1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মরণোত্তর দেহ বা অঙ্গ দানে সংস্কারের বেড়াজাল

সঞ্জয় দে
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশে মরণোত্তর দেহ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গদানের ক্ষেত্রটি এখনো আটকে আছে বিভিন্ন আইনি জটিলতা, প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা এবং সর্বোপরি সামাজিক ও ধর্মীয় নানা সংস্কারের বেড়াজালে৷

https://p.dw.com/p/3PvDP
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Mohai

রাষ্ট্রীয়ভাবে বিষয়টিকে উৎসাহিত করার পদক্ষেপের ক্ষেত্রেও উদাসীনতা প্রকটভাবে লক্ষ্যণীয়৷  অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের ক্ষেত্রে সমন্বিত কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায়, বিষয়টি এখনো ব্যক্তিপর্যায়ে সীমাবদ্ধ৷ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে৷

মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯ সংশোধন করা হয় ২০১৮ সালে৷ এর ফলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানও গ্রহণের ক্ষেত্রে আত্মীয়ের পরিধি কিছুটা বেড়েছে৷ আগের আইনে শুধু ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এবং রক্ত সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা ও খালা- এই ১২ জন শুধু আইনত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণ করতে পারতেন৷ তবে সংশোধিত আইনে আপন নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি, আপন চাচাতো-মামাতো-ফুপাতো-খালাতো ভাই-বোনকেও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ এছাড়া মৃত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যের শরীরে সংযোজনের সুযোগ রাখা হয়েছে৷ আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বলতে কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, অন্ত্র, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চোখ, চর্ম, টিস্যুসহ মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বোঝানো হয়েছে৷

সাগর লোহানী

তবে আইনে যা-ই থাকুক বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় কেবল কিডনি, চোখ, যকৃতের মতো অল্প কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন সম্ভব৷ তার মানে হলো, কেউ মরণোত্তর দেহদান করলেও তার মাত্র কয়েকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যের দেহে সংযোজন করার সুযোগ রয়েছে, বাকি সবই নষ্ট হয় শুধু ব্যবস্থাপনার অভাবে৷ মরণোত্তর দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানে সহায়তা করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে কাজ করছে ব্যক্তি উদ্যোগের সংগঠন- ‘মৃত্যুঞ্জয়'৷ এর সমন্বয়ক সাগর লোহানী বলছেন, তাদের সংগঠনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ জন মরণোত্তর দেহ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের অঙ্গীকার করেছেন৷ তিনি বলছেন, বিষয়টিতে জনসচেতনতার অভাবই কেবল প্রকট নয়, মৃত্যুর পর দান করা দেহ কারা, কীভাবে নেবে সেখানেও রয়েছে অনেক জটিলতা৷

অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের আগের আইনটি সংশোধনের পর কিছুটা আধুনিক হলেও এখনো অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে বলে মনে করছেন সাগর লোহানী৷ এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, কিছু কিছু বিষয় এ আইনে যুক্ত করার প্রস্তাব তারা করেছিলেন, যা শেষপর্যন্ত সংশোধিত আইনে আসেনি৷ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলছেন, দেশে প্রতিবছর বহু মানুষ অগ্নিদদ্ধ হন, যাদের চিকিৎসায় চামড়া প্রতিস্থাপন প্রয়োজন৷ একজন জীবিত মানুষ তার দেহের চামড়ার কিছু অংশ দান করতে পারেন, কিন্তু আইনে দাতাদের সুনির্দিষ্ট করে দেয়ার ফলে অন্য কারো এটা দান করার সুযোগ নেই৷

রাজধানী ঢাকায় মরণোত্তর দেহ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগে এফিডেভিটের মাধ্যমে অনেকেই মত্যুর পরে দেহদানের অঙ্গীকার করছেন৷ তবে ঢাকার বাইরে এ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময়ে নিরুৎসাহিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে৷ এজন্য মূলত মেডিকেল কলেজের সাধারণ কর্মীদের দায়ী করছেন সাগর লোহানী৷ এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছেন, সম্প্রতি সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক নাট্যকর্মীর মরদেহ দান করতে কোনো সমস্যা হয়নি৷ তবে বেশ কয়েকজন মুসলিম সেখানে দেহদানের অঙ্গীকার করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ এর পেছনে ধর্মীয় কারণ ছাড়াও দরিদ্র পরিবারের কাছ থেকে চড়া দামে তাদের স্বজনের মৃতদেহ অ্যানাটমি বিভাগের জন্য কেনার একটি অবৈধ বাণিজ্য জড়িত বলেও মনে করছেন তিনি৷ 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি বিভাগ ২০০৩ সালে প্রথম দান করা একটি মরদেহ পায়৷ এখন পর্যন্ত এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা সব মিলিয়ে ১২ জনের দান করা দেহ গবেষণার জন্য পেয়েছেন৷ আর সেখানে ভবিষ্যতের জন্য মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন ১৮ জন৷ তাদেরই একজন এটিএন নিউজের জ্যেষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপক আঁখি ভদ্র৷ আঁখি বলছিলেন, মৃত্যুর পরে চিকিৎসা গবেষণায় যাতে কাজে লাগে সেই উদ্দেশ্যেই তার এমন সিদ্ধান্ত৷ গত ভ্যালেন্টাইন ডে-তে তার মরণোত্তর দেহদানের ঘটনায় পরিচিত অনেকেই উৎসাহিত হয়েছেন৷ 

ডা. মো. জয়নাল আবদিন

আঁখি ভদ্র একই দিনে সন্ধানীতে মরণোত্তর চক্ষুদানও করেন৷ সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটি ও সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক, বাংলাদেশ-এর মহাসচিব ডা. মো. জয়নাল আবদিন জানালেন, ১৯৮৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তারা সাড়ে ৩ হাজার কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করেছেন, যার মধ্যে দাতার কাছ থেকে পাওয়া কর্নিয়া মাত্র ১৬০ থেকে ১৭০টি৷ মরণোত্তর চক্ষুদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন বেওয়ারিশ মৃতদেহের ওপর নির্ভরশীল ছিল সন্ধানী৷ তবে পরিবর্তিত আইনে কোনো মৃতদেহ বেওয়ারিশ ঘোষণার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন, আর কর্নিয়া সংগহ করতে হয় ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার মধ্যে৷ ফলে বেওয়ারিশ মৃতদেহ থেকে এখন কর্নিয়া সংগ্রহ করা অসম্ভব৷ সে কারণেই মরণোত্তর চক্ষুদান ক্যাম্পেইন জোরদার করার ওপর জোর দিচ্ছেন ডা. আবদিন৷ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চক্ষুদানে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই দাবি করে তিনি তুলে ধরছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ, যেখানে ধর্মীয় নেতারাই বিষয়টিকে এগিয়ে নিতে জনসাধারণকে উদ্ধুদ্ধ করছেন৷ ডা. আবদিন বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও সংশ্লিষ্ট এলাকার চিকিৎসকের অনীহার কারণে দাতার মৃত্যুর পর কর্নিয়া সংগ্রহ করা যায় না৷ এমনকি দাতার মৃত্যুর অনেকক্ষেত্রে স্বজনের বাধার মুখেও পড়তে হয় সন্ধানী কর্মীদের৷ ফলে একটি সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা সৃষ্টির তাগিদ দিচ্ছেন তিনি৷ 

বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় কর্নিয়া প্রতিস্থাপন কতটা দুরাবস্থায় আছে তার একটি হিসাব পাওয়া যায় সন্ধানীর পরিসংখ্যানে৷ ডা. আবদিন বলছেন, দেশে প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়, তাদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশের কর্নিয়া পাওয়া গেলে সংখ্যাটি হতে পারত ৪০ হাজার৷ অথচ বাস্তবতা হলো- প্রতিবছর সন্ধানী মাত্র ৫০ থেকে ৬০টি কর্নিয়া পাচ্ছে৷ এর বিপরীতে কর্নিয়ার অভাবে অন্ধত্বে ভুগছে ৫ লাখের বেশি মানুষ৷ 

দেশে সীমিত পরিসরে দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান আসলে চাহিদার মহাসমুদ্রে এক ফোটা শিশিরবিন্দু মাত্র৷ একে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকার-হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমন্বিত ভূমিকা যেমন প্রয়োজন, তেমনি দরকার মানবতার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষের এগিয়ে আসা৷ দরকার জেঁকে বসে থাকা সামাজিক ও মানসিক ট্যাব্যু ভাঙা৷ মানুষ মানুষেরই জন্য- এমন উপলব্ধিই পারে মরোণত্তর দেহ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানে একজন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে৷

সাংবাদিক সঞ্জয় দের লেখাটি কেমন লাগলো জানান বন্ধুরা, লিখুন নীচের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য