1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গাদের কি ‘জোর করে’ ভাসান চরে পাঠানো হবে?

আরাফাতুল ইসলাম | নাওমী কনরাড | স্টেফান চিমেক ভাসান চর
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

কক্সবাজারের জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরগুলোতে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন৷ বাংলাদেশ সরকার সেখান থেকে একলাখ শরণার্থীকে ভাসান চর নামের এক দ্বীপে স্থানান্তরের চিন্তাভাবনা করছে৷ তবে, রোহিঙ্গারা সেই দ্বীপে যেতে রাজি নয়৷

https://p.dw.com/p/3OugI
ভাসান চর
ছবি: DW/N. Conrad

আগস্টের শেষের দিকের এক ভোরে সূর্য ওঠার আগেই হাজির হতে হয় চট্টগ্রাম পতেঙ্গা নৌবন্দরে৷ গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মাঝে নৌবাহিনীর জাহাজ রওয়ানা দেয় এক চরের উদ্দেশ্যে৷

সমুদ্র তখন ততটা উত্তাল ছিল না৷ তবে মৃদু ঢেউয়ের তালেই মাছ ধরার নৌকাগুলো দুলছিল৷

জাহাজে প্রায় ঘণ্টা তিনেক যাত্রার পর বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে একটি চর ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে৷ দূর থেকেই সেখানে সদ্য মাথা উঁচু করা চারতলা ভবনগুলো দেখা যাচ্ছিল৷

অথচ ২০ বছর আগেও এখানে অতল বঙ্গোপসাগর ছাড়া কিছু ছিল না৷ আর এখন নিচু চরটিতে কার্যত ছোটখাট এক শহর গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে এক লাখের মতো মানুষ বসবাস করতে পারবে৷

রোহিঙ্গাদের চরে নিয়ে যেতে চায় বাংলাদেশ সরকার

ভাসান চর নামের কয়েক বছর আগে জেগে ওঠা পলিমাটির এই চরে এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্থানান্তর করতে চায় বাংলাদেশ সরকার৷ শরণার্থীরা স্বেচ্ছায় রাজি না হলে জোর করে তাদের কক্সবাজার থেকে এই চরে নিয়ে আসা হতে পারে৷ 

রোহিঙ্গাদের জন্য দুর্বল দ্বীপে সবল অবকাঠামো

ভাসান চরে, রোহিঙ্গাদের কাছে যেটি ঠেঙ্গার চর নামে পরিচিত, যাওয়ার জন্য এর আগ পর্যন্ত কোনো পশ্চিমা সাংবাদিক সরকারি অনুমতি পাননি৷ ডয়চে ভেলের তিন সাংবাদিককে গত ২৪ আগস্ট চরটি ঘুরে দেখার সুযোগ দেয়া হয়৷ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যরা সাংবাদিকদের সেখানে নিয়ে গেছেন এবং সবসময় সঙ্গে ছিলেন৷
ঘূর্ণিঝড়প্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত এই চরে ২০১৫ সালে প্রথম শরণার্থীদের বসবাসের জন্য আবাসন গড়ার পরিকল্পনা করা হয়৷ সেসময় চরটিতে কোন জনবসতি ছিল না৷

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়ায় পালিয়ে আসলে চরটিতে অবকাঠামো গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়৷

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্য৷ ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে বেশ কয়েকটি পুলিশ স্টেশনে ‘‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)'' হামলা চালালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান বাড়িয়ে দেয় সেদেশের সেনাবাহিনী৷ এই জঙ্গি সংগঠনটির নেতৃত্বে রয়েছে সৌদি প্রবাসী রোহিঙ্গাদের একটি ছোট গ্রুপ৷

তবে, আরসার হামলার জবাব অত্যন্ত কঠোরভাবে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী৷ রোহিঙ্গাদের অনেক গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বা বোমা বর্ষণ করা হয়েছে৷ সেই অভিযানে অনেক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন, অনেক নারী হয়েছেন ধর্ষণের শিকার৷ জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘‘একটি জাতিকে নির্মূলের পরিষ্কার উদাহরণ'' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন৷ 

ভাসান চর ঘুরে এসে ডয়চে ভেলে টিভিকে যা বললেন আরাফাতুল ইসলাম

কক্সবাজার: জনাকীর্ণ এবং কড়া নিরাপত্তা

বাংলাদেশ সেসময় জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে৷ কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় মিয়ানমারের সীমান্তের কাছেই পাহাড়ি বনাঞ্চল সাফ করে গড়া তাঁবুতে তাদের রাখার ব্যবস্থা করেছে৷ রোহিঙ্গাদের স্রোতে এখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি৷

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো জনাকীর্ণ৷ আর, পাহাড় কেটে গড়ে তোলা ক্যাম্পগুলো ততটা মজবুতও নয়৷ ফলে বৃষ্টির সময় এখানে ভূমিধসের আশঙ্কা প্রবল৷ আর বাঁকা লোহা এবং তেরপল দিয়ে গড়া তাঁবুগুলোর ভেতরে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম থাকে৷

শরণার্থী শিবিরগুলোতে দিনের বেলা নিরাপত্তা পরিস্থিতি তুলনামূলক শান্ত থাকলেও রাতে পরিস্থিতি বদলে যায়৷ কোন উন্নয়নসংস্থা কিংবা গণমাধ্যমের দেশিবিদেশি প্রতিনিধিদের সন্ধ্যার পর শিবিরে থাকার অনুমতি নেই৷ রাতের বেলা বিভিন্ন নিরাপত্তাবাহিনী শিবিরগুলোর ভেতরে  টহল দেয়৷ তাসত্ত্বেও হত্যা, অপহরণ এবং ধর্ষণের মতো ঘটনা মাঝেমধ্যেই শোনা যায়৷

টেকনাফ এবং উখিয়ায় অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলোর জনাকীর্ণ অবস্থা এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ভাসান চর পরিকল্পনা, যেটি আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্প নামে পরিচিত, দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে৷ 

ভাসান চর: রোহিঙ্গাদের জন্য ‘‘স্বর্গ''

পলি জমে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ভাসান চরে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে নির্মাণ কাজ শুরু হয়৷ আর প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করে মাত্র দেড়বছরে চরটিতে একলাখ মানুষের বসবাসের উপযোগী অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়৷ দ্বীপটিকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ নৌবাহিনী এ তথ্য জানায়৷ 

Animiertes GIF Bangladesh Landaufschüttung
যেভাবে গড়ে উঠেছে ভাসান চর

ডয়চে ভেলেকে চুপচাপ শান্ত এই  ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে৷ এখানকার ভবনগুলো দেখতে প্রায় একইরকম৷ স্টিল এবং কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি একেকটি ভবনে ১৬টি বারো বাই চৌদ্দ ফুট ঘর রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটিতে এক পরিবারের চারজন করে থাকতে পারবেন৷ নারী ও পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা বাথরুম৷ প্রতিটি ভবনে ৬৪ জনের জন্য থাকছে দু'টি রান্নাঘর যেখানে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি চুলা ব্যবহার করা যাবে৷

চরটিতে বিদ্যুতের জোগান দিতে জেনারেটরের পাশাপাশি রয়েছে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় আয়োজন৷ টিউবওয়েল ছাড়াও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা ব্যবহারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে এই দ্বীপে৷ পাশাপাশি রয়েছে অনেক পুকুর, যেখানে মাছচাষ সম্ভব৷

ভাসান চরে গড়ে তোলা এই শহরের অভ্যন্তরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে পুলিশ৷ নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিতে চরটিতে শীঘ্রই ১২০টি সিসিটিভি ক্যামেরাও বসানো হবে৷

এই বসতি রোহিঙ্গাদের জন্য এক ‘‘স্বর্গ'' বলে মনে করেন আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের প্রধান স্থপতি আহমেদ মুক্তা৷ তিনি বলেন, ‘‘এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই৷ আমরা রোহিঙ্গাদের এমন কিছু একটা দেবো, যা তারা সারাজীবন মনে রাখবে৷''

নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ

মুক্তার প্রতিষ্ঠান ‘‘এমডিএম আর্কিটেক্টস'' অতীতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সেল্টার হাউস তৈরি করেছে৷ ভাসান চরে অবকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা করতে মাত্র এক সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন তিনি৷ তবে, সেই অল্প সময়ে পরিকল্পনা করে তিনি যা গড়েছেন তা নিয়ে তিনি গর্বিত৷

চরটির এক নির্মাণ শ্রমিক ডয়চে ভেলেকে জানান যে তাঁকে যদি এই দ্বীপে একটি ঘর দেয়া হয় তাহলে তিনি সানন্দে এখানে থাকবেন৷ ‘‘এটা বসবাসের জন্য চমৎকার স্থান,'' বলেন তিনি৷

চরটিতে রোহিঙ্গাদের জন্য রয়েছে ১২০টি চারতলা শেল্টার হাউস, যেগুলোর প্রতিটিতে স্বাভাবিক সময়ে ৯২ জন অবস্থান করলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সহস্রাধিক মানুষ থাকতে পারবেন৷ আর অন্যান্য সময় এসব ভবন হাসপাতাল, প্রাথমিক স্কুল, মসজিদ কিংবা দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে৷

শেল্টার হাউসগুলো ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের বাতাসেও অক্ষত থাকবে৷ এগুলোর কয়েকটিতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয় এবং কর্মীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা যাবে৷ ডয়চে ভেলেকে এরকম একটি ভবন দেখানো হয়েছে যেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ আধুনিক বাথরুমও রয়েছে৷ 

আহমেদ মুক্তা জানান, শেল্টার হাউসে ৪০ শয্যার হাসপাতালের আয়োজন থাকবে৷ তবে, জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজনে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা পাশের হাতিয়া দ্বীপে অবস্থিত হাসপাতালে যেতে পারবেন৷ নৌকায় সেই চরে যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে বলে জানিয়েছেন নৌ কর্মকর্তারা৷ 

ইতোমধ্যে ভাসান চরে প্রায় সব ভবনের কাজ শেষ হয়ে গেছে বলেও ডয়চে ভেলেকে জানানো হয়েছে৷ যদি সরকার রোহিঙ্গাদের এই দ্বীপে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া তাহলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তা কার্যকর সম্ভব৷ এজন্য নৌবাহিনীর চারটি জাহাজও প্রস্তুত রয়েছে৷ এসব জাহাজে করে একেকবারে চারশো থেকে পাঁচশো শরণার্থীকে এই চরে নিয়ে আসা যাবে৷

রোহিঙ্গা: ‘‘আমাদের দয়া করে ভাসান চরে পাঠাবেন না''

কিন্তু, কুতুপালং ক্যাম্পে যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে ডয়চে ভেলে কথা বলেছে, তাদের কেউই ভাসান চরে যেতে রাজি হননি৷ হামিদা খাতুন নামের এক বৃদ্ধ নারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভাসান চরে আমরা যাবো না৷ সেখানে পানি উঠে মানুষ মারা যায়৷ বাচ্চারা এবং আমাদের মতো অসুস্থরা সেখানে গেলে মারা যাবে৷ আমরা এখানে যে ক্যাম্পে আছি সেখানেই থাকতে চাই৷''

তবে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন ঢাকায় তাঁর কার্যালয়ে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে সরকার প্রয়োজন মনে করলে জোর করে হলেও রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে সরিয়ে নিতে পারে৷ তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গারা যদি স্বেচ্ছায় সেখানে যেতে না চায়, তাহলে আমরা জোর করবো৷''

রোহিঙ্গাদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময় উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘(কক্সবাজারের) জনাকীর্ণ ক্যাম্পে থাকলে রোহিঙ্গারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হতে পারে৷''

টেকনাফ এবং উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে৷ ডয়চে ভেলে যেদিন ভাসান চর গিয়েছে, সেদিনও স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুই রোহিঙ্গা পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে৷

পররাষ্ট্রমন্ত্রী: ‘‘আমরা তাদের জোর করতে পারি''

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন মনে করেন, রোহিঙ্গারা নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি করছে৷ তিনি বলেন, ‘‘সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা খুন হচ্ছেন৷ আমরা এটা মেনে নিতে পারি না৷ আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে৷ এজন্য আমরা হয়ত জোর করে রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে সরিয়ে নেবো৷''

ডয়চে ভেলে সংবেদনশীল এক সময়ে ভাসান চরে গিয়েছে৷ সেসময় কয়েকহাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর এক প্রক্রিয়া পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে৷ রোহিঙ্গা জানিয়েছেন যে মিয়ানমারে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত সেখানে যাবেন না তারা৷

লাখখানেক রোহিঙ্গাকে ভাসান চরে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনায় সমর্থন পেতে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ এবং অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার, যেগুলো রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করছে, উপর চাপ প্রয়োগ করছে বলে জানা গেছে৷ জাতিসংঘ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক এক বৈঠকের ‘মিটিং মিনিটস' পেয়েছে ডয়চে ভেলে, যেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ২০২০ সালের পরিকল্পনায় ভাসান চর অন্তর্ভূক্ত করতে জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়নসংস্থাকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার৷ 

আর সেটা না করা হলে ২০২০ সালের পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকার অনুমোদন দেবে না বলেও হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে৷

তবে, ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র এব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন৷ নামপ্রকাশের অনিচ্ছুক জাতিসংঘের কয়েক কর্মকর্তা অবশ্য ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে ভাসান চরকে ভবিষ্যত পরিকল্পনায় অন্তর্ভূক্ত করতে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে৷

Rohingya Camp Süd Blangladesch
ভাসান চর রক্ষায় তিন মিটার উঁচু বাঁধ তৈরি করা হয়েছেছবি: DW/A. Islam

একটি উদ্বেগ হচ্ছে, রোহিঙ্গারা ভাসান চরে হয়ত বছরের পর বছর আটকে থাকবে এবং তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা অনেক সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে৷ তাছাড়া, একসঙ্গে কক্সবাজার এবং ভাসান চরে কার্যক্রম পরিচালনা সাহায্য সংস্থাগুলোর পক্ষে কঠিন হবে৷

ভাসান চর কি বসবাসের উপযুক্ত?

আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থাগুলোর আরেক বড় উদ্বেগ হচ্ছে, ভাসান চর কি আদৌ বসবাসের উপযোগী?

সাইক্লোন উপদ্রুত এলাকায় এক ভঙ্গুর এবং পরিবর্তনশীল ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছে বঙ্গোপসাগর৷ মেঘনা নদীর পানির সঙ্গে আসা পলিমাটি জমে সেখানে ধীরে ধীরে চর সৃষ্টি হয়৷ কিছু চর আবার তীব্র জোয়ারে ভেসে যায়, কোন কোনটি কয়েক দশক সময় নিয়ে স্থির রূপ পায়৷ এরপর সেগুলোকে মাছ ধরতে, চাষাবাদ করতে এবং এক পর্যায়ে জনবসতির জন্য উপযুক্তি বিবেচনা করা হয়৷

ভাসান চর, যেটি কিনা ২০ বছরেরও কম সময় আগে জেগে উঠেছে, এখনো অনেক ভঙ্গুর এক চর যেটি এখনো ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে রয়েছে৷

ডয়চে ভেলে বেশ কয়েকজন নদী এবং জলবায়ু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে যারা সবাই মনে করছেন আগামী বছরগুলোতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ঘুর্ণিঝড়ের হার এবং মাত্রা বাড়তে পারে৷ আর জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের পানির উচ্চতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যেতে পারে৷ 

ভাসানচরে তৈরি অবকাঠামো এখন তিন মিটার উঁচু বাঁধ দিয়ে সুরক্ষিত রয়েছে৷ পাশাপাশি চরটির ভূমিক্ষয় বা ভাঙ্গন রোধে রয়েছে তিনস্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা৷ সাগরের ঢেউ আটকানোর বিশেষ ব্যবস্থাসহ বালুর বস্তা এবং নুড়ি পাথর দিয়ে সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়া হয়েছে৷ চরটিকে বসবাসের উপযোগী করে তোলার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন এসব ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় চরটিকে রক্ষা করতে যথেষ্ট৷

তবে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে৷ সেরকম পরিস্থিতিতে চরটিতে তৈরি করা ১২০টি শেল্টার হাউস, যেগুলোর নিজস্ব পানি এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থা রয়েছে, রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অবশ্য কাউকে চরটি থেকে উদ্ধার করা হবে না বলেও নিশ্চিত করেছে নৌবাহিনী৷ অর্থাৎ সেরকম পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের চরেই থাকতে হবে৷

ডয়চে ভেলে যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে চরটির বিষয়ে জানতে চেয়েছে, তাদের সবাই অবশ্য মনে করছেন না যে চরটিতে ইতোমধ্যে যেসব ব্যবস্থা করা হয়েছে তা যথেষ্ট৷ কেউ কেউ মনে করছেন, যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সেটির উচ্চতা দ্বিগুণ করতে হবে৷ বাকিরা বলছেন, বাঁধের মধ্যে রোহিঙ্গারা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ থাকবেন৷ 

Bangladesch Geplante Umverlegung der geflüchteten Rohingya nach Bhasan Char
ভাসান চরে ‘‘আশার বাতিঘর’’ছবি: DW/A. Islam

স্থপতি আহমেদ মুক্তা কোনভাবেই মনে করেন না যে চরটি অনিরাপদ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘যেসব মানুষ ভাসান চরকে ভাসমান চর, কিংবা অনিরাপদ চর বলেন, তারা আসলে চরটিকে চেনেন না৷ তারা চরটি এখনো দেখেননি৷''

ভাসান চরে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য চরটির বাঁধের বাইরের অংশে গড়ে উঠেছে একটি বাজার৷ এই বাজারের কয়েকজন দোকানদার জানান, এখনো মাসে দু'বার জোয়ারের সময় তাদের বাজারে তিন থেকে চার ফুট পানি ওঠে৷ এই পানি অবশ্য বাঁধের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না৷ আর কখনো কখনো বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে নৌকায় করে চরটিতে যাতায়াত অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়ে৷ একবার এক দোকানদার চরটিতে আসতে গিয়ে নৌকায় মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন বলেও জানিয়েছেন৷ কেননা  নৌকাটি প্রায় ডুবতে বসেছিল৷

জাতিসংঘের সহায়তা ছাড়াই স্থানান্তর!

বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সহায়তা ছাড়াই ভাসান চর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে কিনা সেটা অবশ্য এখনো নিশ্চিত নয়৷ কক্সবাজারে এসব রোহিঙ্গাদের বাঁচিয়ে রাখতে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে আন্তর্জাতিক এসব সংস্থা৷

পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন অবশ্য বলেছেন প্রয়োজন মনে করলে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সম্মতি ছাড়াও রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে স্থানান্তর করতে পারে বাংলাদেশ সরকার৷ তিনি বলেন, ‘‘জাতিসংঘ যদি এই প্রস্তাবে সায় না দেয়, তাহলে বাংলাদেশ তাদেরকে এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলতে পারে৷''

এদিকে, ভাসান চরে এরই মধ্যে একটি লাইটহাউসও স্থাপন করা হয়েছে, যেটির নাম দেয়া হয়েছে ‘‘আশার বাতিঘর৷'' সেটির সাদা দেয়ালে ফলক স্থাপনের জন্য জায়গা রাখা হয়েছে৷ রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরুর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দ্বীপটি উদ্বোধন করলে সেখানে একটি ফলক স্থাপন করা হবে৷

তবে, এমনটা সত্যিই হবে কিনা তা ডয়চে ভেলেকে কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি৷