1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‌ভূতে ভয় পেল মমতার সরকার

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মুক্তি পাওয়ার একদিনের মাথায় রহস্যজনকভাবে কলকাতার সবকটি সিনেমা হল থেকে উধাও হয়ে গেল অনীক দত্ত পরিচালিত ছবি ‘‌ভবিষ্যতের ভূত'৷ কারণ তাতে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের প্রতি কটাক্ষ আছে৷

https://p.dw.com/p/3DaKN
Demonstration in Kalkutta
ছবি: DW/S. Bandopadhyay

সম্ভবত একটু দুঃসাহসীই হয়েছিলেন পরিচালক অনীক দত্ত৷ তাঁর তুমুল জনপ্রিয় ছবি ‘‌ভূতের ভবিষ্যৎ'‌–এর দ্বিতীয় পর্ব ‘‌ভবিষ্যতের ভূত'‌ ছবিতে রঙ্গব্যঙ্গের নিশানা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস আর তার কিছু নেতাকে৷ অবশ্যই স্বনামে নয়, কিন্তু নাম বদলেও যে চরিত্রগুলিকে তিনি পর্দায় হাজির করেছেন, তারা রাজ্যবাসীর কাছে অতি পরিচিত৷ যেমন এক নেতার মাথায় অক্সিজেন কম যায় বলে তিনি অনবরত ভুলভাল কথা বলেন৷ অথবা আরেক নেতা বৈঠক চলাকালীন জলের জগ ছুড়ে মারেন৷ এমনকি অতি পরিচিত একটি স্লোগানও সামান্য বদলে গিয়ে হয়েছে; ‘‌মা-মাটি-মাফিয়া'‌!‌

সঙ্গত কারণেই এই বিদ্রুপ রাজ্যের শাসকগোষ্ঠীর পছন্দ হয়নি এবং শুক্রবার ছবিটি সাধারণের জন্য মুক্তি পাওয়ার পরদিনই রাজ্যের এক মন্ত্রীর অলিখিত ফরমানে ‘‌ভবিষ্যতের ভূত'‌ ছবিটি কলকাতা শহরের সবকটি প্রেক্ষাগৃহ থেকে একসঙ্গে তুলে নেওয়া হয়েছে৷ যদিও কোথাওই বলা হয়নি যে প্রশাসনিক আপত্তিতে ছবিটি তুলে নেওয়া হলো৷ হল মালিকেরা আলাদা আলাদাভাবে নানারকম অসুবিধের কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন৷ কিন্তু আসলে কী ঘটল, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধে হচ্ছে না৷ আর স্বয়ং পরিচালক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাঁকে পুলিশের তরফ থেকে ফোন করে বলা হয়েছিল ছবিটি একবার দেখাতে৷ কারণ ছবিটিতে কিছু আপত্তিকর বিষয় আছে বলে খবর আছে, যা থেকে রাজনৈতিক অশান্তি হতে পারে৷ পরিচালক জবাবে পুলিশকে বলেন, ছবিটি যেহেতু সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র নিয়েই প্রদর্শনীর জন্য মুক্তি পাচ্ছে, নতুন করে পুলিশের অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা তিনি দেখছেন না৷ তার পরেই চাপ দিয়ে ছবিটি শহরের সমস্ত হল থেকে তুলে নেয়া হয়৷

‘প্রতিবাদ করা হচ্ছে কিন্তু কিছু নির্লজ্জের কান থাকে যেখানে প্রতিবাদ ঢোকে না’- বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

স্বাভাবিকভাবেই এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, বিশেষত বুদ্ধিজীবী মহলে৷ প্রবীণ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখিতভাবে ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করার এই ফ্যাসিস্ট কায়দার নিন্দা করেছেন৷ প্রতিবাদ করেছেন বর্ষীয়ান পরিচালক তরুণ মজুমদার৷ রবিবার ধর্মতলায় সভা করে এর বিরোধিতা করেছেন শিল্প, সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত মানুষজন৷

আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতিমান বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক, বর্ষীয়ান বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ঘটনাটি প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‌‘‌এটা খুবই নিন্দনীয় একটা ব্যাপার, ভাবাই যায় না৷ আমরা যখন গণতন্ত্রের কথা বলি, তখন একটা সেন্সরড ছবি হলে রিলিজ করেছে, তা পুলিশি নির্দেশে বন্ধ হয়ে গেল!‌ এরকম ঘটনা ভারতবর্ষে, বা পৃথিবীর কোথাও ঘটেছে কি না আমি জানি না৷'‌'

‌বরিষ্ঠ চলচ্চিত্রকাররা কি ভাবছেন এটার প্রতিবাদ হওয়া দরকার?‌ জানানো কি দরকার, যে এভাবে চলতে পারে না?‌ এই প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কটাক্ষ, ‘‌‘প্রতিবাদ তো হচ্ছে! প্রতিবাদ করা হচ্ছে, বলাও হচ্ছে৷ কিন্তু সেটা কানে গেলে তো!‌ কিছু নির্লজ্জের কান থাকে, যেখানে প্রতিবাদ ঢোকে না!‌‌‌'‌'‌ 

অনেকেই মনে করছেন, শেষ কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নন্দন-রবীন্দ্র সদন চত্বরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অজস্র ছবি নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন পরিচালক অনীক দত্ত৷ তাঁর সেই মন্তব্য নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এবং সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক হইচই হয়েছিল৷ তখন থেকেই অনীক দত্ত রাজ্যের শাসক দলের কুনজরে আছেন৷ এবার সরাসরি শাসক দল এবং তার নেতাদের নিয়ে কটাক্ষ করায় ‘‌ভবিষ্যতের ভূত'‌ ছবিটি হল থেকে তুলে নেয়া হলো৷ যদিও সেই বিতর্কের সময় পরিচালক অনীক দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, তিনি খুব ভেবেচিন্তে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি নিয়ে কটাক্ষ করেননি৷ বরং কিছুটা মজা করেই ব্যাপারটা উপস্থাপিত করেছিলেন৷ অনীক তাঁর খারাপ লাগাটা জানিয়েছিলেন এভাবে, যে, ‘‌‘‌ওখানে (‌নন্দনে)‌ সত্যজিৎ বাবুর (‌রায়)‌ করা লোগোটার আশেপাশে ছবিগুলো দেখে খারাপ, মানে কথাটা হলো, খুব দৃষ্টিকটু লেগেছিল৷ ধক করে উঠেছিল৷ যদিও আমরা অন্যভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, শহরে (‌মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেখে)৷ কিন্তু ওইখানে ওইটা দেখে, অনেক অল্প বয়স থেকে তো ওখানে যাচ্ছি, জায়গাটার একটা গাম্ভীর্য আছে৷ খালি গাম্ভীর্য বলব না, আমাদের একটা গর্বের জায়গা ছিল৷ তো সেটা দেখে আমার তখন মনে হয়, আর তার কিছুক্ষণ বাদেই অনুষ্ঠানটা ছিল৷ (‌বিষয়টা)‌ আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল৷ মনে হচ্ছিল, বিষয়টা কী করে বলব৷ বলা উচিত হবে কি না৷ তার পর যখন প্যানেল ডিসকাশনে আমাকে বলতে বলা হলো, তখন আমি একটু মজা করেই, একটু ঘুরিয়ে, যে বিষয়বস্তু ছিল, সেটা নিয়ে একটু মশকরা করেই বলেছিলাম৷'‌'‌ 

‘একটা ছবি, আর্ট, না প্রোপাগান্ডা, ভাল, না খারাপ সেটা দর্শকরা দেখে বিচার করবে’ - অয়ন চক্রবর্ত্তী

কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে, নিজের সিনেমার মধ্যে দিয়ে একই রকমের মশকরা, ব্যঙ্গবিদ্রুপ শাসকের পছন্দ হয়নি৷ যার ফলে পুলিশ এবং প্রশাসনের অলিখিত নির্দেশে, চাপ দিয়ে মুক্তি পাওয়ার একদিন পরেই ‘‌ভবিষ্যতের ভূত'‌ ছবিটি হল থেকে সরিয়ে দেয়া হলো৷ যদিও প্রশাসনের ইচ্ছেয় কোনও সিনেমার প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে গেছে, এই অঘোষিত সেন্সরশিপ পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম ঘটছে না, বললেন নবীন চিত্র পরিচালক অয়ন চক্রবর্তী৷

ডয়চে ভেলেকে তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ‘‌‘এর আগে দেখেছি, (‌জোশি)‌‌ জোসেফের ছবিটা, ‘‌ওয়ান ডে ফ্রম এ হ্যাংম্যান'‌স লাইফ'‌— নন্দনে সেই ছবিটার প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল৷ এবং এত জোরজুলুম করা হয়েছিল, পরিচালককে প্রায় নিজেকেই মইয়ে উঠে হোর্ডিং, ব্যানার খুলে ফেলতে হয়েছিল৷ দেখাতে দেয়া হয়নি৷ এছাড়াও ‘‌র‌্যাম্বো' ছবিটার প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তার কারণ, বলা হয়েছিল অ্যামেরিকাকে গ্লোরিফাই করা হয়েছে, তাই ছবিটা চলতে দেয়া হবে না৷'‌'

‌অয়ন মনে করিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে এর আগে বইও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ তসলিমা নাসরিনের ‘‌ক'‌৷ যে বইটি থেকে তথাকথিত আপত্তিকর অংশ বাদ দিয়ে পরে ‘‌দ্বিখণ্ডিত'‌ নামে প্রকাশিত হয়েছে৷ ‌ফলে নিষিদ্ধকরণের সংস্কৃতি বাংলায় নেই, তা কিন্তু না!‌ এই সংস্কৃতি আগেও ছিল৷ তা সত্ত্বেও অয়ন স্পষ্ট গলায় বলেছেন, অনীক দত্তের ছবিটি নিয়ে যা করা হলো, সেটা খুব খারাপ হলো৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‌‘‌একটা ছবি, সেটা আর্ট, না প্রোপাগান্ডা, সেটা ভাল, না খারাপ - সেন্সর যখন সার্টিফিকেট দিয়েছে, সেটা একদমই দর্শকরা দেখে বিচার করবে৷ অ্যাক্সেপ্ট করলেও দর্শকরা করবে, রিজেক্ট করলেও দর্শকরা করবে৷ এটা আটকানো একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়৷'‌'‌

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান