1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শ্রমকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কবে হবে?

৩ জানুয়ারি ২০২০

একটা সার্বজনীন সত্য হলো, বাংলাদেশে শিক্ষার মান বাড়ছে না৷ একইসঙ্গে শ্রমবাজারের সঙ্গে এর সম্পর্কও খুব দুর্বল৷ অথচ বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী তরুণ, যাদের সঠিক ব্যবহার না করে উন্নত দেশের মাইলফলক অর্জন করা সম্ভব নয়৷

https://p.dw.com/p/3VfcA
Bangladesch  Studenten Universität
ছবি: picture-alliance/dpa/Z. H. Chowdhury

একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে৷ ‘‘বারেক যে চলে যায়, তারে তো কেহ না চায়, তবু তার কেন এত মায়া?'' কার প্রতি মায়ার কথা বলছেন কবি? ধরিত্রীর প্রতি? কিংবা যা ফেলে গেছে তার প্রতি? আমি বেঁচে আছি, তাই হয়তো ফেলে আসা সময়ের প্রতি বড় মায়া কাজ করে৷

এক দেড় বছর আগে আমি আর আমার ভাগ্নে নটরডেমে গেলাম কলেজের ৭০ বছর উদযাপনে সামিল হতে৷ গিয়েই মনে হলো, এইতো সেদিন ৫০ বছর উদযাপন করলাম৷ তখন আমি কলেজের ছাত্র৷ আর এখন আমার ভাগ্নে পড়ছে সেখানে৷ কেমন করে ফোঁটা ফোঁটা ঘামের মতো এক পলকে গড়িয়ে গেল কুড়িটি গ্রীষ্মকাল!

এসে গেল ২০২০৷ নতুন দশকে এসে এই কুড়ি-বাইশ বছরে কী করলাম ভাবছি সেকথা৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লাম এমন একটি বিষয়ে, যা ‘ভালো সাবজেক্টের' সংজ্ঞায় পড়ে না৷ সবাই কম্পিউটার, অর্থনীতি, সাংবাদিকতা, ইংরেজি, ব্যবসা - এসব পড়ে৷ আমি পড়লাম মনোবিজ্ঞান৷ আর আগ্রহ রয়ে গেল খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা এসব ‘অদরকারি' বিষয়গুলোতে৷ সাংবাদিকতা না পড়েও বনে গেলাম সাংবাদিক! অবশ্য পরবর্তীতে দেশের বাইরে আরো দু'টো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে কিছুটা হলেও পূরণ করেছি পেশার অ্যাকাডেমিক ঘাটতি৷ স্বাভাবিকতার হিসেব কষলে একেবারে ‘বেড়াছেড়া' অবস্থা!

হলফ করে বলতে পারি, আমার মতো এমন ‘বেড়াছেড়া' অবস্থা অনেকের৷ আমার অনেক বন্ধু-আত্মীয়-পরিজনকেই দেখেছি৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইসলামের ইতিহাস, এখন নোট গুনছেন ব্যাংকের কাউন্টারে বসে৷ কেউ আবার ভূগোল পড়ে এনজিওর আয়ব্যয়ের খাতা কাটছেন অন্ধকার রুমের ভেতর৷ প্রাণীবিদ্যা পড়ে এখন পুলিশের ইউনিফর্ম গায়ে চোর-ডাকাতদের পেঁদিয়ে বেড়াচ্ছেন এমন লোকও পাওয়া যাবে৷ আমি কোনো পেশাকে ছোট করছি না৷ কিন্তু যে মানুষটা যা পড়ছেন, সে জায়গায় তিনি কতটা অবদান রাখতে পারছেন? যদি তা নাই হয়, তাহলে সেই বিষয় তার পড়ার দরকার কী?

