1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মালিকদের ‘স্বার্থ’ সুরক্ষায় গণমাধ্যম

সমীর কুমার দে ঢাকা
৭ মে ২০২১

বাংলাদেশে গণমাধ্যম কি গণমানুষের স্বার্থে কাজ করছে? নাকি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের ব্যবসার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এমন প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে এসেছে৷

https://p.dw.com/p/3t6q9
করোনা মহামারিতে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চাকরিচ্যুত হয়েছেন ১ হাজার ৬০০ গণমাধ্যমকর্মীছবি: Ahasanul Haque

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল ইসলাম বুলবুল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যখন সংবাদমাধ্যমে পুঁজির বিনিয়োগকারীরা এলেন, তখন তারা একটি মিডিয়ার মালিক হলেন না, অনেকগুলো মিডিয়া করলেন৷ এখানে তারা যতটা না ব্যবসা করার জন্য এসেছেন, তার চেয়েও বেশি অন্য ব্যবসাকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য৷ এখানে যদি কোনো মালিক একশ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন এবং এই বিনিয়োগ থেকে তার যদি লাভ না-ও হয়, তারপরও এটা দিয়ে যদি ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা পাওয়া যায়, তাহলে এটা তো ভালো বিনিয়োগ৷ এভাবেই এখন হিসেবটা করা হয়৷’’

ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমান খান মনে করেন, ‘‘এখন যারা শিল্পপতি, তারা কোনো-না-কোনোভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন৷ সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে৷ স্বাধীনতার পর ২০-৩০ বছর এই প্রবণতা ছিল না৷ এখন গণমাধ্যম কর্মীরা এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছেন৷ গণমাধ্যম কর্মীরা সব সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা থাকেন তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন৷ এখন সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মতো আমরাও গণমাধ্যম কর্মীরা এই লড়াই করার প্রবণতা দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছি৷ আমাদের যে সামাজিক অবক্ষয়, তার সঙ্গে আমরাও যুক্ত হচ্ছি৷ আমাদের অন্যান্য পেশায় যেমন সামাজিক অবক্ষয় বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, আমরা সংবাদকর্মীরাও স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি অনেক ক্ষেত্রেই৷”

মাহফুজ আনাম

আর্টিকেল নাইনটিন-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনা মহামারিতে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চাকরিচ্যুত হয়েছেন ১ হাজার ৬০০ গণমাধ্যমকর্মী৷ এর মধ্যে ১৫০ জন নারীও রয়েছেন৷ এছাড়া করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫২ জন গণমাধ্যমকর্মী৷

সাম্প্রতি এক ওয়েবিনারে দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক  সোহরাব হাসান বলেন, ‘‘স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কোনো সরকারই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দেয়নি৷ নানাভাবে কৌশলে তথ্য প্রকাশ করতে হয়েছে গণমাধ্যমকে৷ যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন তাদের চেহারা পাল্টে যায়৷ এমনকি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রচারমাধ্যমগুলোও পরিণত হয় ক্ষমতাসীন দলের সম্পদে৷ অথচ এটি হওয়ার কথা জনগণের প্রচারমাধ্যম৷ এছাড়া সাংবাদিকতার পেশাগত মর্যাদা, ঐক্য, সাংবাদিকদের আর্থিক অনিশ্চয়তা, ছাঁটাই ও নিজস্ব পূঁজির অভাবসহ নানা প্রতিবন্ধকতা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে৷’’

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন খবরের কাগজের সংখ্যা বাড়ার ফলে মালিকদের সংখ্যাও বেড়েছে৷ তবে এই মালিকরা অনেকেই সংবাদপত্রের আদর্শে অতটা বিশ্বাস করেন কিনা বলা মুশকিল৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘সংবাদপত্রকে ব্যবসা হিসেবে চালানোর পরেও তো সংবাদপত্রের আলাদা ধরন আছে৷ আলাদা নীতিগত প্রয়োজনীয়তা আছে৷ এটা ওনারা মানেন কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ আছে৷” এখন কি এই ধরনের মালিকের সংখ্যা বেড়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এখন তো সংখ্যাটা অনেক বেশি৷ এখন তো ঢাকা শহরে একশ'টির বেশি কাগজ৷ তার মধ্যে ৩০-৩৫টা তো প্রথম শ্রেণির কাগজের মতো টেকনিক্যালি, ফলে সংখ্যা অনেক বেড়েছে, সে কারণে ওই ধরনের মালিকও বেড়েছে৷” সাংবাদিকদের স্বাধীনতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি, সামগ্রিকভাবে একটা পরিবর্তনশীল পরিবেশ৷ অনেক ক্ষেত্রেই আমরা আগের থেকে এগিয়ে আছি৷ আবার কতগুলো বিষয়ে পিছিয়ে আছি, বিশেষ করে আইনগতভাবে৷ আমি সব সময় বলে আসছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংঘাতিকভাবে মুক্ত সাংবাদিকতার পরিপন্থী একটি আইন৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা স্বাধীনতা উপভোগ করছি, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে করছি না, এই ধরনের মিশ্র একটি পরিবেশ৷’’

