1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে  হবে

এম এম খালেকুজ্জামান
১০ জানুয়ারি ২০২০

‘ফগ অফ ওয়ার' যুদ্ধ সংক্রান্ত পরিভাষায় বেশ প্রচলিত শব্দ সমষ্টি৷ বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে অস্বস্তি আর অনিশ্চয়তার বিষয়টি বুঝিয়ে থাকে এই শব্দ সমষ্টি দিয়ে৷

https://p.dw.com/p/3W0Pl
ছবি: Reuters/Official Khamenei website

মেজর জেনারেল কাসেম সোলেইমানির হত্যাকাণ্ডের পর কথিত অনিশ্চয়তার বিপরীতে ইরান হামলা চালিয়েছে দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে৷ প্রতিশোধ হিসেবে ইরাকে দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে৷ এর মাধ্যমে পাল্টা জবাব দেওয়া হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ৷ হামলার পর এই ঘোষণাও এসেছে ইরান আর যুদ্ধ চায় না৷

ইরানের এ হামলা ‘সমানুপাতিক প্রত্যাঘাত'- কিনা তা মাপার কোন নিক্তি হয়তো নাই৷ তবে একেবারে প্রতি উত্তরহীনতার অস্বস্তি কেটে গেল কি? মনে রাখা দরকার, যুদ্ধ এমন এক চক্র, প্রবেশ হয়তো অনায়াস, কিন্তু প্রস্থান প্রায়শই কঠিন৷

বিশ্বব্যাপী নানা মাত্রার অস্থিরতা ক্রমশ গ্রাস করছে যেন৷ এই অস্থিরতা থেকে বিশ্বের কোনো দেশই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এখন আর মুক্ত নয়৷ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বলয় তৈরির একালের মাস্টার মাইন্ড সোলেইমানি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হওয়ার পর স্বভাবতই ক্ষোভে ফুঁসছে ইরানের প্রতি সহানুভূতিশীল ইসলামী দেশের জনতা৷

মেজর জেনারেল কাসেম সোলেইমানি ছিলেন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস ফোর্সের প্রধান৷ ইরানে খামেনির পর তিনিই দ্বিতীয়  প্রভাবশালী ব্যক্তি, তিনি কেবল খামেনির কাছেই জবাবদিহি করতেন এবং দেশের সশস্ত্র ও গোয়েন্দা কার্যক্রম নিজেই পরিচালনা করতেন৷ একই সঙ্গে ইরাকের সামরিক বাহিনীতেও তাঁর ব্যাপক প্রভাব ছিল৷ ব্যতিক্রমী অথচ সফল সমরকৌশলের কারণে চলিত বিশ্বে তিনি এক আলোচিত চরিত্র৷

বিভিন্ন ফ্রন্টে সোলেইমানির নির্দেশে ইরান মার্কিন সৈন্যদের ওপর হামলা চালিয়েছে বিভিন্ন সময়৷ যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিকভাবে চাপে রাখতে সোলেইমানির জুড়ি ছিল না৷ আর যুক্তরাষ্ট্রও বিভিন্ন সময় হত্যার পরিকল্পনা করেও সফল হতে পারেনি এত দিন৷ রিপাবলিকানরা দলীয় কারণে সমর্থন করছে কিন্তু ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এই হামলা ও হত্যা সমর্থন করেনি৷ নিম্নকক্ষের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ও ডেমোক্র্যাট সদস্য ন্যান্সি পেলোসির দাবি, মার্কিন কংগ্রেসের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা না করে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি, যা নিরেট আইনের লঙ্ঘন৷ অন্যদিকে ট্রাম্পের সাফাই, ‘‘সোলেইমানি দীর্ঘ সময় ধরে হাজারো মার্কিন নাগরিককে হত্যা করেছেন এবং আরো হত্যার পরিকল্পনা করছিলেন''৷  তিনি আরো বলেন, ‘‘ইরানে সাম্প্রতিক বিক্ষোভের সময় নিহত অনেক বিক্ষোভকারীসহ লাখো মানুষের মৃত্যুর জন্য সোলেইমানি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত৷''

২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র   ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে  করা পারমাণবিক  চুক্তি  থেকে বেরিয়ে আসে  এবং ইরানের ওপর স্থগিত বা তুলে নেয়া সব  নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের ঘোষণা দেয়৷ ছয় জাতির এই চুক্তিতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ছিল রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি৷ এক বিশ্লেষণে প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী ফরেন অ্যাফেয়ার্স বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে ও ইরানের ওপর অধিকতর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও কোন সফলতা পায়নি৷ বরং চাপের মুখে ইরান সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখিয়েছে এবং নিজেদের মতো করে চাপ সামাল দিচ্ছে৷ চীন-রাশিয়ার মোরাল সাপোর্ট কিছুটা প্রণোদনার কাজ করছে৷

অভিশংসনের খড়গ মাথায় নিয়ে ট্রাম্প পরের দফায় প্রেসিডেন্ট হতে চাচ্ছেন৷ ওয়ার ফ্রন্টে বলার মতো কোন পোর্টফোলিওর অভাব ছিল, সোলাইমানিকে মেরে সে শূন্যতায় কিছু মাইলেজ যোগ করতে পারে সেই উচ্চাশা থেকে এই হত্যাকাণ্ড৷

