা তাঁদের সুখী ভবিষ্যতের আশায় আপাতত জল ঢেলে দিলো৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য