1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গারা যেভাবে বাংলাদেশি ভুয়া পাসপোর্ট পায়

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমকে জানান, প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা অবৈধ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন৷ রোহিঙ্গারা এই পাসপোর্ট পায় কীভাবে?

https://p.dw.com/p/35E0j
ছবি: Reuters/M.P. Hossain

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করার বিষয়টি ডয়চে ভেলেকে খুলে বলেন কক্সবাজারের উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের৷ তিনি বলেন, ‘‘ধরুন, ময়মনসিংহে এক নারীর নাম মরিয়ম৷  তিনি বাংলাদেশেরই নাগরিক৷ তাঁর একটি ন্যাশনাল আইডি কার্ড আছে৷ ওই ন্যাশনাল আইডি কার্ডটি জোগাড় করা হয়৷ নাম ঠিকানা, পিতা বা স্বামীর নাম সবই ঠিক থাকে৷ ছবিও তাঁর৷ এই একটি ডকুমেন্ট ধরেই আরো প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট পাওয়া যায়৷ এরপর ওই নামেই আরেক রোহিঙ্গা নারীর জন্য পাসপোর্টের আবেদন করা হয়৷ কেউ ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে গিয়ে ধরা পড়েন, কেউবা অন্য কোনো পর্যায়ে৷ আর যারা ধরা পড়েন না, তারা পাসপোর্ট পেয়ে যান৷’’

রোহিঙ্গাদের কারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেন? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের আরো অনেক দেশে থাকেন৷ তাদের সঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকদের পরিচয় হয়৷ তাদেরই কেউ কেউ দেশে লোক ধরে এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন৷ এর বাইরে একটি দালালচক্রও গড়ে উঠেছে৷’’

রোহিঙ্গারা যেভাবে ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেন

তবে এর সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের একশ্রেণির কর্মচারীদের যোগসাজশেরও অভিযোগ আছে৷ কারণ, তা না থাকলে ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই ধরা পড়ে যাওয়ার কথা৷ তাছাড়া পুলিশও সহায়তা করে, কারণ পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট ছাড়া পাসপোর্ট হয় না৷

তিনি আরো জানান, ‘‘ভাষার কারণে অনেক রোহিঙ্গা ধরা পড়ে৷ যারা ভাষা রপ্ত করতে পারেন, তাদের ধরা কঠিন৷’’

জানা গেছে, গত অক্টোবর থেকে কক্সবাজার পুলিশ ও জেলা প্রশাসন অবৈধভাবে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্রধারী ৩ শতাধিক রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করেছে৷

শুধু কক্সবাজার নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় প্রতিদিন পাসপোর্ট নিতে গিয়ে রোহিঙ্গা আটকের খবর আসে৷ বগুড়ায় গত ১২ অক্টোবর আটক হন ইন্দোনেশিয়া প্রবাসী রোহিঙ্গা আবু সালেহ'র স্ত্রী হাজেরা বিবি (২২), তাঁর ছেলে ওসমান গণি (৫) ও হাজেরার মা আমেনা খাতুন ওরফে রমিজা (৪৫)৷ তারা চট্টগ্রামের ট্রেনখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকতেন৷

বগুড়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক শাহজাহান কবির জানান, হাজেরা বিবি ও তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য পাসপোর্ট করার জন্য অনলাইনে আবেদন করেন৷ ১২ অক্টোবর বিকেলে তাঁরা অফিসে ফরম জমা দিতে আসেন৷ এ সময় হাজেরা বিবিকে তাঁর নাম, বাবার নাম ও ঠিকানা জানতে চাইলে অসংলগ্ন আচরণ করেন৷ সন্দেহ হলে তখন ফরমসহ হাজেরাকে আটক করে সদর থানা পুলিশে দেয়া হয়৷ এরা দালালের মাধ্যমে দুপচাঁচিয়া সদর ইউনিয়ন কার্যালয় থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করেন৷

বগুড়ার সাংবাদিক নাজমুল হুদা নাসিম জানান, ‘‘এই প্রক্রিয়ায় আব্দুল মান্নান নামে একজন দালাল জড়িত৷ তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া৷ সে এখন পলাতক৷ সেই জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র জোগাড় করে দেয়৷’’

জানা গেছে, দালালরা প্রথমে তাদের মক্কেলের সমবয়সি স্থানীয় বাংলাদেশির আসল জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে৷ এরপর ওই পরিচয়পত্র দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করে৷ পরবর্তীতে আসল পরিচয়পত্র, প্রকৃত ব্যক্তির ছবি ও জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে৷ রোহিঙ্গার আসল পরিচয় তখন গোপন করা হয়৷

এরপর তারা পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করে ও পাসপোর্টের জন্য ছবি তোলে৷ অসাধু কর্মকর্তারা টাকার বিনিময়ে তাদের সাহায্য করেন৷ রোহিঙ্গাদের একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট করে দেয়ার জন্য ৪০-৫০ হাজার টাকা দাবি করে দালালরা৷

ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন তাদের এক প্রতিবেদনে ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়া মোশাররফ মিয়া নামে এক রোহিঙ্গার কথা জানিয়েছে৷ মোশাররফ মিয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ২০০১ সালে বাংলাদেশে আসেন ও কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন৷ কয়েক মাসের মধ্যে তিনি স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ পান৷ এর পরের এক দশক ধরে স্থানীয় বাসিন্দা ও বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন৷ ২০১২ সালের শেষ দিকে নিজের জন্য বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র জোগাড় করতে সক্ষম হন তিনি৷ তারপর বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করে সৌদি আরব চলে যান৷

মোশাররফের স্ত্রী খাদিজাও ২০০২ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন৷ এখন খাদিজা ও তার দুই ছেলেরও বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে৷ তার দুই ছেলেই বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে আর তারা স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করছে৷ খাদিজার ২৩ বছর বয়সি ছোটভাই শহিদুল্লাহ ২০১৩ সাল থেকে কক্সবাজারের একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করছে৷ শহিদুল্লাহ জানান, তাদের গ্রামের অনেকেই বাংলাদেশে পড়াশোনা করতে এসেছে৷ তবে তিনি বলেন, ‘‘অনেকেই দেশে ফিরে গেছে আর আমার মতো অনেকেই বিদেশ যাওয়ার জন্য বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড়ের চেষ্টা করছে৷’’

শহিদুল্লাহর মা ও দুই ছোট ভাই গত বছর মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এখন বালুখালি রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থান করছে৷ তবে তারা সেখানে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করেছে৷ শহিদুল্লাহ বলেন, ‘‘আমরা যদি একবার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করি, তাহলে আর বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা পাসপোর্ট পাবো না৷’’ মিয়ানমারের বুথিয়াডং কিনিসি এলাকা থেকে পালিয়ে আসা আরেক রোহিঙ্গা সেলিম ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে মালয়েশিয়া ঘুরে এসেছেন৷ ২৯ বছর বয়সি এই যুবক বলেন, ‘‘ভুয়া কাগজপত্রের কারণে মালয়েশিয়া সরকার আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘স্থানীয়দের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ থাকায় আমি বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়ে যাই৷ এখন আমি আরেকটি মুসলিম দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছি৷’’

সূত্র জানায়, পাসপোর্ট অফিসের যোগসাজশ ছাড়া রোহিঙ্গাদের পক্ষে বাংলাদেশি পরিচয়ে পাসপোর্ট করা অসম্ভব৷ কারণ, যার জাতীয় পরিচয় পত্র ব্যবহার করা হয় সেটা আসল৷ সেখানে যার পরিচয়পত্র তারই ছবি ও নাম ঠিকানা থাকে৷ দালালরা বয়সের সঙ্গে মিল রেখে এই ধরনের পরিচয় পত্র জোগাড় করে৷ আবেদনপত্রে রোহিঙ্গার ছবিই থাকে৷ তবে নাম, ঠিকানা প্রকৃত পরিচয় পত্রের৷ তাই একটু খেয়াল করলেই তা ধরা পড়ে৷

গত মে মাসে নরসিংদীতে পাসপোর্ট করতে আসা চার রোহিঙ্গা নারীকে আটক করে পুলিশ৷ তারা হলেন মিয়ানমারের মংডু জেলার বশরিজাদ এলাকার হামিদ উল্লাহর মেয়ে নূর বিবি (১৪), একই এলাকার মামু সুলতানের মেয়ে রাশিদা বেগম (১৬), দোলদারী জেলার চকরিয়া এলাকার ছলিম উল্লাহর মেয়ে আমিনা বেগম (২৩) এবং মংডু জেলার গুদুছড়া এলাকার মোহাম্মদ হোসেনের মেয়ে আনোয়ারা বেগম৷

পুলিশ আরও জানায়, তাদের পাসপোর্টের আবেদনপত্রে সত্যায়ন করেন নোটারি পাবলিকের সনদপ্রাপ্ত স্থানীয় আইনজীবী রেজাউল করিম বাসেত৷ আবেদনপত্রে তার সত্যায়নটি অনেকটা অস্পষ্ট৷ এই অস্পষ্ট সত্যায়নের পরও আবেদনপত্রটি প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করেন নরসিংদী আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (এডি) জেবুন্নাহার বেগম৷

পুলিশ জানায়, নরসিংদি পাসপোর্ট কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুজন হাওলাদার ও কোষাধ্যক্ষ আরিফুল হক সুমনের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা চার নারীর প্রাথমিক আবেদনপত্রে ছবি উঠানো ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার অনুমোদন দেন এডি জেবুন্নাহার বেগম৷

তাদের কথাবার্তা ও ভাষার কারণে ধরা পড়ে যায়: মো. সৈয়দুজ্জামান

নরসিংদী সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সৈয়দুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাদের কথাবার্তা ও ভাষার কারণে ধরা পড়ে যায়৷ রায়পুরার একজন দালাল তাদের নিয়ে এসেছিল৷ পাসপোর্ট অফিসই শেষ পর্যন্ত তাদের ধরে ফেলে৷ আমরা এখন পার্সপোর্ট অফিসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে এ ধরনের আরো কোনো প্রচেষ্টা হয় কিনা সে ব্যাপারে নজরদারি করছি৷’’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপ কমিশনার মশিউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ আমরা এখনো এ ধরনের কোনো ঘটনা পাইনি৷ তবে ঢাকার বাইরে জেলা পাসপোর্ট অফিসগুলোয় এরকম ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ আছে৷ আমরা ঢাকায়ও নজরদারি করছি৷’’

আমরা এখনো এ ধরনের কোনো ঘটনা পাইনি: মশিউর রহমান

গত বছরের আগস্টে মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা৷ অতীতেও সহিংসতা থেকে বাঁচতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল৷ বাংলাদেশের ভুয়া পার্সপোর্টের মাধ্যমে এদের মধ্যে ঠিক কতজন এভাবে বিদেশে গেছে তার কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই৷ তবে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরল ইসলাম গত এপ্রিলে বলেছিলেন, প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছে৷