1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতীয় ফুটবলে বিপ্লবের নাম ‘আইজল এফসি’

রাজীব চক্রবর্তী নতুন দিল্লি
৮ মে ২০১৭

ভারত জয় করেছে আইজল ফুটবল ক্লাব৷ মিজোরামের আর্থ-‌সামাজিক ও রাজনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম৷ ক’দিন আগেও মিজোরাম লিগে সাত দলের মধ্যে ছয়ে ছিল যারা, একলাফে তারাই আইলিগ চ্যাম্পিয়ন! ভারতীয়‌ ফুটবলে এমন বিপ্লব আগে ঘটেনি৷

https://p.dw.com/p/2casW
Indien Fußball National Mannschaft
ফাইল ছবিছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar

আইজলের সাফল্যের রহস্য হলো ‘‌টিমগেম’৷ দলে একজনও বড় তারকা ছিল না৷ প্রত্যেকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়াই করেছেন৷ একঝাঁক তরুণ মুখ৷ বেশিরভাগ খেলোয়াড় ভূমিপুত্র৷ জয়েস রানে, আশুতোষ মেহতা বা আলবিনো গোমসের মতো ভিন রাজ্যের কয়েকজন৷ চার বিদেশি৷ সমস্ত পুরোনো ধ্যান-‌ধারণা বদলে দিয়ে ঘরের ছেলেদের ওপর ভরসা রেখেই চ্যাম্পিয়নের শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছে আইজল৷

মিজোদের গা থেকে অলস, উশৃঙ্খল, অল্পে তুষ্ট, দ্রুত হারিয়ে যাওয়ার ‌মতো প্রচলিত তকমা খুলে ফেলতে সক্ষম হলেন মিজোরামবাসী৷

ফাইনাল ম্যাচ শুরুর আগেই আইএসএল টিম নর্থইস্ট ইউনাইটেডের তরফে আবেদন জানানো হয়, ‘‌‘এতদিন ধরে সবাই মিলে এক হয়ে স্বপ্ন দেখেছি এই দিনটির৷ আসুন, আরও একবার আইজল এফসির পাশে দাঁড়াই৷ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সাক্ষী থাকি৷’’ তারপর যা ঘটল সবটাই ইতিহাস৷

আই লিগ জিততে শেষ ম্যাচে আইজলের দরকার ছিল একটা পয়েন্ট৷ জামিল খালিদের টিম পরাজিত হলে কলকাতার মোহনবাগান ক্লাবের সামনে এসে যেত খেতাব জয়ের সুযোগ৷ লাজংয়ের দিপান্দা ডিকা শুরুতেই ১-০ করে ফেলার পর পুরো অঙ্কটাই ঘুরে যাচ্ছিল৷ তারপর ৬৭ মিনিটে উইলিয়াম লালনুনফেলা ম্যাচে সমতা (১-১) ফেরানোয় আই লিগ জয়ের উৎসব শুরু হয়ে যায় শিলংয়ে৷ ম্যাচ ১-১ গোলেই শেষ হওয়ায় ভারতের পেশাদার ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় আইজল এফসি৷ ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা পর্যন্ত শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছে আইজল এফসি-কে!

আইজলের পরবর্তী লক্ষ্য ফেডারেশন কাপ৷‌‌‌‌ গতবার মোহনবাগানের কাছে পাঁচ গোলে চূর্ণ হতে হয়েছিল৷ এবার কি চাকা ঘুরবে?‌ ১১ লক্ষ মিজোর মনের কথা, ‘‘‌অসম্ভব কিছুই নয়৷’’ পাশাপাশি আইএসএল (‌ইন্ডিয়ান সুপার লিগ)‌-‌এর অন্তর্ভুক্ত হতে চায় আইজল৷ কিন্তু, ‌অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএফ‌‌)-‌এর কাছে আবেদন জানিয়েও কাজ হয়নি৷ তাই দাবি আদায়ের জন্য আমরণ অনশনের হুমকি দিয়েছে আইজল এফসি৷

এক আইলিগ মিজোরামের গর্বের ঝুলি ভরে দিয়ে গেল৷ উত্তর-‌পূর্ব ভারতের মণিপুরের গর্ব বক্সার মেরি কম, ডিঙ্কো সিং, সরিতা দেবী৷ রেনেডি সিং, কিরণ খোঙ্গসাই, বেমবেম দেবীসহ অসংখ্য নামী ফুটলার৷ থৈবা সিং থেকে আজকের হকি তারকা কোঠাজিত সিং, চিঙ্গলেনসানা সিং৷ ভারোত্তোলনে কুঞ্জুরানি দেবী৷ মেঘালয়ের রয়েছে শিলং, চেরাপুঞ্জি, মৌসিনরাম৷ অরুণাচলের রয়েছে অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য৷ ত্রিপুরার গর্ব অতীতের সচিনদেব-রাহুলদেব, আজকের দীপা কর্মকার৷ নাগাল্যান্ডের আছেন অলিম্পিকে ভারতের প্রথম পতাকাবাহক, প্রথম ফুটবল অধিনায়ক টি আও৷ অসমের চা, পর্যটন, বিহু, ভূপেন হাজারিকা৷ সিকিমের পর্যটন, ভাইচুং, অভিনেতা ড্যানি৷ এবার মিজোরামবাসীর জন্যও একটা অহঙ্কারের জায়গা হলো– তাদের আইজল এফসি আজ ফুটবলে ভারত চ্যাম্পিয়ন৷

