1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘চর’: একটি তথ্যচিত্র

শীর্ষ বন্দোপাধ্যায়, কলকাতা১৬ জুন ২০১৪

বাংলাদেশ এবং ভারত – এই দুই দেশের মাঝখানে যে নদী বয়ে চলে, তার বুকে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে চর৷ আর ভঙ্গুর সেই চরের জমিতেই বাসা বাঁধে কিছু ছিন্নমূল মানুষ৷

https://p.dw.com/p/1CIQf
তথ্যচিত্র ‘চর'-এর একটি দৃশ্যছবি: Sourav Sarangi

সৌরভ ষড়ঙ্গি নির্দেশিত তথ্যচিত্র ‘চর'-এর প্রথাসিদ্ধ কোনো গল্প নেই৷ আবার আছেও গল্প৷ এক বহতা নদীর গল্প, সেই নদীর খেয়ালখুশির সঙ্গে জুড়ে থাকা কিছু মানুষের বেঁচে থাকার গল্প, নদীর চরের হঠাৎ জেগে ওঠা এবং একদিন নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার মতোই ওই মানুষগুলোর স্বপ্নের ভাঙাগড়ার গল্প৷ ২০১২ সালে তৈরি এই ছবির শুটিংয়ের জন্য প্রায় বছর দুয়েক ভারতের ফারাক্কা বাঁধের দুদিকের গ্রামগুলোতে ঘুরেছেন সৌরভ, কখনও কখনও একটানা থেকেছেন চরের বাসিন্দাদের সঙ্গে, ওদের সুখ-দুঃখের সাক্ষী থেকেছেন৷ তারই ফসল প্রায় দেড় ঘন্টার এই তথ্যচিত্র, যা জার্মানির বার্লিনালে চলচ্চিত্র উৎসব থেকে শুরু করে নানা আন্তর্জাতিক উৎসবে সমাদৃত হয়েছে৷ তবে নিজের দেশে বা নিজের শহরে তথ্যচিত্রটি দেখানোর সুযোগ খুব কমই পেয়েছেন নির্দেশক৷

Indien Bangladesch Filmszene Char
তথ্যচিত্র ‘চর'-এর একটি দৃশ্যছবি: Sourav Sarangi

সম্প্রতি কলকাতায় রুশ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র গোর্কি সদনে ‘চর' দেখার সুযোগ পেলেন আগ্রহী মানুষজন, গোর্কি সদনের আইজেনস্টাইন সিনে সোসাইটি এবং লোকসংগীতের দল দোহার-এর যৌথ উদ্যোগে৷ এই অনুষ্ঠানে তথ্যচিত্রটির ডিভিডি সংস্করণ প্রকাশ করলেন বিশিষ্ট কবি-প্রাবন্ধিক শঙ্খ ঘোষ৷ এবং প্রায় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ দেখে উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারলেন না নির্দেশক সৌরভ ষড়ঙ্গি৷ বললেন, বহু চিত্র পরিচালক তথ্যচিত্র তৈরি করেন, কিন্তু সেসব ছবি আদৌ কতজন দেখবেন, সে নিয়ে তাঁদের সংশয় থাকে৷ কিন্তু এই জনসমাগম দেখে তাঁর বরং প্রত্যয় হচ্ছে যে সিরিয়াস ছবির দর্শক এখনও আছেন৷

যদিও ‘চর' তথ্যচিত্রটির নির্দিষ্ট ধরাবাঁধা কোনও গল্প নেই, কিন্তু চরের বাসিন্দা একটি পরিবারের দিনযাপন নিয়মিত অনুসরণ করেছে সৌরভের ক্যামেরা৷ এই পরিবারের ছেলে রুবেল-এর সঙ্গে প্রায়শই অন্তরঙ্গ কথোপকথন চালিয়েছেন ক্যামেরার পিছনে থাকা নির্দেশক৷ সে অর্থে রুবেল এই কাহিনির এক অন্যতম প্রধান চরিত্র৷ কিন্তু সে কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়৷ কাহিনির মূল নায়ক, অথবা খলনায়ক হল ফারাক্কা বাঁধের কংক্রিট কারাগারে বন্দি হয়ে রাগে ফুঁসতে থাকা এক নদী, নিজের যাত্রাপথে যে রোজ কামড়ে খেতে থাকে উপকূলভূমি, জনপদ, চাষের ক্ষেত৷ লাগাতার ভাঙনে প্রতিদিনই নদীগর্ভে চলে যায় আরও কিছুটা জমি, আশ্রয়হীন হয় আরও কিছু মানুষ৷

রুবেলদের পরিবারও এভাবেই ছিন্নমূল৷ ওরা ছিল বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় ভূখণ্ডের বাসিন্দা৷ রুবেল যখন মাত্র চার বছরের, তখন নদীভাঙনে ওদের বসতবাড়ি, জমি-জিরেত সব হারাতে হয়েছিল৷ তার পর থেকেই ওরা নদীর বুকে জেগে ওঠা চর, যার মালিকানা ভারত-বাংলাদেশ, কোনো দেশেরই নয়, যা কার্যত ‘নো ম্যানস ল্যান্ড', সেই বেওয়ারিস দ্বীপের বাসিন্দা৷ রুবেলের বয়স এখন ১৪ বছর৷ কিন্তু সমবয়সি আর পাঁচজন তরুণের মতো নয় রুবেল৷ ওকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, একা থাকলে কী ভাবিস তুই, মেয়েদের কথা ভাবিস কি, তখন রুবেল প্রথমে স্বাভাবিক নিয়মে লজ্জা পায়, তারপর প্রবল অস্বস্তি নিয়ে সরে যেতে চায়৷

তার কারণ, ১৪ বছর বয়সেই সংসারের দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে হয়েছে রুবেলকে৷ যদিও ও পড়াশোনা করতে চায়৷ বাড়িতে বাবা-মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই রোজ স্কুলে যায়৷ স্কুল ছুটি হওয়ার পর বিপুল ভারি চালের বস্তা ঘাড়ে করে বাড়ি ফেরে, যে চাল পরদিন ভোরে সীমান্তপার কালো বাজারে বিক্রি করে ঘরের জন্যে নুন-তেল, শাক-সবজি খরিদ করে আনে৷ তার পর আবার স্কুলে যায়৷ রুবেলের বাবা সারা বছরই অসুস্থ৷ এদিকে রুবেলের বোনকে চরেরই একটি ছেলের সঙ্গে তড়িঘড়ি বিয়ে দিতে কার্যত বাধ্য হয়েছিল ওরা৷ সেই ছেলের বাড়ি থেকে এখন প্রচুর টাকা পণ চাইছে, বোন ফিরে এসেছে বাড়ি৷

Berlinale 2007
বার্লিনালেতে সমাদৃত হয়েছে ‘চর’ছবি: Barbara Sax/AFP/Getty Images

এ এক অদ্ভুত জীবন, যে বিপন্নতার সঙ্গে আমাদের শহর-গ্রামের নিশ্চিন্তে থাকা জীবনের কোনো সংযো. বা সহমর্মিতার কোনো বিনিময় নেই৷ চরের মহিলারা ফেনসিডিল নামে এক নেশার ওষুধ পাচার করে নিজেদের গায়ে বাঁধা গোপন থলেতে, শুধুমাত্র এই ভরসায় যে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা মেয়েদের গায়ে হাত দেবে না! কিন্তু তাই বলে গভীর রাত অবধি তাদের আটকে রাখতে তো কোনো বাধা নেই! সেনা চৌকিতে রক্ষীদের সঙ্গে ঝগড়া চলে মেয়েদের৷ রাত গড়িয়ে যায়, কেউ বাড়ি ফিরতে পারে না৷ অথচ অনেকের বাড়িতেই উনুন ধরানোর, রান্না চড়াবার কেউ নেই, বরং অসুস্থ, অথর্ব মানুষই বেশি৷

সৌরভ ষড়ঙ্গির তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে এই মানুষগুলোর কথা, যারা ওই বেওয়ারিস নদী-চরের মতোই বেওয়ারিস, বাতিল কিছু মানুষ অথচ যারা হার মানতে চায় না৷ বুভুক্ষু নদী যতই ওদের পায়ের তলার মাটি কেড়ে নেয়, ততই মরীয়া হয়ে ওরা খুঁজে নেয় বেঁচে থাকার নতুন ঠিকানা, নতুন চর!

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য