1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মানসিক রোগী কে, মানসিক সমস্যা কার?

২০ নভেম্বর ২০২০

পাগল, পাগলা গারদ ইত্যাদি শব্দ আমরা পাল্টে তুলনামূলক মানবিক শব্দ মানসিক রোগী, মানসিক হাসপাতাল করেছি৷ কিন্তু ছিন্নমূল রোগী দেখলে রাস্তায় তাকে উত্যক্ত করা বা কাউকে ঠাট্টা করে মানসিক রোগী বলে দেয়ার মানসিকতা কি পাল্টেছে?

https://p.dw.com/p/3laxr
Bangladesch Mental Hospital, Pabna
ছবি: imago/UIG

ছোটবেলায় পাগলদের মনে হত সমাজের এক ধরনের বিষফোঁড়ার মতো৷ হবে নাই বা কেন! সেই ছোটবেলাতেই দুষ্টুমি করলে বড়রা ভয় দেখাতেন ‘পাগলা গারদে' পাঠিয়ে দেয়ার৷ সেখানে পাগলদের গারদে আটকে রাখা হয়৷ পাগল এবং ‘পাগলা গারদ' সম্পর্কে এক অজানা ভয় কাজ করতো সবসময়৷

রাস্তায় প্রায়ই ছেঁড়া কাপড় পরা উষ্কুখুস্কু চুলের মানুষের পেছন পেছন একদল ছেলেপিলেকে ভ্যাংচাতে ভ্যাংচাতে হাঁটতে দেখতাম৷ ঢিল ছোঁড়া, কাপড় ধরে টানার এক পর্যায়ে সেই ব্যক্তি তেড়ে আসতেন, এটাই ছিল ছেলেদের নির্মম মজার উৎস৷ দীর্ঘদিন এমন দেখতে দেখতে ধারণা হয়েছিল, এটাই হয়তো স্বাভাবিক৷

সে পরিস্থিতি পালটেছে, কিন্তু আসলেই কি পালটেছে?

কয়েক বছর আগে পাবনা যাওয়া হয়েছিল একটি কাজে৷ ফেসবুকে সেটি দেখেই একের পর এক মন্তব্য আসতে থাকলো৷ কেউ জানতে চাইলেন আমার মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে কিনা, কেউ পরামর্শ দিলেন ‘পাগলা গারদ' দেখে আসার৷

কোথাও গেলে আমি সে এলাকার সব দর্শণীয় স্থান ঘুরে দেখার চেষ্টা করি৷ কাজের ফাঁকে সময় বের করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, জোড় বাংলা মন্দির ঘুরে দেখা হলো৷ কিন্তু মানসিক হাসপাতাল কি আসলে কোনো দর্শনীয় স্থান হতে পারে? এ নিয়ে খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম৷

কিন্তু এ কী! খোদ পাবনার সরকারি ওয়েবসাইটে অন্য সব দর্শণীয় স্থানের মধ্যে শোভা পাচ্ছে মানসিক হাসপাতালের নাম! এই লেখা লেখার সময়ও সেটি ওয়েবসাইটে ছিল৷ শেষে অনেকটা আগ্রহের বশেই দেখতে গেলাম ওয়েবসাইটের ভাষায় ‘মানসিক চিকিৎসায় দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান'৷

ভবনের দোতলার এক জানালায় একজনকে দেখলাম দাঁত ব্রাশ করছেন, আর আপন মনে গান গাইছেন৷ আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ওই, গান গাইতে পারোস?’’ আমিও কি বুঝে জানি বললাম, ‘‘কিছুটা৷’’ ‘‘তাইলে উপরে আয়’’, বলে ভেতরে চলে গেলেন ভদ্রলোক৷ প্রাইভেসির জন্য তার ছবি না তুললেও, সে জানালার ছবি তুলে এনেছি আমি৷ মনে মনে ভাবছিলাম, এত সুন্দর কণ্ঠে আপনমনে গান গাইতে পারেন যিনি, তার না জানি কী হয়েছিল!

ভবনের মূল ফটকে নোটিস টানানো ‘অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ'৷ খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, প্রচুর পর্যটন ‘পাগলা গারদ' দেখতে আসার নাম করে ভেতরে ঢোকে রোগীদের যন্ত্রণা দিতো৷ ফলে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে মানুষের আনাগোনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷

ফিরে আসার সময় বাইরের এক চায়ের দোকানে বসেছিলাম৷ সেখানে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কয়েকজন স্থানীয় বয়স্ক মানুষ জমিয়ে আলাপ করা শুরু করলেন৷ তাদের মুখ থেকেই শুনলাম কিভাবে সুস্থ-সবল মানুষকে জমি বা অন্য কোনো বিবাদের জেরে মানসিক রোগী বানিয়ে এই হাসপাতালে জোর করে ভর্তি করা হয়৷ তাদের অভিযোগ ছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনেকেই ‘অনৈতিক লেনদেনের' মাধ্যমে এমন সুস্থ মানুষদের ভর্তি করান৷ এমন মানসিক নিপীড়ণ, নানা শক্তিশালী ওষুধ এবং অন্য রোগীদের সঙ্গে থাকতে থাকতে কদিন পর তারা সত্যি সত্যি মানসিক রোগীতে পরিণত হন৷

অবশ্য তাদের এমন অভিযোগ পরবর্তীতে নিজে আর খতিয়ে দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি৷ কিন্তু পত্রপত্রিকায় এমন অজস্র ঘটনার খবর আসে৷ ফলে এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা অবান্তর বলেই মনে হয়েছে৷

এ তো গেল মানসিক হাসপাতাল ও মানসিক রোগীদের নিয়ে বাইরের মানুষের মানসিকতা৷ হাসপাতালের ভেতরে যাদের চিকিৎসা ও মায়ামমতা দিয়ে রোগীদের ভালো করে তোলার কথা, তারা কী করছেন?

মানসিক হাসপাতালে রোগীদের ওপর নির্যাতন এতদিন ওপেন সিক্রেটই ছিল৷ তবে জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমের মৃত্যুর পর ফেসবুকবাসী নড়েচড়ে বসে৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হয়েও নির্মম নির্যাতন থেকে বাঁচতে পারেননি তিনি৷ বরং কর্তৃপক্ষ সাফাই দিয়েছে, উচ্ছৃংখল আচরণ করায় তাকে শান্ত করতেই নাকি চেপে ধরা হয়েছিল৷ তাহলে ভেবে দেখুন মানসিক হাসপাতালগুলোতে কত শত রোগীর সঙ্গে দিনের পর দিন এমন ‘শান্ত করার' আচরণ তারা চালিয়ে যাচ্ছেন!

আনিসুল করিম ছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠি৷ এই ঘটনার কদিন পরেই আমার এক সাবেক সহকর্মী ও সাংবাদিক নাদিয়া সারওয়াত ফেসবুকে পাবলিক স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন৷ নিজের দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর তিনি ভুগছিলেন পোস্ট পার্টাম সাইকোসিসে, অর্থাৎ প্রসব পরবর্তী এক ধরনের মানসিক রোগে৷ যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস হচ্ছে একটি বিরল কিন্তু খুবই সিরিয়াস মানসিক রোগ৷ নাদিয়াও দিন দশেকের জন্য স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন, তার নিজের ভাষাতেই ‘বদ্ধ উন্মাদের' মতো হয়ে গিয়েছিলেন৷

ঢাকার যে হাসপাতালে নাদিয়াকে ভর্তি করা হয়েছিল সেটি বেশ ভালো ছিল বলেই জানিয়েছেন তিনি৷ তবে সেই ‘ভালো' হাসপাতালেও তাকে নার্সের মার খেতে হয়েছে৷

তার স্ট্যাটাসের কিছু অংশ হুবহু তুলে দিচ্ছি এখানে- ‘‘কোথায় আছি, কেন আছি কিচ্ছু বুঝতে পারতাম না৷ রাতে হাসপাতালের সব লাইট নেভানো থাকলেও, নার্সের ঘরে আলো জ্বলত৷ আমি বারবার ঘুরে ঘুরে ওই ঘরে চলে যেতাম, আমার বাচ্চাটাকে খুঁজতে৷ তখনই বিরক্ত হয়ে একদিন গায়ে হাত তুলেছিল নার্স৷ গালে কালশিটে দাগ ছিল ছাড়া পাওয়ার পরেও৷ হাসপাতালে প্রথম দিন থেকেই ইনজেকশন দিতে চাইতাম না, হাত পা ছুঁড়তাম, তখন জোর করে চেপে ধরত নিয়মিতই, সেটাকে মার হিসেবে মনে রাখিনি৷ কিন্তু ওই ঘটনা মনে রেখেছি, পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে না পারলেও অপমানটা ঠিকই আঘাত করেছে৷’’

তিনি আরো লিখেছেন, ‘‘মানসিকভাবে অসুস্থদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য যে ধৈর্য এবং সহানুভূতি প্রয়োজন, কেয়ার গিভারদের সেই প্রশিক্ষণ কি দেয়া হয় বাংলাদেশে? কয়টা হাসপাতালে দেয়া হয়? পিটিয়ে মারা না হয় এক্সট্রিম, বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পিঠ বাঁচানো যায়...কিন্তু সাধারণভাবে মানসিকভাবে অসুস্থদের কিভাবে ট্রিট করা হয়?
অবশ্য মানুষকেই মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেই না আমরা, মানসিক রোগী তো অনেক পরের কথা....ফেসবুকে লিখি কারো বোধোদয়ের জন্য না,  এগুলো অনেকটা স্বগতোক্তি....’’


একজন পুলিশ সদস্য এবং একজন সাংবাদিকের যদি এমন অভিজ্ঞতা হয়, সাধারণ মানুষের অবস্থা কতটা শোচনীয় তা ধারণাই করা যায়৷

এবার নিজের কথা বলি৷ কয়েক বছর আগে কিছু বিষয়ে মানসিক যন্ত্রণা শারীরিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলছিল৷ ফলে বাধ্য হয়েই জার্মানির একটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম৷ সেখানকার তরুণী ডাক্তার ইংরেজি বোঝেন না, আমি জানি না জার্মান৷ ফলে বিফল মনোরথ হয়ে যখন ফিরে আসবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ডাক্তার নিজেই আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন, একটু পর ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারা এক নার্সকে নিয়ে হাজির হলেন৷

অনেক কষ্টে নানা কিছু বোঝানোর পর তিনি আমাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে বললেন, "তুমি বেশি করে বিশ্রাম নাও, আর ঘুম না এলে এই ওষুধ খাও৷ তারচেয়ে বড় কথা, তোমার কোনো অসুখ হয়নি, ফলে আমার কাছে নয় বরং কোনো থেরাপিস্টের কাছে গেলে কাউন্সেলিং নিলেই ঠিক হয়ে যাবে৷”

আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘‘খামাখাই তাহলে আমি এতক্ষণ কষ্ট করে বকবক করলাম, তুমিও সময় নষ্ট করে শুনলে৷’’

সম্ভবত আমার চেয়েও কম বয়সী সেই ডাক্তার আমাকে জবাব দিলেন, "তুমি তোমার কথাগুলো বলার জন্য কাউকে পাচ্ছিলে না৷ এজন্য তোমার আরো বেশি খারাপ লাগছিল৷ আমি কিছু করতে পারি আর না পারি, অন্তত কথা তো শুনতে পেরেছি৷”

সেদিন সেই ডাক্তারের প্রতি খুব কৃতজ্ঞতা অনুভব করেছিলাম৷ সৌভাগ্যই বলতে হবে, আমাকে আর শেষ পর্যন্ত কোনো চিকিৎসাই নিতে হয়নি৷

আমাদের আশেপাশে অনেকেই মানসিক রোগে ভোগেন, কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা চরম পর্যায়ে চলে যায়৷ কিন্তু এ বিষয়ে কয়জন খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন? সামাজিক লজ্জা, লোকভয়, নির্যাতনের ভয় নানা কিছুর কারণে মানসিক সমস্যা চেপে রেখে অনেকে চরম সীমায় পৌঁছে যান৷

তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে মাঝেমধ্যে অনেকে আত্মহত্যার পর্যায়ে পর্যন্ত চলে যান৷ তখন আমরা স্ট্যাটাস দেই, ‘আহারে, বুঝতেই পারলাম না ছেলেটা/মেয়েটা এত যন্ত্রণায় ভুগতো' অথবা ‘ইশ, কেন নিজের যন্ত্রণা আমার সঙ্গে শেয়ার করলো না!' কিন্তু আসলেই কী আমরা আরেকজনের যন্ত্রণা শোনার জন্য প্রস্তুত? সমাজ, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন প্রস্তুত?

ভেবে দেখুন, মানসিক সমস্যার কথা বলে অফিস থেকে ছুটি নিতে পারবেন? সহকর্মীরা জানতে পারলে আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন না? বন্ধুরা ‘কিরে পাগল' বলে খ্যাপাবে না? প্রতিবেশিরা কেমন কেমন দৃষ্টিতে তাকাবে না? আত্মীয়স্বজন এড়িয়ে চলবে না? এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছেও অনেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পান না৷

আমরাও অনেকেই মানসিক হাসপাতালগুলোর চিন্তা লালন করি৷ ‘কিসের মানসিক রোগ, সব ভাঁওতাবাজি, মাইর দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷' হাসপাতালের কর্মীরাও সমাজেরই অংশ, ফলে তাদেরও এমন মানসিকতাই স্বাভাবিক৷

তবে আমি খুব অবাক হই৷ অনেকে মানসিক রোগী হতে পারেন, কিন্তু মানসিক সমস্যা আসলে কার? মানসিক রোগীদের, নাকি যারা তাদের নিয়ে হাসাহাসি করেন, ক্ষ্যাপাতে যান, মারধর করেন তাদের? রোগ তো চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করা যায়, সমস্যার সমাধান করবেন কিভাবে?

HA Asien | Anupam Deb Kanunjna
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll