1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘‘রাজনৈতিক চর্চা না থাকায় ভূঁইফোড় সংগঠন বিকশিত হচ্ছে’’

সমীর কুমার দে ঢাকা
৩০ জুলাই ২০২১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা থাকলে রাজনীতির সব ক্ষেত্রেই তার ভালো প্রভাব পড়তো৷

https://p.dw.com/p/3yKnv
ছবি: bdnews24.com

ডয়চে ভেলে : সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে চাকরিজীবী লীগ৷ সবগুলো রাজনৈতিক দলেই তো এমন অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন আছে৷ কী উদ্দেশ্যে এই ধরনের সংগঠন হয়?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : অঙ্গ সংগঠনগুলো সাধারণত মতাদর্শগত কারণে তৈরি হয়৷ মূল রাজনৈতিক দলের মতাদর্শগত যে অবস্থান, অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের একই মতাদর্শ হবে৷ রাজনীতির আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে৷ এই রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নানা ধরনের গণসংগঠন থাকে, শ্রেনি, ছাত্র, মহিলা বা শ্রমিক সংগঠন থাকে৷ আমার অভিজ্ঞতা বলে, নিয়ম এইটা৷ এই ক্ষেত্রে কী হয়েছে সেটা আরেকটা ব্যাপার৷ নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে সেভাবে হয়নি৷ এখানে যেটা হয়েছে, আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য যতটা না, তার চেয়ে বেশি হয়েছে নিজেদের সুবিধা প্রতিষ্ঠার জন্য৷ যে কারণে মূল যে সংগঠন আওয়ামী লীগ এটা নজরে এনেছে এবং এর উদ্যোক্তাকে দল থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে৷    

আমরা দেখেছি, শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করেই গড়ে উঠেছে প্রায় ১০০ সংগঠন,যারা নামের আগে-পরে ‘বঙ্গবন্ধু', ‘আওয়ামী' কিংবালীগ' শব্দ জুড়ে দিয়ে নতুন সংগঠন করছে৷ এরা তো বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানাও ব্যবহার করছে নীতি নির্ধারকরা এটা জানেন না?

অবশ্যই জানার কথা৷ বোঝাই যাচ্ছে, এই ধরনের ভূঁইফোড় সংগঠন সুবিধার জন্য করা হয়েছে৷ এটা তো পরিস্কার মতাদর্শগত কারণে নয়, সুবিধার জন্য এটা করা হয়েছে৷ তাদের জানা উচিত এবং নিরুৎসাহিত করা উচিত৷ এগুলো তো যারা সরকারে আছে তাদের নাম ব্যবহার করছে৷ কাজেই তারা সুযোগ-সুবিধা নিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটা করেছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে৷ এই কারণে এদিকে তাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার৷ এক্ষেত্রে যেটা তারা পরে দিয়েছেন৷

এই ধরনের ধান্ধাবাজি বন্ধ করতে না পারলে কি রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে না?

হ্যাঁ, অবশ্যই হবে৷ এটা তো রাজনীতি না৷ এই ধরনের সংগঠন সুবিধার জন্য তৈরি করা হয়৷ এখানে অবশ্যই রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে, কেননা, এদের কারণে যে বদনাম, সেটা তো মূল রাজনৈতিক দলের উপরই পড়বে৷ এগুলো এক ধরনের উৎপাতের মতো কাজ করে৷ তারা মূল যে সংগঠন তার কোনো উপকার করছে না৷ বরং তারা নিজেদের সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে৷ মূল রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তাকেও কমিয়ে আনছে৷

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস বা অন্যান্য বিশেষ দিবসে এরা তো অর্থ সংগ্রহে নামে৷ এতে করে কি মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে না?

অবশ্যই তারা এটা করে৷ দেখা যাচ্ছে পাড়া-মহল্লায় এগুলো যারা করে, তারা নিজেদের উদ্দেশ্যে করে৷ আদর্শগত কোনো বিষয় না৷ শুধুমাত্র নিজেদের সুবিধার জন্য৷ এটাকে আমরা খুব সরলভাবে বলতে পারি, এটা চাঁদাবাজি৷ এর ফলে অনেকেই চাঁদা দিতে বাধ্য হয়, তাদের উপর এক ধরনের অত্যাচার৷ এতে নিশ্চয় রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে৷ দলের জনপ্রিয়তার উপর নিশ্চয় একটা ছায়া ফেলছে৷

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

এই ধরনের তৎপরতা তো অনেকদিন ধরেই চলছে৷ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে এদের নিয়ন্ত্রণ কি অসম্ভব হয়ে পড়ছে?

মোটেই অসম্ভব হওয়ার কথা না৷ তারা তো বলে দিলেই হয়, এদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই৷ এদের নিষেধ করে দিলেই হয়৷ এদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ নেই বা এরা আমাদের কেউ না- এটা জানিয়ে দেওয়ার নানা ধরনের পদ্ধতি আছে৷ সেই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করলে নিশ্চয়ই এরা ঝড়ে পড়বে৷ তখন এরা আর তৎপর থাকতে পারবে না৷ রাজনৈতিক দলগুলোর অসহায় বোধ করার কোনো কারণ নেই৷ এটা তো একটা বিড়ম্বনা৷

ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন কিংবা নির্বাচনবিহীন পরিস্থিতি কি এই অবস্থার জন্য দায়ী?

হ্যাঁ, যেখানে রাজনীতির স্বচ্ছ বা জবাবদিহিমূলক ধারা নেই, গণতান্ত্রিক ধারার অভাব হয়, তখনই এগুলো হয়৷ রাজনীতির যদি নানান ধরনের তৎপরতা চলতে থাকে, গণতান্ত্রিক তৎপরতা চলতে থাকে, তাহলে এরা আসবে না৷ কারণ, এরা তখন সুবিধা করতে পারবে না৷ এরা তো ওই কাজে নেই, এদের কাজ তো সুবিধা আদায় করা৷ যেখানে অন্য দলের উপস্থিতি নেই, সেই সুযোগটা তারা নিচ্ছে৷ সঠিক রাজনৈতিক চর্চার সংস্কৃতি না থাকলে এগুলো বিকশিত হয়৷

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা জবাবদিহিতা না থাকায় কি এমন হচ্ছে?

যদি নিয়মিত নির্বাচন হয়, তাহলে জনগণও রাজনৈতিক দলের লোকজনকে চিনতে পারে কে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত৷ তখন মানুষ বুঝতে পারে এরা ওই রাজনৈতিক দলের নয়, ফলে তারা সুবিধা করতে পারবে না৷ তখন মানুষই বুঝতে পারে এরা অননুমোদিত সংগঠন৷

বর্তমান সংস্কৃতিতে রাজনীতিকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হচ্ছে? আসলে কি তাই?

মোটেই না৷ রাজনীতি তো বিনিয়োগ হতেই পারে না৷ এটা তো খুবই আপত্তিকর কথা৷ মুনাফা লিপ্সা আর রাজনীতি তো কখনোই একসঙ্গে যাবে না৷ রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত৷ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, জনগণের কল্যাণ করা, নিরাপত্তা দেওয়া, সুবিধা-অসুবিধা দেখা৷ এই চিন্তা থাকলে তখন আর সুবিধাবাদিতা আসে না৷

দুর্নীতি থেকেই কি দুর্বৃত্তায়নের জন্ম হচ্ছে না?

হ্যাঁ, এটাও দুর্নীতির একটা অংশ বলা যেতে পারে৷ অঙ্গ সংগঠনের নাম করে সুবিধা আদায় করা, অবৈধ তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া বা ক্ষমতা প্রদর্শন করা এগুলো তো দুর্নীতির মধ্যেই পড়বে৷ আমাদের সমাজে যে দুর্নীতির ব্যাপকতা তারই একটা প্রতিফলন এটা বলতে পারেন৷ এখন মানুষ ন্যায়, অন্যায় বিবেচনার মধ্যে নেয় না, তারা শুধু মুনাফা দেখে৷ ফলে এখন যেগুলো হচ্ছে সেটা শুধুই মুনাফার জন্য৷ এই সংগঠনগুলোতে যারা আসে তারা শুধু মুনাফার জন্যই আসে৷ তারা আদর্শগত কারণে আসে না৷

দুর্নীতি দমন কমিশন কি ব্যাপারে কোনো ভূমিকা নিতে পারে?

আমার মনে হয়, অতদূর যাওয়ার দরকার নেই৷ এটা রাজনৈতিক দলেরই কর্তৃব্য৷ তারাই তো এদের অস্বীকার করতে পারে, বাদ দিয়ে দিতে পারে৷ দুর্নীতি দমন কমিশনের তো অনেক কাজ আছে৷ বড় বড় দুর্নীতিই তো তারা সামলাতে পারছে না৷ সেখানে এতটা প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না৷ দায়িত্বটা আসলে দলেরই৷ এক্ষেত্রে তো বোঝাই গেল, দল ইচ্ছে করলেই পারে এদের নিবৃত্ত করতে৷

কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ সম্ভব?

আমাদের বাংলাদেশে এখন যেটা দরকার সেটা হলো একটা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা৷ যেখানে মানুষ নিজেদের অধিকারের জন্য সংগঠিত হবে, সুবিধার জন্য নয়৷ সুবিধা মানে এই ধরনের আর্থিক সুবিধার জন্য নয়৷ নিজেদের একটা আদর্শগত অবস্থান থাকবে৷ তারা বলবে, আমরা দেশটাকে এইভাবে দেখতে চাই৷ আমরা আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্রটাকে এইভাবে গঠন করতে চাই৷ ওই রাজনীতি যখন থাকবে তখন এই সমস্ত উৎপাত আর থাকবে না৷