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বঞ্চনা লাঘবের জন্য, যারা কথা বলতে পারে না তাদের ভয়েস হিসেবে গণমাধ্যম এক সময় কাজ করতো৷ যারা নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ, তাদের পক্ষেই সংবাদপত্র দাঁড়াতো৷ এক সময় যারা গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তাদের এক ভিশন ছিল, দর্শন ছিল৷ গত ৫০ বছরে আমরা সেই জায়গা থেকে সরে এসেছি৷ শুধু যে গণমাধ্যম সরে এসেছে তা নয়, সমাজ বাস্তবতায়ও সেটা হয়েছে৷ এখন কি সেই শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন আছে? কিংবা রাজনীতির দিকেই যদি আমরা তাকাই, ৫০ বছর বা ৩০ বছর আগে যেটা ছিল, এখন কি সেটা থেকে আমরা সরে আসিনি? ভালো কি মন্দ সেটা যারা সমাজ বিশ্লেষণ করেন তারা বিশ্লেষন করবেন৷ আরেকটা বিষয় হলো, কর্পোরেট হাউজের এই যুগে আমরা সমাজ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না৷ আমরা সবসময় বলি, গণমাধ্যমের উপর এখন রাজনীতির প্রভাব অনেক বেশি৷ সরকারের নানামুখী চাপে গণমাধ্যম প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে পারছে না৷ এই চাপ তো আসলে পেশিশক্তির চাপ, এই চাপ তো সন্ত্রাসের চাপ, এই চাপ তো আসলে পুঁজির চাপ৷ এই সবগুলো চাপই এখন বেড়েছে৷ এই কারণে গণমাধ্যম এখন আপন সত্তা নিয়ে বিকশিত হতে পারছে না৷ যেহেতু এখনও আমরা গণমানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি, সেই কারণে গণমাধ্যমকেও আমরা গণমানুষের মুখপাত্র হিসেবে দিতে পারিনি৷ এই কারণে নিজেদের আত্মসমালোচনা অনেক বেশি৷ কোন পেশাটাকে আমরা ঠিক রেখেছি? চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা শিক্ষক একটা পেশাকেও আমরা ঠিক রাখতে পেরেছি? আমরা জানি, নানা চাপের মধ্যে সাংবাদিকতা করতে হয়৷ ফলে সামনে যে খুব বেশি আলো, সেটা আমরা বলতে পারি না৷”

মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল

মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘‘এই উপমহাদেশে সংবাদপত্রের যাত্রাই শুরু হয়েছিল রাজনীতি দিয়ে৷ তখন রাজনীতি ছিল জনস্বার্থ সম্পর্কিত রাজনীতি৷ তখন রাজনৈতিক দর্শন দিয়ে যারা কাগজ বের করেছেন তখন তারা রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করেছেন৷ এখন যারা মালিক হিসেবে আসছেন, তাদের মধ্যে দুই রকম ব্যবসায়ী আছেন৷ যারা সংবাদপত্র শুধু ব্যবসার জন্যই করেন, তারা পেশাদারিত্বের উপর নজর দেন৷ তারা পেশাদারিত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে একটা লাভজনক জায়গায় নিয়ে যেতে চান৷ আরেক ধরনের মালিক আছেন, যারা এখানে বিনিয়োগ করেন এবং লভ্যাংশ পাওয়ার চেষ্টা করেন৷ এই সংবাদমাধ্যম থেকে তাদের যদি লাভ না-ও হয়, তারা অন্য ব্যবসার সুরক্ষা হিসেবে এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেন৷ এই ধরনের গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্থ হন পেশাদার সাংবাদিকরা৷’’

মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের সঙ্গে একমত পোষন করে মশিউর রহমান খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন যারা পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স নিচ্ছেন, তারা তো নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে এই মালিকানা নিচ্ছেন৷ আগে যারা মালিক ছিলেন, তারা গণমাধ্যম কর্মীদের কাজ করতে দিতেন৷ এখন এই কাজের জায়গাটা অনেক কমে যাচ্ছে৷ সংবাদকর্মীদের উপর আগের চেয়ে চাপ অনেক বেড়েছে৷ আমি মনে করি, গণমাধ্যম কর্মীদের নীতি-নৈতিকতা আগের চেয়ে অনেক নীচে নেমে গেছে৷ আমাদের যারা পূর্বসূরি তাদের চালচলন, জীবনযাত্রা দেখে আমরা বলতে পারি, আমরা তাদের যথাযথভাবে অনুসরণ করতে পারিনি৷”

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান মনে করেন, আগে সংবাদপত্রের মালিকদের একটা কমিটমেন্ট ছিল৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এখন তো সাংবাদিকরা শুধুই কর্মচারী৷ মালিকরা সাংবাদিকদের ব্যবহার করছেন৷ যে সাংবাদিক যে সেক্টরে কাজ করেন, সেখানে তাকে মালিকের অন্য ব্যবসার পক্ষে তদবির করতে হয়৷ অথচ আগে কিন্তু সাংবাদিকরা অনেক ক্ষেত্রেই স্বাধীন ছিলেন৷ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সংবাদ নির্মোহভাবে ছাপা হতো৷ এখন যারা মালিক, তাদের অন্যান্য ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারের সঙ্গে সখ্য রাখতে হয়৷ ফলে সাংবাদিকরা চাইলেও স্বাধীনভাবে কিছু লিখতে পারেন না৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান