1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শুধু ক্রিকেটেরই দায় জেন্টেলম্যান হওয়ার!

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সবকিছুই তো বদলে গেল৷ ক্রিকেটের সেই ধ্রুপদী রূপ, ভদ্রতা, সৌন্দর্য, সম্মান, ব্যাকরণ৷ তা হলে পড়ে থাকলো কী?

https://p.dw.com/p/3pax8
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে টেন্ডুলকার
১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে টেন্ডুলকারছবি: Adrian Murrell/ALLSPORT

সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ক্রিকেট হলো জেন্টেলম্যানদের খেলা৷ মারদাঙ্গা বা খুনখারাপির খেলা নয়, একেবারে ধ্রুপদী স্পোর্টস৷ শীতের দুপুরে দুধসাদা জামা-প্যান্ট, সোয়েটার, প্যাড পরা ব্যাটসম্যানের হাতের উইলো কাঠের ব্যাটের ঠিক মাঝখানে এসে যখন লাগে লাল রঙের বল, তখন এক মধুর শব্দ হয়৷ সেটা না কি অসাধারণ কোনো গায়কের নিখুঁত তান শোনার মতোই শ্রুতিমধুর৷ ওই শব্দ এবং তারপর কভার ও এক্সট্রাকভারের মধ্যে দিয়ে মাটি ঘেঁষা বল সোজা বাউন্ডারি সীমানার বাইরে যাওয়া দেখতে ও শুনতেই তো মাঠে যাওয়া৷ তার সঙ্গে ব্যাটসম্যানের পা বলের লাইনে থাকবে, মাথা ঝুঁকে থাকবে৷ সবমিলিয়ে একটা শিল্প সৃষ্টি হবে৷ এর নামই ক্রিকেট৷

শুনেছি, বিজয় হাজারে ক্রিজে নেমে শট নেওয়ার আগে আধঘণ্টা বা তারও বেশি সময় নিতেন সবকিছু দেখে নেয়ার জন্য৷ পিচের অবস্থা, বোলারের লাইন-লেন্থ, তাঁর নিজের চোখ সইয়ে নিয়ে টাইমিং নিখুত হচ্ছে কি না, তা বুঝে নিতে ওই সময়টুকু তো লাগবেই! তারপর শুরু হবে শট খেলা৷ সেটাও বল দেখে শুনে, কেতাবি ঢঙে৷ ব্যাটের কোণে লেগে স্লিপের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে চার হলো, এ তো লজ্জার কথা৷ ভালো ব্যাটসম্যানের শট হবে নিখুঁত৷ ব্যাটের মাঝখান দিয়ে খেলতে হবে, শট হবে ব্যাকরণ মেনে৷ তবেই না তা ক্রিকেট৷ গাভাস্কার যখন ব্যাট করতেন, তখন অন, অফ বা স্ট্রেট ড্রাইভ দেখে মনে হতো, একেবারে ক্রিকেট বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে শটগুলো৷ বিশ্বনাথের লেট কাট দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত৷ পরে ভিভ রিচার্ডস যখন বোলারদের কচুকাটা করতেন, তাঁর শটও থাকত ব্যাকরণ মেনে৷ ব্রায়ান লারা, শচিন টেন্ডুলকরও তাই৷

তার উপর ক্রিকেটাররা হবেন একেক জন জেন্টলম্যান৷ বোলাররা একবার আবেদন করবেন৷ আবেদন বাতিল হয়ে গেলে মুখ বুজে চলে যাবেন রান আপের দিকে৷ গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ যেমন৷ নিজের যদি মনে হয় আউট ছিলেন বা সত্যিই ক্যাচ ছিল, কোনোদিন আম্পায়ারের দিকে তাকাতেন না৷ সোজা হাঁটা দিতেন প্যাভিলিয়নের দিকে৷ গাভাস্কারও তাই করতেন৷ বিশ্বনাথ তো একবার আম্পায়ার আউট দেয়ার পরেও তাঁর অনুমতি নিয়ে বিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে ডেকে এনেছিলেন ক্রিজে৷ কারণ, আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল৷ এই হলো ক্রিকেট৷ ধ্রুপদী, ভদ্রলোকের খেলা৷

