1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গারা বাড়ি ফিরবে কবে?

২৫ আগস্ট ২০২০

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় অংশটি আসতে শুরু করে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে৷ সেসময় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়৷ তিন বছর হয়ে গেছে৷ তারা কি আবার, আদৌ ফিরতে পারবে?

https://p.dw.com/p/3hTRW
ছবি: Getty Images/P. Bronstein

বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলো বেশ কয়েকবার ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে৷ দিনের বেলা, সপ্তাহান্তে এমনকি রাতের বেলাও শিবিরগুলোতে গিয়েছি, দেখেছি রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, তাদের দেশে ফেরার আকুতি৷ রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমার আপনার মতো বাঁচতে চান, স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে চান৷ তাদের চাহিদা এটুকুই৷

কিন্তু মিয়ানমারে তাদের অবস্থা কেমন সেটা আমি তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, জেনেছি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা খবরের মাধ্যমে৷ এখনো মনে আছে ২০১৭ সালের শেষের দিকে রোহিঙ্গা শিবিরে হঠাৎ দেখা হওয়া এক নারীর কথা৷ সদ্য গড়ে ওঠা এক শিবিরের চায়ের দোকানে বসে ছিলাম৷ তখন এক নারী এগিয়ে এসে জানালেন, কী নির্মমভাবে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, চোখের সামনে হত্যা করা হয়েছে তার পরিবারের সদস্যদের৷ ক্যামেরায় চেহারা দেখাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না তার, তিনি চেয়েছিলেন সবাই জানুক মিয়ানমার কতটা নির্মম আচরণ করেছে তাদের সঙ্গে৷ ফুপিয়ে কাঁদতে থাকা সেই নারীর কথা মনে হলে এখনো চোখে জল আসে আমার৷

গত বছর টেকনাফের এক ক্যাম্পে আরেক রোহিঙ্গা জানালেন বাবা মাকে নিজের মেয়ের কাপড় খুলে দিতে বাধ্য করতো মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা৷ এরপর সেসব মেয়েকে ধর্ষণ করা হতো৷ কখনো কখনো পুরো পরিবারকে ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে৷

মধ্যযুগীয় বর্বরতার এরকম অসংখ্য ঘটনা আমি শুনেছি রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে৷ সেসব ঘটনা কতটা সত্য তা যাচাই করা কঠিন, বা একরকম অসম্ভব কেননা মিয়ানমার রাখাইন অঞ্চলে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের যেতে দেয় না, স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়না৷ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিনবছর আগের সাড়ে সাত লাখ আর তার আগে আসা আরো অনেক রোহিঙ্গাদের মিলিয়ে দশলাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন শরণার্থীর হিসেবে আশ্রয় নিয়ে আছে বাংলাদেশে৷

টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০,০০০ শরণার্থী বাস করছে৷ সেখানে দেশি, বিদেশি আন্তর্জাতিক সংগঠন যত সুবিধাই প্রদান করুক না কেন, মনের আনন্দে কারো বাস করার কথা নয়৷ তারা মিয়ানমারে যে নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলে, সেরকম নির্যাতনের শিকার না হলে এভাবে বসবাসের আগ্রহ তৈরি হওয়ার কথা নয়৷ ফলে তাদের উপর ঘটে যাওয়া বর্বর বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় না৷

বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ
প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশের মানুষ অবশ্যই উদারতার পরিচয় দিয়েছে৷ এজন্য গোটা বিশ্বের উচিত বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা৷ বাংলাদেশের এই মানবিক আচরণে আমিও গর্বিত৷ তবে, এটাও মানতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির সীমাবদ্ধতাও রয়েছে৷ ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশটির এতটা সক্ষমতা নেই যে রোহিঙ্গাদের বছরের বছর আশ্রয় দিয়ে রাখবে৷ মোটের উপর রোহিঙ্গাদের আজীবন রাখার কোন দায় বাংলাদেশের নেই৷

Arafatul Islam Kommentarbild App
আরাফাতুল ইসলাম, ডয়চে ভেলে বাংলা

আর এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে প্রতিবছর ত্রিশহাজারের মতো রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে৷ সেসব শিশুর কি কোন ভবিষ্যত আছে বাংলাদেশে? রোহিঙ্গাদের পুরো একটি প্রজন্ম বাংলাদেশে বেড়ে উঠছে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ ছাড়াই৷ এই যে পুরো একটি প্রজন্ম তাদের ভবিষ্যত কী? বাংলাদেশ তাদের শিক্ষার সুযোগ দিচ্ছে না, দিচ্ছে না চাকুরির সুযোগ৷ কেননা এসব দিলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি ক্রমশ হারিয়ে যাবে৷ বরং বাংলাদেশের মূলস্রোতে মিশে যাবে তারা৷ ফলে বাংলাদেশের উদ্বেগ থাকাটাই স্বাভাবিক৷ অন্যদিকে, অযত্ন, অবহেলায় বেড়ে ওঠা একটি প্রজন্মকে বিপথে নেয়া কঠিন কিছু নেই৷ ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকিও এড়ানোর মতো নয়৷

রোহিঙ্গারা কিন্তু নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী৷ তারা শুধু চায় মিয়ানমার তাদেরকে সেদেশের নাগরিক হিসেবে মেনে নিক, তাদেরকে নাগরিকত্ব দিক যাতে তারা সেদেশের নাগরিক হিসেবে সেদেশে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারে, পারে নিজেদের মতো বড় হতে৷
আক্ষেপের কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার কূটনীতিকভাবে আগ্রহ দেখালেও নাগরিকত্ব দেয়াতো দূরে থাক, রাখাইনে বিভিন্ন ক্যাম্প গড়ে সেসব ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের রাখার পরিকল্পনা করছে৷ রোহিঙ্গাদের কাছে সেই ক্যাম্পের চেয়ে কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ, ঘিঞ্জি শিবির অনেক নিরাপদ৷ কেননা, এসব শিবিরে যেটুকু স্বাধীনতা বাংলাদেশ তাদের দিচ্ছে, মিয়ানমার সেটুকুও দেবে না৷ তাহলে তারা সেখানে ফিরবে কেন?

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোই সমাধান
আমার কাছে মনে হয় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশকে যে দেশটি সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারে, সেটি হচ্ছে চীন৷ বর্তমানে ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে, বা সহজ করে বললে বাংলাদেশকে নিজেদের মিত্র হিসেবে আরো কাছে টানতে চীন অনেক কিছু করছে৷ বাংলাদেশ চাইলে এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান করে ফেলতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস৷ চীন চাপ দিলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের কিছু অধিকার নিশ্চিত করে ফেরত নিতে পারে৷

তবে, এভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো না গেলে বিকল্প আর কী কী হতে পারে সেটাও ভাবা উচিত৷ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে বাংলাদেশ ফেরত পাঠাতে পেরেছিল ১৯৭৯ সালে৷ কোন প্রক্রিয়ায় সেটা সম্ভব হয়েছিল, তাও মূল্যায়ন করা যেতে পারে৷

মোদ্দা কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একার মাথাব্যাথা নয়৷ গোটা বিশ্বের দায় রয়েছে এই সমস্যা সমাধান করার৷ আর রোহিঙ্গাদের তাদের অধিকারসহ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোটাই সংকটের একমাত্র সমাধান৷ এই সমাধান যত দ্রুত মিলবে ততই মঙ্গল৷