1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মিশরের ‘গ্রীষ্মকালীন স্ত্রী'

১৩ নভেম্বর ২০১৯

অর্থের লোভ দেখিয়ে মিশরের শত শত কিশোরীকে  ধনী পর্যটকদের ‘সাময়িক' বিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছে৷ দেশটিতে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিষিদ্ধ হওয়ায় পর্যটকদের যৌন চাহিদা মেটাতে চলছে এমন বিয়ে৷ এদের পরিচয় ‘গ্রীষ্মের স্ত্রী' হিসেবে৷

https://p.dw.com/p/3SwDL
প্রতীকী ছবিছবি: Getty Images/AFP/T. Coex

২০০৮ সালের গ্রীষ্মকাল৷ দরজায় কেউ একজন কড়া নাড়লো৷ হুরাইরার বয়স তখন কেবল ১৫ বছর৷ দরজা খুলেই বাইরে এক পুরুষকে তার বাবা ও সৎ মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখলেন তিনি৷ তার সামনেই হলো সব কথাবার্তা৷ মাত্র ১,৭৫০ ইউরো (প্রায় দে়ড় লাখ টাকা) ‘যৌতুকের' বিনিময়ে সৌদি আরব থেকে আসা সেই ব্যক্তিকে তার বিয়ে করতে হবে৷

মাত্র ২০ দিন মেয়াদী সেই বিয়েতে ক্রমাগত ধর্ষণের শিকার হতে হয়ে হুরাইরাকে৷ এরপর গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ৷ হুরাইরাকে আবার বাবা-মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে সৌদি নাগরিক নিজ দেশে ফেরত চলে যান৷ আর কখনও সে ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়নি হুরাইরার৷

মিশরে যৌনকর্মীদের ডাক নাম ‘গ্রীষ্মকালীন স্ত্রী', হুরাইরাও ছিলেন তাদের একজন৷ প্রতি বছরই উপসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ থেকে এমন ‘স্ত্রী' বেছে নিতে মিশরে আসেন পর্যটকেরা৷ এর বিনিময়ে মেয়ের পরিবারকে যে অর্থ দেয়া হয় তা তাদের জন্য অনেক কিছু৷

হুরাইরা বলছিলেন, ‘‘সবকিছু খুব লোভনীয় লাগছিল৷ আমার পরিবার আমাকে নতুন কাপড় আর উপহারের লোভ দেখায়৷ আমি তখন খুব ছোট ছিলাম৷ শেষ পর্যন্ত আমি রাজী হয়ে যাই৷'' হুরাইরার পরিবার তার বিয়ের ‘যৌতুকের' টাকা দিয়ে একটি ফ্রিজ আর ওয়াশিং মেশিন কেনে৷

বইয়ের দোকানেও কাবিননামা

গ্রীষ্মকালীন এসব বিয়ের কাগজ খুব সহজেই বইয়ের দোকানগুলোতে পাওয়া যায়, এগুলোর সমাধানও হয় খুব দ্রুত৷ গোপনে এবং দ্রুততার সঙ্গে যাতে এইসব বিয়ে হয় তা নিশ্চিত করতে দালাল এবং উকিলেরও অভাব নেই৷ আনুষ্ঠানিকভাবে এইসব বিয়ে নিবন্ধন না করার ফলে বিয়ে করার মতোই বিয়ে বিচ্ছেদও খুব দ্রুতই হয়ে যায়৷

হুরাইরার বয়স এখন ২৮৷ এর মধ্যে তার ৮ বার বিয়ে হয়েছে, প্রতিবারই অল্প কিছু দিনের জন্য৷ নিজের অতীত নিয়ে তিনি লজ্জিত এবং নিজের আসল নামও প্রকাশ করতে চান না৷ বাইরে বের হলে নিজেকে সবসময় আড়াল করে রাখেন কালো নেকাবে৷

প্রথম বিয়ের সময় রাজধানী কায়রো থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অউসিম গ্রামে ছোট এক বাড়িতে বাবা, সৎ মা এবং ছয় সৎ ভাই-বোনের সঙ্গে থাকতেন হুরাইরা৷

কিন্তু তখন হুরাইরা যেমন ভেবেছিলেন, খুব দ্রুত সেসব স্বপ্ন মিথ্যা প্রমাণ হতে থাকে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি তখন খুব সহজ সরল ছিলাম, ভালোবাসায় বিশ্বাস করতাম৷ বিয়ের প্রথম রাত খুব ভয়াবহ ছিল৷ এরপর থেকে আমি মানসিক সমস্যায় ভুগি৷'' কিন্তু এসব জানিয়েও পরিবারকে পরের বিয়েগুলোর আয়োজন করা থেকে ঠেকানো যায়নি৷ পরের গ্রীষ্মেই আবার এক পর্যটককে বিয়ে করতে হয় হুরাইরার৷ এবার তার ‘স্বামী' একজন কুয়েতি৷ কুমারী না হওয়ায় এবার তার ‘যৌতুক' কেবল ৬০০ ইউরো৷

অর্থের লোভ

মিশরে যৌনকর্মী ও মানবপাচার নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কাজ করেন আইনজীবী আহমেদ মোসেলহি৷ হুরাইরার গল্প মিশরে জন্য নতুন কিছু নয় বলে মনে করেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেক মেয়ে পরিবারকে সাহায্য করতে চায়৷ এজন্য অনেকে স্বেচ্ছায় এসব বিয়েতে রাজী হয়৷ টাকা আসতে থাকলে এক পর্যায়ে তাতে আসক্তি তৈরি হয়৷'' এরপর তিনি জানালেন ভয়াবহ এক হিসেব৷ কায়রোর আশেপাশের এলাকাগুলোতেই পরিবারগুলোতে আট বা তারও বেশি সন্তান রয়েছে৷ প্রতিটি মেয়েই এমন ‘গ্রীষ্মকালীন বিয়ের' মাধ্যমে একটি গাড়ি বা বাড়ির একটি তলা বানানোর সমান অর্থ আয় করতে সক্ষম৷

কায়রোর আশেপাশের এলাকায় দরিদ্র লোকের বাস৷ চার ভাগের এক মানুষ দিনে দুই ডলারেরও (প্রায় ১৫০ টাকা) কম খরচে চলতে হয়৷ সেক্স ট্যুরিজম এই চরম দরিদ্রদের জীবনে নতুন আশা সৃষ্টি করছে৷ কেউ কেউ মেয়ের কুমারীত্ব, বয়স, চেহারা এবং বিয়ের স্থায়িত্ব বিবেচনা করে এক লাখ ইউরো (প্রায় ৯৫ লাখ টাকা) পর্যন্ত খরচ করতে রাজী হন৷

এসব বিয়েতে হোটেল কক্ষ বা অ্যাপার্টমেন্টসহ নানা প্যাকেজও রয়েছে৷ ইসলামে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিষিদ্ধ৷ ফলে একদিকে কাগজেকলমে ‘বৈধ' বিয়েতে ‘স্বামী-স্ত্রীর' ধর্মীয় বিধানও অমান্য হয় না, দেশের আইনেও বিচার করাটা বেশ কঠিন হয়৷

আইনেও মারপ্যাঁচ

কাগজপত্র ঠিক রেখে বিয়ে করায় আইনি প্রক্রিয়ায় মেয়ের পরিবার বা বিয়ে করা পর্যটককে সাজা দেয়া কষ্টসাধ্য৷ কিন্তু যারা এসব ক্ষেত্রে দালালের ভূমিকায় থাকেন, তাদের মাঝে মধ্য়ে শাস্তি দেয়া হয়৷ ২০১২ সালে এমনই এক দালাল ওউশা এবং তার ১০ সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা করেন আইনজীবী মোসেলহি৷ বিয়ের কাগজ থাকায় পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার অভিযোগ না এনে তাদের বিরুদ্ধে আনা হয় মানবপাচারের অভিযোগ৷

তাদের ছয় মাস থেকে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত৷ কিন্তু সাজা দিয়ে এসব ব্যবসা থামিয়ে রাখা যাচ্ছে না৷ কোনো আনুষ্ঠানিক হসেব না থাকলেও বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, প্রতি বছর এমন ‘স্ত্রীর' খোঁজে হাজার হাজার পর্যটক মিশরে আসেন

হুরাইরা এখন আর এই ব্যবসায় জড়িত না৷ এখনও তিনি তার বাবা ও সৎ মায়ের সঙ্গেই বাস করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি আর তাদের ভয় করি না কিন্তু প্রচণ্ড ঘৃণা করি, বিশেষ করে আমার বাবাকে৷ তিনি কিভাবে এসব হতে দিলেন!''

এখন সত্যিকার একটি বিয়ের জন্য সঠিক মানুষের সন্ধান করছেন হুরাইরা৷ কিন্তু বাস্তবতা বলছে, হুরাইরার ভাগ্যে কী হবে তা প্রায় নিশ্চিত৷ হুরাইরার মতো ‘গ্রীষ্মকালীন স্ত্রী'দের সমাজে সম্মানের চোখে দেখা হয় না৷ মিশরের রক্ষণশীল সমাজে কোনো পুরুষই এমন মেয়েকে বিয়ের যোগ্য মনে করে না৷

এলিজাবেথ লেহমান, এভা প্লেসনার, ফ্লেমিং ভাইস-এন্ডারসেন/এডিকে/কেএম

© কান্তারা.ডিই ২০১৭