বিভিন্ন কারণে বিগত কয়েক দশক ধরে দেখা  যাচ্ছে সরাসরি যুদ্ধের ব্যাপারে ইরানের খুব একটা আগ্রহ নেই৷ তবে দেশটি বিভিন্ন ফ্রন্টে প্রক্সি ওয়ার চালিয়ে যাচ্ছে৷ হিজবুল্লাহকে দিয়ে ইসরায়েলকে ব্যস্ত রাখা, সিরিয়ার আইএসকে বাড়তে না দিয়ে আমেরিকাকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য করা আর সর্বশেষ ইরাকে জনতার বিক্ষোভের নামে অ্যামেরিকান দূতাবাসে হামলা, এমন সব ছায়া যুদ্ধে ইরান তার দুই শত্রু ইসরায়েল আর অ্যামেরিকাকে তটস্থ রেখেছে৷ অ্যামেরিকা সোলাইমানিকে হত্যা করে সরাসরি যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে, যদিও ইরান তার প্রধান সমরনায়ককে হারিয়েও এক প্রকার সংযত প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছে৷ মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল ছিল এবং আরো হলো এই হত্যাকাণ্ডের পর৷ এই অঞ্চলটি আর একটি যুদ্ধের ভার বহন করতে পারবে না নিশ্চিতভাবেই৷ ইরান হয়তো অ্যামেরিকার তৈরী এ ওয়ার ট্র্যাপে পা দিয়ে বিপদ ডেকে আনবে না৷

জীবিত সোলাইমানির চেয়ে মৃত সোলেইমানি বরং অধিকতর  শক্তিশালী৷ শিয়া-সুন্নিতে বিভক্ত ইরানের জন সমাজ সোলেইমানির জানাজায় একত্রিত হয়ে দেখিয়েছে অভূতপূর্ব ঐক্য৷ মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে বিপর্যস্ত ইরানিরা খামেনির উপর বিরক্ত ছিল, ছোটখাট বিক্ষোভ ও দেখাতো৷ সোলেইমানির মতো জনপ্রিয় ব্যক্তিকে হত্যা করে এই সরকারের প্রতি সমর্থন পোক্ত হয়েছে

ইরাক সরকারও ইরানের প্রতি এখন সহানুভূতিশীল৷ সোলেইমানি মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো আরবে যে মার্কিনবিরোধী রাজনৈতিক পরিবেশের স্বপ্ন দেখতেন তা আরো গতি পাবে৷ ইরাকি পার্লামেন্ট  যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারির বিরুদ্ধে কথিত বিলটি আনুষ্ঠানিকভাবে পাসের দাবি উঠেছে৷ এরই মধ্যে জার্মানি ইরাক থেকে কিছু সৈন্য ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে৷ নিজেদের হঠকারিতায় অ্যামেরিকা ক্রমেই একা হয়ে পড়ছে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে৷

আপাত দূরবর্তী দেশ হিসেবে ইরান-মার্কিন চলতি টানাপড়েনে বাংলাদেশকেও সতর্ক থাকতে হবে৷ প্রায় তিন বছর আগে ২০১৭ সালের মে মাসে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অনুষ্ঠিত হয় আরব-ইসলামিক-অ্যামেরিকান সম্মেলন৷ সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের আহ্বানে এ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ৫৬ জন আরব ও মুসলিম শীর্ষ রাষ্ট্র নেতা যোগ দেন৷ ওআইসি বা ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ছাড়া আর কোনো সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের এমন ব্যাপক উপস্থিতি এর আগে  দেখা যায়নি৷ এই শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অংশ নিয়েছিলেন৷

Bangladesch M M Khalekuzzaman
এম এম খালেকুজ্জামান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টছবি: Private

এই সম্মেলনের মূখ্য তিন  উদ্দেশ্যের একটি- ট্রাম্পের সাথে মুসলিম বিশ্বের আইস ব্রেকিং৷ দ্বিতীয়ত, ইরানের হুমকি মোকাবিলায় অ্যামেরিকা ও মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোকে পাশে রাখা এবং তৃতীয়ত, ইরাক ও সিরিয়া ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোর সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা৷

প্রথমটি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সর্বজনীন হলেও পরের দুটি আসলে সৌদি আরবের নিজস্ব এজেন্ডা৷ সম্মেলনে ৩৪ হাজার সেনা নিয়ে একটা কমান্ড গঠনের ‘রিয়াদ ঘোষণা' বাংলাদেশের মতো জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোকে অস্বস্তিতে ফেলে৷ বাংলাদেশ সম্মেলনের পরই জানিয়ে দেয়, কেবল মক্কা ও মদিনাতে যদি কোনো হামলা হয় তখনই শুধু বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করবে৷ এর বাহিরে কোথাও কোনো বিষয়ে অংশগ্রহণ করবে না৷ ওই ঘটনায় বাংলাদেশ ইরানের সম্পর্ক টানাপড়েনে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দেয়৷

সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করাই হলো যেকোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য, বাংলাদেশেরও তাই৷ ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বৈরথে স্পষ্টত কোন পক্ষ নেয়ার সময় এখনই আসেনি সত্য৷ তারপরেও বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রেক্ষিতে  এ বিষয়ে শান্তিকামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত  বাংলাদেশের করণীয় কী হবে তা বর্তমান সরকার যথাযথভাবে গ্রহণ করবে এমন আশা করা যায়৷ জাতিসঙ্ঘ সনদের ২(৪) ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সকল সদস্য-রাষ্ট্র আঞ্চলিক অখন্ডতার বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন থেকে এবং জাতিসঙ্ঘের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন কোনো উপায় গ্রহণ করা থেকে নিবৃত্ত থাকবে৷'' জাতিসঙ্ঘের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ এই ম্যান্ডেট মেনে চলেছে বরাবর।