1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে 

২৩ আগস্ট ২০১৯

অনেক রকম হিসাব থাকলেও ১২ লাখ বা তার বেশি রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে৷ হাজার তিনেক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছিল বার্মা৷ কিন্তু রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে চান না৷ অবশ্য যদি নিজেদের ঘর-বাড়ি বলে কিছু তাদের থেকে থাকে৷

https://p.dw.com/p/3OMu1
Rohingyas Flüchtlinge kehren nach Myanmar zurück
ছবি: DW/A. Islam

সামাজিক গণমাধ্যমে দেখছিলাম, অনেকেই বলছেন, যতদিন দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো তাদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে ততদিন তারা এখানেই থাকবেন৷ রোহিঙ্গাদের বার্মায় ফিরিয়ে দিতে চাইলে সব সাহায্য সব মাগনা খাবার বন্ধ করে দিতে হবে৷ একথা সত্যি, আমাদের ছোট তরী আমাদের নিজেদের ভারেই কানায় কানায় পূর্ণ; তার ওপর বাড়তি কেউ নিদারুণ অসময়ের মেহমান৷ গরিব গৃহস্থের প্রাচ্যদেশীয় সহমর্মিতায় বিপদে পড়া শিশু-বৃদ্ধ-নারী-পুরুষকে আমরা জায়গা দিয়েছি বটে, কিন্তু আমাদের মনে সব সময়েই এই আশা ছিল যে তারা ফিরে যাবেন৷

কিন্তু আমাদের এই আশা কি কোনো যুক্তি-বুদ্ধিসম্ভূত নাকি কেবলই ‘উইশফুল থিংকিং’? যে দেশে রোহিঙ্গারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো প্রাথমিক বা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, যাদের ভিটেছাড়া করা হয়েছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে গুলি চালিয়ে, যে দেশের মানবিক বিপর্যয় চালানো অত্যাচারের পরও শান্তি-নোবেলজয়ী অত্যাচারীদের পক্ষেই থাকেন, কোনো এক সকালে তারা আবার হাসিমুখে সেই দেশে ফিরে যাবেন এমন আশা আমরা আসলে কেন করেছিলাম? পুরোটাই লোক দেখানো, অথবা নিজেদের স্বান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা নয়ত? 

আর তালিকার কথা বলতে হয়, কোন বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে হাজার বিশেক মানুষের নাম তোলা হলো, মিয়ানমার সরকারও বা কোন বিবেচনাতে সাড়ে তিন হাজার মানুষকে ফেরত নিতে একমত হলো তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়৷ তালিকা করার আগে কি সেইসব রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল? সম্ভাব্য প্রত্যাবাসন কর্মসূচির ঠিক আগে আগে তাদের জানানো এবং তাদের বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা, ভয় পাওয়া, আত্মহত্যা করতে চাওয়া এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘জোর করে কাউকে ফেরত পাঠানো হবে না’ বক্তব্যকে দুটিমাত্র শব্দেও বলা যায় — অদূরদর্শিতা ও বুদ্ধিহীনতা৷ 

কিন্তু কথা হলো, এইসব দৃশ্য ও অঙ্কে অংশ নেওয়া, বলা উচিত, প্রম্পটারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে পার্ট গাওয়া ছাড়া বাংলাদেশের আর কী বিকল্প ছিল বা আছে? একথা এখন পরিষ্কার যে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমাদের পাশে আসলে কেউ নেই৷ মিয়ানমারের পাশে চীন থাকার প্রমাণ জোরেসোরেই দিয়ে যাচ্ছে৷ আমাদের পাশে থাকার কথা থেকে যাচ্ছে কিতাবেই, বাস্তবে তা এক কলসি মিষ্টিকথার পানিতে একমুঠো সাহায্য আর এক চিমটি প্রতিশ্রুতির ঘুটায় বানানো সর্বরোগহর পানীয় মাত্র৷ 

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে এবং তাদের জন্য যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মায়ানমার সরকারের উপর যথেষ্ট চাপ দিতে বাংলাদেশের সামর্থ্যকে কী কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলা যায়? আজ একই ঘটনা অন্য কোনো জায়গায় বা অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে ঘটলে কি আলাদা ফল হতো? হয়ত হতো, কারণ, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ কোনো একটা পক্ষ বা জোটের প্রতি একনিষ্ঠ নয়৷ রোহিঙ্গারা মুসলিম বলেই এই পীড়নের সম্মুখীন হচ্ছে — এই বিবেচনায় মুসলিম জাহান এগিয়ে এসে এ বিষয়ে সোচ্চার হবে, আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে মিয়ানমারকে বাধ্য করবে লাইনে ফিরিয়ে আনতে, এরকম একটা আশা হয়ত ঢাকার ছিল৷ কিন্তু আরব বিশ্ব এখন আর ততটা প্রভাবশালী নয়, এক দেড় দশক আগেও যে প্রভাবের কথা ভেবে বা মনে করে দারুণ তুষ্টিতে ভুগতেন তেলসাম্রাজ্যের প্রধানেরা৷ বাংলাদেশের হয়ত আশা ছিল, ভারত খুব শক্ত একটা অবস্থান নিয়ে পাশে দাঁড়াবে, কিন্তু পুরো বিষয়টিই দিল্লি যেন দেখছে চলমান ট্রেনের জানালা থেকে৷  

Khaled Muhiuddin
খালেদ মুহিউদ্দীন, প্রধান, ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগছবি: DW/P. Böll

তো বাংলাদেশ এখন কী করবে? একথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে, কক্সবাজারের থানাগুলোতে এই ১০-১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আর রাখা যাবে না৷ অনেকে বলছেন, অনেক আরাম-আয়েসে রয়েছেন তারা৷ বছর খানেক আগে সারাদিন উখিয়া ছিলাম৷ মনে হয়েছে, রোহিঙ্গারা যেভাবে আছে তাকে বেঁচে থাকা বলে না, বড়জোর মরে না যাওয়া বলা চলে৷ তবে না মরে যাওয়ার এই সংগ্রামে যে-কোনো বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গাদের অনেকে হেরে যেতে পারেন৷ মাটি ধসে গণকবর হতে পারে প্রাণভয়ে নিজের ভিটে থেকে পালানো ভূমিপুত্রদের৷ 

মাটি ধসে তারা যে মারা যেতে পারেন বিষয়টি দেশি-বিদেশি কর্তৃপক্ষের সকলে জানেন৷ তাই তাদের বাঁচাতে কাটা হচ্ছে পাহাড়৷ ছোট, মাঝারি পাহাড় কেটে সমান করে সেখানে নতুন ক্যাম্প হচ্ছে৷ আক্ষরিক অর্থেই বদলে দেওয়া হচ্ছে কক্সবাজারের মানচিত্র৷ পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের ওপর এর সাংঘাতিক প্রভাবও প্রায় সবাই জানেন৷ 

এগুলো আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে শঙ্কার কথা, যা কম-বেশি আমরা জানি৷ কিন্তু ওরা মানুষ৷ বিপদে পড়ে আমাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে তারা৷ কিন্তু যেভাবে তারা আছেন, সেভাবে কোনো মানুষ থাকতে পারে না৷ মানুষ মুরগি নয় যে দুইবেলা শুধু খেয়ে ঘুমিয়ে জীবন পার করে দেবে৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য কাজ ও বিনোদনের অধিকার কতটুকু নিশ্চিত করা যাচ্ছে বা যায় এরকম ক্যাম্পে? আর এসব বিষয়ে মোটামুটি একটি মানে না আনতে পারলে আর একই এলাকায় বাস করলে তার প্রভাব কী ভয়ানক হতে পারে এর সবই কিন্তু কয়দিন পরপর সংবাদমাধ্যমে আসছে৷  একথাও স্পষ্ট যে, ১০ লাখের বেশি মানুষকে মানবিক অধিকারবঞ্চিত রাখলে যে-কোনো সময় তার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে৷ ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়৷ 

সরকারের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, প্রকৃত অবস্থা স্বীকার করে নিন৷ এটাই বাস্তবতা যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আর মিয়ানমার ফিরে যাবে না৷ আমাদের পক্ষে কোনো রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে খুব চাপ দেবে মিয়ানমারকে, এরকম নিকট ভবিষ্যতে না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি৷ তাই বাংলাদেশ সরকারকে দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলোকে সমন্বিত করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে অন্তত ১০ বছরের পরিকল্পনা করতে হবে৷ কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও জারি রাখতে হবে৷

আমাদের এটাও ভেবে দেখতে হবে যে, কোনো একটি বিশেষ ব্যবস্থায় এই রোহিঙ্গাদের সারা দেশে ছড়িয়ে কাজে লাগানো যায় কিনা৷

অনেকে বলছেন তারা জঙ্গি হতে পারেন, অনেক খারাপ কাজে লিপ্ত হতে পারেন৷ সেই ঝুঁকি তো থাকলোই৷ আমরা নিজেরাও সেই অর্থে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ৷ গত কয়দিনের বা কয় বছরের খবর তারই সাক্ষ্য দেয়৷ তাছাড়া আমরা শুধু আমাদেরটা ভাববো, কক্সবাজারবাসীর কথা ভাববো না, তা কি হয়? ৫৬ হাজার বর্গমাইল নিশ্চয়ই কয়েক হাজার একর থেকে বড়৷ 

Khaled Muhiuddin
খালেদ মুহিউদ্দীন ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত।