1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মহরমে বিরল দৃষ্টান্ত গড়লেন মুসলমানরা

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মহরমে রক্তপাতের বদলে রক্তদান শিবির করে সহিষ্ণুতা ও ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে বার্তা দিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের মুসলমানরা৷ সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে এ উদ্যোগ৷

https://p.dw.com/p/35OPN
Indien Muharram
ছবি: DW/P. Samanta

সক্রিয় বিভেদের রাজনীতি

ভারতে লোকসভা নির্বাচন আর কয়েকমাস পর৷ তার আগে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এক নয়া মোড়ে দাঁড়িয়ে৷ স্বাধীনতার পর থেকে এ রাজ্যে ডান ও বামপন্থিদের মধ্যে লড়াই হয়েছে৷ কিন্তু বামেরা দুর্বল হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির উত্থান ঘটছে৷ তৃণমূল কংগ্রেসকে ‘ছদ্ম-সেকুলার' বলে তারা মুসলমান তোষণের অভিযোগ আনছে৷ এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে অভূতপূর্বভাবে অস্ত্র হাতে রামনবমীর মিছিল হয়েছে দিকে দিকে৷ তার পালটা ব্যবস্থা হিসেবে হনুমান জয়ন্তী পালনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তৃণমূল৷ ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন ও ভোটে বাজিমাত করার এ কৌশলের বিপরীতে মানবতার মহান বার্তা মিলল আউশগ্রামের কৃষিজীবী মানুষের কাছ থেকে৷

রক্তপাত নয়, মহরমে এবার রক্তদান

বর্ধমানের আউশগ্রাম-২ নম্বর ব্লকের ভেদিয়া অঞ্চলের একটি গ্রাম ব্রাহ্মণডিহি৷ গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী বা জনমজুর৷ মুসলমান অধ্যুষিত এই গ্রামে এবার মহরম পালিত হলো অন্যভাবে৷ শোকের এই দিনটিতে নিজেদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রক্তাক্ত করা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চিরাচরিত পরম্পরা৷ সেই পরম্পরা এই প্রথম ত্যাগ করল ব্রাহ্মণডিহির মানুষ৷ এখানকার মহরম কমিটির কর্তারা সিদ্ধান্ত নেন, রক্তপাত করে তাঁরা রক্তের অপচয় আর হতে দেবেন না৷ যে রক্ত মাটিতে পড়ে নষ্ট হচ্ছে, তা তাঁরা কাজে লাগাতে চান রোগীর চিকিৎসায়৷ এই প্রস্তাবে গ্রামবাসীরা সহমত হওয়ায় এবার মহরমের আগে গ্রামের মসজিদতলার কাছে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল৷ সেখানে রক্ত দিয়েছেন ১১০ জন৷ গ্রামে মহিলারাও উৎসাহ ভরে দিয়েছেন রক্ত৷ এই রক্ত জমা পড়েছে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে৷

‘এভাবে রক্ত নষ্ট হতে দেবো না, রক্তদান শিবিরের আয়োজন করবো’

ধর্মের নামে আক্রোশ নয়, মানবতাই ধর্ম

সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গ রামনবমীর দিন হিংসা দেখেছে৷ গেরুয়া শিবিরের তরফে বলা হয়েছিল, অন্য ধর্মের মিছিল যদি সশস্ত্র হতে পারে, তবে রামনবমী সশস্ত্র হতে আপত্তি কোথায়? সে কারণেই হিন্দু পার্বণে মিছিলের নামে গেরুয়া ঝান্ডাধারী বাইকবাহিনীর যে দাপট রাস্তায় দেখা গিয়েছে, তা পশ্চিমবঙ্গে কয়েক বছর আগে বিরল দৃশ্য ছিল৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাহ্মণডিহির এবারের মহরম অনেক তাৎপর্যপূর্ণ৷ সেখানে কোনো অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল না৷ রক্তদান শিবিরের খবর আশেপাশের গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিল৷ সেই খবর পেয়ে কাছের গ্রাম কুলটিকারি থেকে চলে আসেন কয়েকজন উৎসাহী যুবক৷ তাঁরাও চেয়েছিলেন রক্ত দিতে৷ ধর্মের বেড়া ভেঙে গ্রামের হিন্দুরাও রক্ত দিয়েছেন এই শিবিরে৷ রক্তদান করে তুফান মাজি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এই মহরম উপলক্ষে আয়োজিত রক্তদান শিবিরে রক্ত দিয়ে আমি গর্বিত ৷ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ২৫০ জনের মতো উপস্থিত হয়েছিলেন রক্তদানের জন্য৷ কিন্তু ১০০ জনের রক্ত নেওয়ার মতো ব্যবস্থা ছিল৷ তাই অনেকেই রক্ত দিতে পারেননি৷''   

মৌলবাদ বনাম সমাজিক আন্দোলন

পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রাদয়িক টানাপোড়েনের জের কতটা ভয়ানক হতে পারে তার বাস্তবায়ন দেখা গিয়েছে উলুবেড়িয়া থেকে বাদুড়িয়ায়৷ সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মনের মধ্যে থাকা প্রতিহিংসার ছবিটাকে সামনে এনেছে৷ এই যখন গোটা রাজ্যের পরিস্থিতি, সেখানে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে আউশগ্রামের ব্রাহ্মণডিহি৷ ধর্মের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত হয়ে কার্যত এক সমাজ বিপ্লবের সূচনা করেছেন শেখ নাসিরুল, আজিজুল শেখ, নুর জামাল মণ্ডলের মতো সাধারণ কৃষক ঘরের সন্তানেরা৷ সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে এক নয়া সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তাঁরা কার্যত পাহাড় ডিঙিয়েছেন৷   

‘এই রক্তদান শিবির একটা আশীর্বাদ’

এ কাজে যিনি নেতৃস্থানীয়, সেই শেখ নাসিরুল এই গ্রামেরই বাসিন্দা৷ তৃণমূল কংগ্রেসের ব্লক সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান নাসিরুলের কাছে ডয়চেভেলে প্রশ্ন রেখেছিল, কীভাবে তা সম্ভব হলো? তিনি বলেন, ‘‘গ্রামে প্রতিবছর মহরম উপলক্ষে ব্লেড মাতম, ছুরি মাতম, জিঞ্জির মাতম হয়৷ এতে প্রচুর রক্তপাত হয়৷ সেই রক্ত নষ্ট হয়ে যায়৷ তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, এভাবে রক্ত নষ্ট হতে দেবো না, রক্তদান শিবিরের আয়োজন করবো৷''

এমন মহতী ভাবনা মাথায় এলেই বাস্তবায়িত করা যায় না৷ ধর্মীয় বিশ্বাসের বাধা পার করে মহরম উপলক্ষে এ কাজ করা খুবই কঠিন৷ নাসিরুল মহরম কমিটির কাছে এ প্রস্তাব দেন৷ মহরম কমিটি প্রস্তাবটি নিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করে৷ মহরমের শোক-মাতমে রক্ত নষ্ট না করে তা রোগীর জন্য দান করার প্রস্তাবে প্রথমে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, সারা বছরই তো রক্তদান করা যেতে পারে৷ তাহলে মহরমের পার্বণে কাটছাঁট করা কেন? নাসিরুল তাঁদের রক্তদানের গুরুত্ব বোঝাতে পেরেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘গ্রামবাসীদের বলেছি, মহরম উপলক্ষে রক্ত দিলে তার গুরুত্ব অনেক বেশি৷ সেটা অনেক বড় ধর্ম পালন৷'' এরপর গ্রামবাসী আর অমত করেননি৷ ব্রাহ্মণডিহির মসজিদের ইমাম শেখ নবি হাসান বলেন, ‘‘শরিয়ত মোতাবেক আমরা জানি রক্তদান মহৎ দান, রক্তদান জান দান৷ গ্রামবাসীদের এটাই বুঝিয়েছি৷ মহরম কমিটির প্রস্তাবে আমরা সম্মতি জানিয়েছি৷ আগামী দিনে মহরম উপলক্ষে রক্তদান শিবিরকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই৷'' এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আউশগ্রামের বিধায়ক অভেদানন্দ থান্ডার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগামী দিনে এই কাজ আরো গুরুত্বের সঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত৷ এতে সমাজের উপকার হবে৷''

‘ছোটবেলায় দেখেছি, নিচুতলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিরোধ নেই’

বিভেদের রাজনীতি আর কতদিন?    