দর্শকও আলাদা৷ কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান মাঠের ফুটবল দর্শকদের সঙ্গে ইডেনের দর্শকদের চরিত্রগত ফারাক বিশাল৷ ফুটবল মাঠের উত্তেজনা, হইহুল্লোড়, গালাগালির কোনো রেশ ইডেনে থাকত না৷ সেখানে শীতের দুপুরের রোদ গায়ে মেখে কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ধ্রুপদী ক্রিকেটের সৌন্দর্য দর্শন৷ গালাগালি দূরস্থান, অকারণ একটা কথাও নয়৷ বিপক্ষের প্লেয়ার ভালো শট মারলেও হাততালির বন্যা৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজের এভার্টন উইকস, ক্লাইভ ওয়ালকট, রোহন কানহাই তো ইডেনের দর্শকদের নয়নের মণি৷ ইংল্যান্ডের দীর্ঘদেহী টনি গ্রেগ সেঞ্চুরি করার পর হাঁটু মুড়ে বসে জোড়হাত করে ইডেনের অভিনন্দন গ্রহণ করেছিলেন, সেটাই তো ক্রিকেট৷ মুহূর্তে ইডেনের মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি৷ সারাদিনে কত রান উঠল, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো, খেলাটা দৃষ্টিনন্দন হলো কি না, ব্যাকরণ মেনে হলো কি না, তা দেখা৷

এই ক্রিকেটই তো শিখিয়েছিল, হারা-জেতা বড় কথা নয়, আসল কথা হলো খেলাটাকে ভালবাসতে হবে, আনন্দ দিতে হবে, আনন্দ পেতে হবে৷ ক্রিকেট মানে পাঁচদিনের দীর্ঘ টেস্ট ম্যাচ৷ একটা টিকিট পেলে মনে হতো বিশ্বজয় হয়ে গেছে৷ এমনো হয়েছে, একটা টিকিট জোগাড় করা গেছে৷ তাতে লাঞ্চ পর্যন্ত একজন, টি পর্যন্ত অন্য বন্ধু এবং তারপর শেষের অংশটুকু তৃতীয় বন্ধু দেখেছে৷ তখন এভাবে খেলা দেখা সম্ভব ছিল৷ তখন ক্রিকেট উপভোগ করার বিষয় ছিল৷ সেই ইডেনেই যখন ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা' বলে ভয়ংকর রব উঠল, তখন বোঝা গেল, ভারতে ক্রিকেটের নন্দনকানন বদলে গেছে৷ ধ্রুপদী ক্রিকেটের জায়গায় জয়ের তীব্রতম আকাঙ্খাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে৷

দেখতে দেখতে কত কীই তো বদলে গেল৷ পাঁচদিনের ক্রিকেটের বদলে ১৯৮৩ সালে প্রথমে এলো ষাট ওভার ও পরে পঞ্চাশ ওভারের একদিনের ক্রিকেট৷ তাকে পিছনে ফেলে দিয়ে ২০০৫ থেকে টি-২০৷ এখন তো শোনা যাচ্ছে ১০ বা ১৪ ওভারের খেলা হবে৷ ক্রিকেটের পুরো চেহারাটাই বদলে গিয়েছে৷ বদলে যাবে৷ বদলে গিয়েছে ক্রিকেটের চাল-চরিত্র-চেহারা৷ বদলে গিয়েছে ধারণা৷ ক্রিকেটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ঢুকে গেছে জাতীয়তাবাদ৷ এসে গেছে অপরিমিত অর্থ৷ ক্রিকেট মানে এখন শুধু বিনোদন৷ নিজের টিম ব্যাট করলে শুধু ছক্কা, চার, বিপক্ষের টিম ব্যাট করলে বলে বলে উইকেট৷ বিদায় নিয়েছে ক্রিকেটের ভদ্রতা, এটিকেট৷ ঢুকে গেছে স্লেজিং, আম্পায়ারের উপর চাপ দিয়ে আউট আদায় করা৷ স্ট্যাম্প ক্যামেরার কল্যাণে জানা যাচ্ছে, ক্রিকেটাররা কীভাবে আম্পায়ারকে নাম ধরে ডেকে বলছেন, বলটা তো সোজা উইকেটেই লাগত৷ খেলার মাঠে আবেগের বিস্ফোরণ হলে, জঙ্গি, লড়াকু মনোভাবের ছড়াছড়ি হলে টিআরপি বাড়ে৷ সেই সব ক্রিকেটারকে নিয়ে পাতার পর পাতা আলোচনা হয়৷ লর্ডসের মক্কায় নিজের জামা খুলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়৷ কিছুদিন আগে হরভজন সিং একটি টিভি শো-তে বলেছিলেন, তিনিও একই কাজ করতে গিয়েছিলেন৷ রাহুল দ্রাবিড় তাঁকে বাধা দেন৷ সৌরভের জামা খোলা ও ক্রিকেটের মক্কায় গিয়ে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে দেয়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বুক এখনো গর্বে ফুলে ওঠে৷ কিন্তু সাবেককালের ক্রিকেটভক্ত থাকলে বলতেন, দিস ইস নট ক্রিকেট৷

তাই এখন ক্রিকেটে যা হচ্ছে, তার অনেক কিছুই ব্যাকরণের বাইরে৷ দীর্ঘদিন পরে ভারতীয় দল যখন পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিল, তখন সাবেক ও প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘দিল জিতকে আনা’, মানে হৃদয় জিতে এস৷ অসাধারণ পারফরমেন্স করে ভারতীয় ক্রিকেটাররা হৃদয় জিতেই এসেছিলেন৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

কোনো সন্দেহ নেই, কুড়ি-বিশের ক্রিকেট এসে এমন একটা উত্তেজনা দিয়েছে, যার থেকে বেরনো কঠিন৷ এর বিনোদনমূল্য অসীম৷ বলে বলে মার অথবা আউট৷ যে মারে ক্রিকেট ব্যাকরণের ছোঁয়া নাই বা থাকল, কিন্তু হেলিকপ্টার শট, স্কুপ স্টেপ আউট করে ক্রস ব্যাটে তাড়ু শট, ব্যাটের কানায় লেগে বল উড়ে যায়, ছক্কা হয়, লোকের হাততালির ঝড় বইতে থাকে৷ বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনির জনপ্রিয়তা বা অর্থ শাহরুখ, সালমানের থেকে একেবারেই কম নয়৷

ক্রিকেট বদলে গেছে৷ আমূল বদলেছে৷ সেই শট, ধৈর্য, ভদ্রতা, সৌজন্য, জেন্টেলম্যানদের গেম কিছুই নেই৷ পয়সা, জুয়া, বিনোদন, উত্তেজনাসর্বস্ব খেলাকে অতীত দিনের মানুষরা টাইম ক্যাপসুলে এসে দেখলে বলতেন, নো ওয়ে, দিস ইস নট ক্রিকেট৷

কিন্তু ক্রিকেটকে দোষ দিয়ে কী লাভ৷ সবই তো বদলে গেছে৷ অতীতের সেই সময় আর নেই৷ পরিবেশ, পরিস্থিতি, মূল্যবোধ, জীবন সংগ্রাম, চাওয়া-পাওয়া, যৌথ-পরিবার, আশা, আকাঙ্খা, লোভ, উচ্চাশা সবকিছুর বদল হয়েছে৷ সব বদলাবে, আর ক্রিকেট তার ব্যাকরণ আঁকড়ে থেকে ভদ্রলোকের নান্দনিক খেলা হয়ে থাকবে, তা কী হয়? তবে এতকিছুর পরেও যখন নিখুঁত আউটসুইংয়ে উইকেট তুলে নেন কোনো পেসার, কোনো নিখুঁত স্ট্রেট ড্রাইভ বা স্কোয়্যার ড্রাইভে ব্যাটের মাঝখানে বল লেগে বিদ্যুৎগতিতে বাউন্ডারি সীমানা ছাড়ায়, তখনো সেই মধুর শব্দ ওঠে৷ বোঝা যায়, সবকিছু হারায়নি, হারায় না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য