1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মহানায়কের স্মৃতিপথে ছায়াসঙ্গী শম্ভু

পায়েল সামন্ত
২৪ জুলাই ২০১৭

কাশীপুর উদ্যানবাটির মূল প্রবেশদ্বারের কাছেই সরকারি আবাসনে একতলা বসার ঘর৷ দেওয়াল জুড়ে সাজানো অনেক সাদা-কালো ফ্রেম৷ সেখানে হাসছেন উত্তমকুমার৷ এ সব ছবি আজ স্মৃতির আকর৷ এক অশীতিপর বৃদ্ধের বেঁচে থাকার রসদ...৷

https://p.dw.com/p/2h3ND
Todesjubiläum Uttam Kumar - Schauspieler
ছবি: P. Samanta

মহানায়কের ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাংলা চলচ্চিত্রের সেই ডাকসাইটে অভিনেতা, তথা শম্ভু ভট্টাচার্যের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় মেতেছিল ডয়চে ভেলে৷ চিত্র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য গবেষক গোপাল দাস৷

২৪ জুলাইয়ের কথা পাড়তেই সেই দিনটায় ফিরে গেলেন ‘সন্ন্যাসী রাজার' নিতাই৷ তাঁর ঋজু স্বাস্থ্য কেড়ে নিয়েছে সময়৷ ছবির সেই দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ মানুষটির সঙ্গে আজকের শম্ভু ভট্টাচার্যকে মেলানো যায় না৷ এখন অনেকটাই শীর্ণকায়, তবে কণ্ঠস্বরের বলিষ্ঠতায় তিনি এখনও সেই চম্বলের ডাকাত লাখন সিং৷ ২৪ জুলাই এলেই সেই ফোনটা এখনও তাঁর কানে বাজে৷ উত্তমকুমার তখন হাসপাতালে ভর্তি৷ ফোন এসেছিল বাংলার আরেক দিকপাল অভিনেতা রবি ঘোষের৷ কী বলেছিলেন তিনি? শম্ভুবাবু বলেন, ‘‘রবিদা বললেন, শম্ভু শুনেছিস খবরটা? আমি বললাম, কী খবর? রবিদা বললেন, উত্তমদা আর নেই৷ কথাটা শুনেই বুক ফেটে গেল৷ রবিদা ময়রা স্ট্রিটে চলে যেতে বললেন৷ তখন রাত ১০টা বেজে গেছে৷ ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম৷ তখনই সেখানে বেশ ভিড়৷ রবিদা, তরুণদা (তরুণ কুমার) ছিলেন৷''

আর কে কে ছিলেন সেখানে? প্রবীণ স্মৃতি হাতড়ে বলেন, সবার কথা মনে পড়ে না৷ তবে সুচিত্রা সেনের ছবিটা চোখে ভাসে৷ ময়রা স্ট্রিটে পৌঁছে উত্তমদার দেহের দিকে অপলক চেয়ে ছিলেন৷ অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াননি...৷

‘ভাবিনি এত সহজে তাঁর দেখা পাবো’

এ সব কথা বলতেই একতলার ঘরটায় যেন উত্তম কুমার এসে বসলেন৷ ছবিতে তখনও হাসিতে উচ্ছ্বল মহানায়ক৷ তাতেই যেন বিষাদের ঘনঘটা কেটে যাচ্ছিল৷ গোপাল দাস খেই ধরিয়ে দিলেন, ‘সন্ন্যাসী রাজা', ‘অমানুষ', ‘ধনরাজ তামাং', ‘সব্যসাচী' – এ রকম অনেক ছবিতে আপনি উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন৷ সেই গল্প আমাদের একটু বলুন না৷

এই প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধের চোখমুখ পর্দার মতো দৃপ্ত হয়ে ওঠে৷ বলেন, ‘‘কত ছবিই তো করেছি৷ ২৬-২৭টা তো বটেই৷ সব কটা ছবির নাম এখন আর মনে করতে পারি না৷ উত্তমদার সম্পর্কে বলতে গেলে কোথা থেকে শুরু করব, বুঝতে পারি না৷'' প্রবীণকে ফের খেই ধরিয়ে দিতে হয়৷ বললাম, আপনার সঙ্গে মহানায়কের প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটা বলুন৷ এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার জন্য এক মুহূর্তও ভাবতে হয় না শম্ভুবাবুকে৷ যেন এই সে দিনের ঘটনা৷ বৃদ্ধ বলেন, ‘‘তখন আমি বাগবাজারে থাকতাম৷ আমরা কয়েকজন উত্তমভক্ত মিলে ঠিক কর লাম মহানায়কের শুটিং দেখব৷ ৪-৫ জন মিলে টালিগঞ্জের এন টি ওয়ান স্টুডিওতে হাজির হলাম৷ আমরা একেবারে শুটিং ফ্লোরে চলে গেলাম৷ প্রোডাকশনের একজনকে বললাম, আমরা উত্তমবাবুর ভক্ত৷ ওঁর সঙ্গে দেখা করেই চলে যাবো৷ ভাবিনি এত সহজে তাঁর দেখা পাবো৷ খবর পেয়ে কিছুক্ষণ পর উনি ফ্লোরে এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ করলেন৷ আমরা তখন তাঁকে দেখে মুগ্ধ৷ আমাদের অবাক করে বললেন, যখন ইচ্ছে হবে, তখনই চলে আসবেন৷''

উত্তমকুমারের সঙ্গে শম্ভু ভট্টাচার্য প্রথম অভিনয় করেন ‘ছিন্নপত্র' ছবিতে৷ তখন থেকেই দু'জনের সখ্য৷ আমাদের আড্ডার ফাঁকে চলে এসেছে চা-বিস্কুট৷ উত্তমকুমারের ছবি দেয়াল থেকে নেমে তখন শম্ভুবাবুর কোলে৷ ছবিতে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে বৃদ্ধ বলেন, ‘‘দাদার জন্য বড় বড় ছবিতে আমি কাজের সুযোগ পেয়েছি৷ তাঁর কথায় পরিচালক শক্তি সামন্ত আমাকে ‘অমানুষ' ছবিতে কাজের সুযোগ দিয়েছিলেন৷ বাংলা ও হিন্দি দু'টো ভার্সানেই৷ দাদার কথায় আমি শক্তিদার কাছে গেলাম৷ পরিচালকের আমাকে পছন্দ হলো৷ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, রেমুনারেশন কত লাগবে? আমি বললাম, উত্তমদা পাঠিয়েছেন, তাই টাকা আমি নিতে পারব না৷ কিন্তু শক্তিদা নাছোড়৷ তখন আমি প্রতিদিন একটাকা করে চাইলাম৷ শক্তিদা খুশি হয়ে বললেন, আপনি সিলেক্টেড৷ আর টাকা পয়সার ব্যাপারটা আমি বুঝে নেব৷''

‘সুচিত্রা সেন এলেন, চোখ দিয়ে পটপট করে জল পড়তে লাগল’

বয়সের সঙ্গে তারুণ্য বিদায় নিয়েছে৷ কিন্তু আড্ডার আসরে শম্ভুবাবুকে দেখে সেটা মনে হচ্ছিল না৷ মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়া, নড়বড়ে শরীরে লাঠি হাতে চলাফেরা করা প্রবীণ ৬০-৭০ দশকের তেজ যেন ফিরে পেয়েছেন৷ এমন একজন মানুষের কাছ থেকে ব্যক্তি উত্তমকুমার সম্পর্কে জানার তাগিদ থাকেই৷ সেই প্রশ্ন করতেই আবার গল্পে ফিরে গেলেন বৃদ্ধ৷ চোখদু'টো চিকচিক করে উঠল৷ বললেন, ‘‘সে তো কত ঘটনা! আমার ওপর দাদা খুব ভরসা করতেন৷ যেখানেই শুটিং হতো, দাদা পরিচালকদের বলে দিতেন, শম্ভুকে যেন আমার পাশের ঘরে থাকতে দেওয়া হয়৷ একসঙ্গে কত সুন্দর সময় কাটিয়েছি৷''

‘‘তবে ব্যক্তি উত্তমকে জানতে হলে একটা ঘটনার কথা বলতেই হয়৷ তারিখটা আমার মনে পড়ে না৷ তবে মনে পড়ে, কলকাতার একটা নার্সিংহোমে ‘সন্ন্যাসী রাজার' পরিচালক পীযূষ বসু মারা গেলেন৷ ঐ একই নার্সিংহোমে সেদিনই উত্তমদার বড় ছেলে গৌতমের মেয়ে জন্ম নিয়েছিল৷ পাবলিকের হাঙ্গামা এড়াতে অনেক রাতে দাদা নার্সিংহোমে এলেন৷ একতলায় পীযূষদাকে শেষবার দেখে দোতলায় আর নাতনিকে দেখতে যাননি৷...''

‘পরিচালককে পুরস্কার না দেয়ায়, মহানায়ক পুরস্কার নেননি’

চায়ে চুমুক দিয়ে বৃদ্ধ বলে চলেন, ‘‘বাবাকে গৌতম বলল, তুমি নাতনিকে একবার দেখবে না বাবা? দাদা জবাব দিলেন, না গৌতম, আজ আমি পীযূষদাকে দেখতে এসেছি৷ নাতনিকে আজ আমি দেখতে আসিনি৷ খ্যাতির শীর্ষে থাকা এক অভিনেতা পেশাদারিত্ব ছাপিয়ে তাঁর পরিচালকের সঙ্গে কতটা জড়িয়ে পড়েছিলেন, এটাই তাঁর প্রমাণ৷ ব্যক্তিগত সম্পর্কে আমিও এই উষ্ণতা পেয়েছি৷''

প্রবীণের এই কথার রেশ ধরে গোপাল বাবু আরেক পরিচালকের কথা পাড়লেন৷ তিনি ‘ধন্যি মেয়ে', ‘অগ্নীশ্বর', ‘মৌচাক' এবং ‘নিশিপদ্ম'-র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৷ এই ছবিগুলিতে উত্তমকুমারকে নায়কের ঘেরাটোপ থেকে বের করেছিলেন অরবিন্দ বাবু৷ সদ্যপ্রয়াত পরিচালকের জীবন ও কাজের উপর নিরন্তর গবেষণা করে চলা গোপালবাবু ব্যক্তি উত্তমের আরেকটি ছবি আড্ডায় তুলে ধরলেন৷ ‘অগ্নীশ্বর'-এর জন্য বিএফজেএ পুরস্কার পেয়েছিলেন মহানায়ক৷ কিন্তু সেই পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেন৷ কেন? এই গল্প গোপালবাবু অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকেই শুনেছেন৷ বলেন, ‘‘মহানায়ক জানতে পারেন যে অভিনয়ের জন্য শুধু তাঁকেই পুরস্কৃত করা হচ্ছে, ছবি বা ছবির পরিচালককে পুরস্কারের জন্য বাছা হয়নি৷ এটা শুনে মহানায়ক পুরস্কার নেননি৷''

স্মৃতির সরণী ধরে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে ফিরে এলাম বর্তমানে৷ ২৪ জুলাই টিভির পর্দায় বিভিন্ন ছায়াছবি বা অনুষ্ঠানের মঞ্চে বাঙালির মহানায়ক ফিরে ফিরে আসেন৷ সে সবে চোখ রাখেন বছর তিরাশির শম্ভুবাবু৷ তাঁর স্মৃতিপটে ‘দাদা' যে আজও অমলিন৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য