এক ধর্মের সাম্প্রদায়িকতা অন্য ধর্মের মৌলবাদে ইন্ধন জোগায়৷ অনেকেই অভিযোগ তুলছেন, তৃণমূল সরকারের সংখ্যালঘু তোষণ, অনুমোদনহীন মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি, গভীর রাত পর্যন্ত মাইক বাজিয়ে ইসলামিক ধর্মীয় সমাবেশের আয়োজন বেড়েছে গত কয়েকবছরে৷ তারই বিপরীতে বামেদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার সুযোগ নিয়ে এ রাজ্যে বাড়ছে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাব৷ গত কয়েকটি নির্বাচনে এর প্রমাণ মিলেছে ভোটবাক্সে৷ এই পরিস্থিতিতে মানবধর্মের খোঁজে ব্রাহ্মণডিহির সাহানারা খাতুন, জোৎস্না বেগমের মতো ৩০ জন গ্রাম্য মহিলাও রক্তদান করে মহরম পালন করেছেন৷ একে আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন  বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমন, তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এই রক্তদান শিবির একটা আশীর্বাদ৷ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট বিজেপি কোনো গণতান্ত্রিক শক্তিকে রেয়াত করছে না৷ এই পরিস্থিতিতে বাঙালি দেখাচ্ছে, তারা এ ধরনের কাজ করতে পারে৷ তাই আমাদের কাছে এটা আশীর্বাদ৷ ইতিহাসের আশীর্বাদ৷''  

‘শরিয়ত মোতাবেক আমরা জানি রক্তদান মহৎ দান, রক্তদান জান দান’

ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পরও যে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই যে ভারতবাসীর মূল পুঁজি, তা সাহানারা, জ্যোৎস্না, নাসিরুল, তুফানরা ফের প্রমাণ করেছেন৷ সাহিত্যিক আবুল বাশারের মতে, ‘‘এটাই আমাদের দেশের প্রকৃত ছবি৷ আমরা ছোটবেলা থেকে এটাই দেখে এসেছি৷ একেবারে নিচুতলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই৷ বরং জীবিকার তাগিদে তাঁরা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল৷ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে থাকে৷ তাই একই নৌকার সওয়ারি হন মুসলমান মাঝি ও হিন্দু ধীবর৷'' এ জন্যই আউশগ্রামের রক্তদান শিবিরকে যথার্থ ভারতীয় পরম্পরা বলে মনে করছেন বিশিষ্ট এই সাহিত্যিক৷ তিনি বলেন, ‘‘মহরমের মাতমের বদলে রক্তদান শিবির করা অসাধারণ উদ্যোগ৷ গ্রামের সাধারণ গরিব মানুষ এ ধরনের কাজ করতে পারেন৷ কিন্তু দেখা যায়, রাজনীতি তাঁদের মধ্যে বিদ্বেষ আরোপ করে৷ বিভেদ তৈরি করতে চায়৷''

একটা রক্তদান শিবির যে সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করতে পারে, তার লক্ষণ ইতিমধ্যে মিলতে শুরু করেছে৷ মহরমের দিন দেখা গেছে আরেক ছবি৷ সেদিন পাশের গ্রামের বাসিন্দারা মাতম করতে করতে চলে এসেছিলেন নাসিরুলদের গ্রামে৷ ব্রাহ্মণডিহির মানুষ রক্তপাত থামিয়েছেন৷ মাতমে রক্তাক্ত প্রতিবেশী গ্রামের বাসিন্দাদের তাঁরা বুঝিয়েছেন, এভাবে রক্ত নষ্ট করা উচিত নয়, আর্তের সেবায় রক্তদান আরো বড় ধর্ম৷ তাই এখন নাসিরুলদের মহরম উদযাপনকে আদর্শ বলে মনে করছে আশেপাশের সাতটা গ্রামের মহরম কমিটি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য