1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে বিচারপতিকে কারাদণ্ড

১১ মে ২০১৭

আদালতের নির্দেশ অমান্য করলে ভারতে কারও ক্ষমা নেই– আরও একবার সে কথা প্রমাণ করল দেশের সর্বোচ্চ আদালত৷ আদালত অবমাননার দায়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি চিন্নাস্বামী কারনানকে ছয় ‌মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট৷

https://p.dw.com/p/2cmjt
Oberstes Gericht Delhi Indien
ছবি: picture-alliance/dpa

আদালত তাঁর কর্মস্থল৷ সুবিচার করা তাঁর কর্তব্য৷ কিন্তু, সেই বিচারপতিকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ!‌ কেন?‌ উত্তর রয়েছে তাঁর ইদানিংকালের কর্মকাণ্ডের মধ্যে৷ যেমন— নিজের বাড়িতে আদালত বসিয়ে অভুতপূর্ব সব রায় ঘোষণা, নিজেই নিজের বদলি স্থগিত করা, এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি‌সহ অন্য ৭ বিচারপতিকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা৷ আদালত অবমাননার দায়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি চিন্না স্বামী কারনানকে ছয় ‌মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট৷

এক নজিরবিহীন রায় ঘোষণা করে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ আদালতের নির্দেশ অমান্য করলে ভারতে কারও ক্ষমা নেই– আরও একবার সে কথা প্রমাণ করল দেশের সর্বোচ্চ আদালত৷ আদালত অবমাননার দায়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি চিন্না স্বামী কারনানকে ছয় ‌মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ৷

সুপ্রিম কোর্টে গ্রীস্মাবকাশ শুরু হয়েছে৷ এরইমধ্যে পুলিশের সঙ্গে একপ্রকার লুকোচুরি খেলে রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আসছেন কারনান৷ ফলে, শেষ পর্যন্ত জল কোন দিকে গড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রাখছে সব মহল৷

আগামী ১১ জুন বিচারপতি কারনানের অবসর নেওয়ার কথা৷ অবসরের পরেও আরও পাঁচ মাস জেলে থাকতে হবে তাঁকে৷ তবে, বিচারপতি কারনান তো আর যে সে লোক নন, তাই সহজে ধরা দেওয়া তাঁর না-পসন্দ৷ কারনানকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে খালি হাতে ফেরত আসতে হয়েছে কলকাতা পুলিশের মহানির্দেশক সুরজিৎ করপুরকায়স্থকে৷ ‌মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অভিযুক্ত বিচারপতি৷

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরই হাইকোর্টের বিচারপতি কারনানকে গ্রেপ্তার করতে কলকাতায় তাঁর নিউটাউনের বাড়িতে হাজির হন কলকাতা পুলিশের পদস্থকর্তারা৷ কিন্তু, সেখানে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, বর্তমানে কলকাতায় নেই বিচারপতি৷ চেন্নাইতে রয়েছেন৷ চেন্নাইয়ে পৌঁছে যায় পুলিশ৷ কিন্তু চেন্নাই কেন, গোটা তামিলনাড়ুর কোথাওই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি কারনানের হদিশ পায়নি পুলিশ৷ পুলিশ খবর পেয়েছিল, তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকলাহস্তিতে রয়েছেন৷ বিচারপতি কারনানের অবস্থান নিয়ে ধন্দে পড়েছে কলকাতা পুলিশ৷ কলকাতা পুলিশ জানতে পারে, চেন্নাইয়ে রাজ্য সরকারের একটি অতিথিশালায় উঠেছিলেন বিচারপতি কারনান৷ সরকারিভাবে ঘরটি তিনি এখনও ছাড়েননি৷ সেখানকার বিলও মেটাননি৷ তবে ওই সরকারি অতিথিশালায় তিনি এখন নেই৷

কেন এই শাস্তি?‌ বিচারপতি কারনানের অপরাধ– তিনি শীর্ষ আদালতের নির্দেশ অবমাননা করেছেন৷ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চ এখানেই থামেনি৷ কারনানের আচরণে ক্ষুব্ধ বিচারপতিরা নির্দেশ দেন, এই রায়ের পরে কারনান কোনও বয়ান বা নির্দেশ দিলে সংবাদমাধ্যমে তা প্রকাশ করা যাবে না৷ সংবাদমাধ্যমের উপরে এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অবশ্য আপত্তি আছে আইনজীবীদের একাংশের৷

প্রসঙ্গত, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিচারপতি কারনান ২০ জন বিচারপতিকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলে তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি তোলেন৷ এর পরেই সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারপতির বেঞ্চ নিজে থেকেই আদালত অবমাননার মামলা শুরু করে৷ আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও প্রথমে হাজির হননি তিনি৷ পরে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের সামনে হাজির হয়েছিলেন৷ তাঁর আগে আর কোনও হাইকোর্টের বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টের সামনে হাজির হতে হয়নি৷ এরপর অবশ্য আর আদালতের সামনে হাজির হননি তিনি৷ আইনজীবীও নিযুক্ত করেননি৷ উল্টে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরই তাঁর আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করেন৷ শেষমেশ বিচারপতি কারনান তফসিলি জাতি-উপজাতি নির্যাতন আইনে প্রধান বিচারপতি খেহরসহ সুপ্রিম কোর্টের আট জন বিচারপতিকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন৷ প্রত্যেককে এক লক্ষ টাকার জরিমানাও করেন৷

এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সুপ্রিম কোর্ট৷ কারনানের বিরুদ্ধে মামলার শুনানির সময়ে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল মনীন্দ্র সিংহ. কে কে বেণুগোপাল, রূপেন্দ্র সিংহ সুরির মতো প্রবীণ আইনজীবীরা সকলেই একমত হন, বিচারপতি কারনান যা করছেন তা আদালতের চূড়ান্ত অবমাননা৷ এর কড়া শাস্তি হওয়া উচিত৷ কিন্তু শাস্তির নির্দেশ এক মাস পরে দেওয়া উচিত হবে কি না, তা নিয়ে আইনজীবী বেণুগোপাল সংশয়ে ছিলেন৷ তাঁর যুক্তি ছিল, কোনও কর্মরত বিচারপতির কারাদণ্ড হলে তাতে বিচারবিভাগের গায়েই কলঙ্ক লাগবে৷ কিন্তু প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দেন, ‘‌‘‌আদালতের অবমাননার ক্ষেত্রে দোষী সাধারণ মানুষ, না বিচারপতি, তা বিচার করা হবে না৷ অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে৷’’ কলকাতা পুলিসের মহানির্দেশককে আদালতের নির্দেশ, ‘‌‘‌অবিলম্বে বিচারপতি কারনানকে গ্রেপ্তার করা হোক৷’’

‘‘এটা সত্যিই নজিরবিহীন ঘটনা’’

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অভিজিৎ সেনগুপ্ত বললেন, ‘‌‘‌সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ যে রায় দিয়েছে, স্বাধীনোত্তর পর্বে এমন রায়দানের কোনও ঘটনা ঘটেছে বলে মনে পড়ে না৷ এটা সত্যিই নজিরবিহীন ঘটনা৷ আমার মনে হয়, গোটা দেশকে বিচার ব্যবস্থার পক্ষ থেকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্ট যে বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ সাংবিধানিক সংস্থা সেটিই প্রমাণিত হলো৷ সুপ্রিম কোর্টের কাছে আর কোনও উপায় ছিল না৷’’ তাঁর মতে, ‘‌‘‌বিচারপতি কারনান বেশ কিছুদিন ধরে সমগ্র বিচার ব্যবস্থাটাকেই চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছিলেন৷ তবে, অনেকে বলতেই পারেন, সংসদে ইমপিচমেন্ট করা যেতো, সুপ্রিম কোর্ট সেদিকে গেল না কেন?‌ এই ব্যাপারে আমার মনে হয়, সংসদের বিবেচনার ওপর বিষয়টি ছেড়ে না দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট নিজের এক্তিয়ারের জানান দিয়েছে৷’’

অতীতে ভারতে কর্মরত কোনও বিচারপতিকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি৷

এদিকে আইনজীবীরা মনে করছেন, কারনানের কাজকর্ম কলেজিয়াম প্রথায় বিচারপতি নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল৷ কারণ, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামই কারনানকে নিয়োগ করেছিল৷ তাই তাঁর বিরুদ্ধে এত কড়া পদক্ষেপ করেছে শীর্ষ আদালত৷

প্রসঙ্গত, সি এস কারনান এবং সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে এই বিবাদ বহুদিনের৷ এর আগে ১ মে শীর্ষ আদালত বিচারপতি কারনানের মানসিক অবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তোলে৷ তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ দেয়৷ সেই নির্দেশ মানেননি কারনান৷ ৪ মে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়েছিলেন পাভলভ হাসপাতালের চার চিকিৎসক৷ সঙ্গে ছিলেন বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের ২০ জন পুলিশ৷ কিন্তু তাঁদেরকে ফিরিয়ে দেন কারনান৷ চিকিৎসকদের বিচারপতি কারনান বলেছিলেন, ‘‌‘‌কারও মানসিক চিকিৎসার জন্য তাঁর অভিভাবকদের সম্মতি লাগে৷ বাড়িতে কেউ নেই৷ তাই পরীক্ষা করা যাবে না৷'‌'‌ ৮ মে'র মধ্যে সেই পরীক্ষার রিপোর্ট আদালতে পেশ করার কথা ছিল৷

এতকিছুর পর সোমবার নিজের বাড়ি থেকেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ মোট ৮ বিচারপতির বিরুদ্ধে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন তিনি৷ সঙ্গে এক লক্ষ টাকা করে অর্থদণ্ড৷ সংবাদমাধ্যমকে এই বিষয়ে তিনি জানান, ‘‌তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের ওপর অত্যাচার প্রতিরোধ আইন‌’-‌এর আওতায় তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করেছেন৷ যদিও সুপ্রিম কোর্ট আগেই জানিয়েছিল, ‘‌‘‌৮ ফেব্রুয়ারির পর কারনানের দেওয়া সব নির্দেশ গুরুত্বহীন৷’’ উল্টোদিকে কারনানের বক্তব্য, তিনি দলিত বলে তাঁর সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করা হচ্ছে৷ নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন তিনি৷

এখন দেখার, আদালতের নির্দেশ মেনে নিয়ে সত্যিই তিনি জেলে ঢুকবেন, নাকি আইনের মারপ্যাঁচে আবারও জল অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়ে যাবে?