আরও একটি বিষয় শোরগোল ফেলে দিয়েছে৷ ফাইনাল ম্যাচের পর ‘রেড ড্রাগন’দের সমর্থকেরা যা করেছেন, তা গোটা দেশের ফুটবল সমর্থকদের কাছে শিক্ষণীয়৷ লিগ জেতার আনন্দ উদযাপনের পর শিলঙের জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়াম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমস্ত আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে নিজেরাই পরিষ্কার করে দিয়েছেন তারা৷ সেই ছবি সোশ্যাল সাইটগুলোতে কার্যত ভাইরাল হয়ে পড়ে৷ টিম মালিক রবার্ট রয়েতে বলেছেন, ‘‘‌সমর্থকেরা হোম ম্যাচের পরও নিজেরাই গ্যালারি পরিষ্কার করে দেন৷’’

তবে, আইজলের সাফল্যকে শুধুই ফুটবলের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখাটা ভুল হবে৷ এই জয়ের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক৷ মিজোরা অধিকাংশই নিজেদের ভারতের মূল ভূখণ্ডের নাগরিক ভাবতে পারেন না এখনও৷ সেখানকার ছেলেমেয়েরা ভারতের অন্য বড় শহরে পড়াশোনা বা জীবিকার জন্য গেলে তাঁদের অন্য চোখে দেখা হয়৷ এখন মিজোরা ভাববেন, এই একটা জায়গায় আমরা ভারত সেরা৷ পিছনে চলে যেতে পারে বিচ্ছিন্নতাবাদ, উপজাতি দ্বন্দ্ব৷ লাভ আসলে গোটা ভারতের৷ মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল বা বেঙ্গালুরু চ্যাম্পিয়ন হলে ‌হয়ত এমনটা হতো না৷

‘আইজল ভারতীয় ফুটবলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে’

আইজলের জয় প্রসঙ্গে প্রবাদপ্রতিম বাঙালি ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘আইজল ভারতীয় ফুটবলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে৷ ‌আইলিগে প্রায় সব দলেই বিদেশি খেওয়াড়দের ওপর অসম্ভব নির্ভরতা দেখা গেছে৷ সব ক্ষেত্রেই এতদিন দেখা যেত, প্রধানত বিদেশিদের ওপর ভরসা রেখেই খেলায় জোর দেওয়া হতো৷ তাতে স্থানীয়দের শুধুমাত্র সাপোর্টটুকুই ব্যবহার হতো৷ কিন্তু, আইলিগে এবার একমাত্র আইজলেই স্থানীয়রাই খেলেছেন৷ বিদেশিরা সাপোর্ট দিয়েছেন মাত্র৷ এটা দেখে দেশের অন্যান্য ক্লাবগুলোর ভাবা উচিত৷’’ তিনি মনে করেন, চাম্পিয়ন হওয়ার পর স্টেডিয়ামে উৎসবের জেরে যেটুকু আবর্জনা তৈরি হয়েছিল আনন্দের সঙ্গে সেগুলো সাফ করে দেওয়ার পেছনের কারণও দলে স্থানীয় খেলোয়াড়দের আধিক্য৷ তাঁর মতে, দর্শকরা খেলোয়াড়দের ‘‌ঘরের ছেলে'‌ মনে করে দলের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছেন৷

আইএসএল-‌এ আইজলকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিকে পূ্র্ণ সমর্থন করেন এই প্রবীন সাবেক ফুটবলার৷

মিজোরামকে দেখে অন্য রাজ্যগুলোও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের কথা ভাবতে বাধ্য হবে৷ ফুটবলে ‘দুর্বল’ দেশের অন্যান্য অঞ্চল, অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, হিমাচল, অন্ধ্র, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্য, যেখানে ক্লাব ফুটবল বলে কিছুই নেই, এবার তারাও বুঝবে, কলকাতার টিমগুলোর মতো অত টাকার টিম না করলেও চলবে৷ বেশি টাকা ঢালাটাই সাফল্যের মূল কথা নয়৷ আন্তরিক পরিকল্পনা দিয়ে সবাইকে পিছনে ফেলা যায়৷

পাহাড়ের সাফল্য কি মিজোরাম দিয়েই শুরু হয়? আইজল এফসির প্রথম আই লিগ জয় সেই প্রশ্নও উস্কে দিয়েছে৷ ১৯৭৯ সালে ফেডারেশন কাপে দুটো পাহাড়ি টিম খেলেছিল৷ শিলং একাদশ ও মিজোরামের ইয়ং ফিজিক ক্লাব৷ আই লিগে ২০০৯ সালে প্রথম পাহাড়ি টিম ছিল লাজং এফসি৷ মিজোরাম উত্তরপূর্ব ভারতের প্রথম টিম হিসেবে ২০১৩ সালে সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়৷ এবার আই লিগ জয় মিজোরামেরই আইজলের৷ অধিনায়ক আলফ্রেড বলেছেন, ‘‘আমার নেতৃত্বে মোহামেডান দ্বিতীয় ডিভিশন থেকে আই লিগের মূল পর্বে উঠেছিল৷ আর আমার নেতৃত্বে লিগ চ্যাম্পিয়ন আইজল৷ সৃষ্টিকর্তা আমাকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন৷’’