HA Asien | Zobaer Ahmed
যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলে

আসলে আমাদের শ্রমকেন্দ্রিক পাঠের অবস্থা এমনই জবরজং৷ দু'একটি পেশা বাদ দিলে কোথাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যা শেখানো হচ্ছে, তার মূল্যায়ণ করার পরিস্থিতি নেই৷ সবচেয়ে বেশি চাপ তো সরকারি চাকরির পরীক্ষায়৷ কে কোন বিষয় থেকে এসেছেন তার কোনো বালাই নেই৷ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আপনি হয়ে যেতে পারেন ম্যাজিস্ট্রেট৷ কিংবা ইংরেজি সাহিত্য পড়ে যশোরের এসি (ল্যান্ড) বা মঠবাড়িয়ার ইউএনও হতে পারেন৷ আমার বন্ধু হয়েছেন৷ তিনি মেধাবী, তাই তিনি সেখানেও সেরা৷ কিন্তু এই মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুযোগ তৈরির দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷

যেমন ধরুন, আপনি রাষ্ট্র, আপনি ভাবলেন, আগামী পাঁচ, ১০ বা ২০ বছরে দেশে দশ হাজার ডেটা সায়েন্টিস্ট বা অ্যানালিস্ট তৈরি করা দরকার, অথবা সুন্দর পিচাই বা জাহিদ সবুরের একশ' সিইও বা ডিরেক্টর তৈরি করা দরকার, যারা গুগলের মতো কোম্পানি চালাতে পারেন৷ অথবা আপনার পোশাক খাত যেসব যন্ত্রপাতি বিদেশ শত শত কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে আনে, সেগুলো দেশেই তৈরি করবেন৷ তখন আপনি তেমন করে আপনার পরিকল্পনা করবেন৷

আমাদের ৭০ শতাংশ জনসংখ্যা তরুণ৷ এদেরকে নিয়ে আগামী ৫০ বছরের ভাবনা কী? বছর বছর ২৬ থেকে ২৭ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে আসছেন৷ তারা যে যেখানে পারছেন, সে চাকরিতে ঢুকে যাচ্ছেন৷ চাকরিদাতারাও সুযোগ নিচ্ছেন পরিস্থিতির৷

অনেকে যারা বিদেশে আসছেন, তারা দেখছেন, এখানকার চাকরির বাজারের তুলনায় তাদের পড়াশোনা মিলছে না৷ তাই এখানে এসে নতুন করে পড়তে হচ্ছে তাদের৷ এইতো সেদিন এক অনুজের সাথে কথা হলো৷ বার্লিনে বিজনেস অ্যানালিটিক্স পড়তে এসেছেন৷ করতেন সাংবাদিকতা৷ এই পড়াশোনাটাই তিনি যদি দেশে করতে পারতেন, তাতে তার সমস্ত জমানো টাকাগুলো বেঁচে যেত৷ তিনি হয়তো এই পয়সা দিয়ে সেখানে বিজনেস অ্যানালিটিক্সের স্টার্টআপই খুলে বসতে পারতেন৷

তাও ভালো, তিনি যে বিষয়ে পড়তে এসেছেন তার চাহিদা আছে এখানে, বা যে কোনো কোথাও৷ কিন্তু অনেকে শুধু বিদেশে পড়বেন বলে যেনতেন বিষয়ে সুযোগ পেলেই চলে আসেন৷ পরে সে বিষয়কেন্দ্রিক ভালো চাকরি পান না৷ বোঝার চেষ্টা করেন না যে, এসব বিষয়ের চাহিদা তেমন নেই, তাই এখানকার মানুষ সেসব বিষয়ে পড়েন না৷ শুধুমাত্র ডিপার্টমেন্ট চালাতে হবে বলে বাইরের শিক্ষার্থীদেরও সুযোগ দেয়া হচ্ছে৷

তখন আবার নতুন করে অন্য কোর্স করে চাকরির চেষ্টা করতে হয়৷ জার্মানিতে যেমন পিএইচডি করেও ফিরে যেতে হয় অনেকের৷ কারণ শিক্ষকতার চাকরি এখানকার বাজারে দুর্মূল্য৷ এসব করতে গিয়ে দুর্লভ এই সময়ের বড় বেশি অপচয় হয়!

তাই একদম সময় এসে গেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর৷ উদাহরণও আছে হাতের কাছে৷ জার্মানিতে প্রাথমিকের পর শিক্ষক প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বিষয়ে একটি সুপারিশ দেন৷ এই সুপারিশই নির্ধারণ করে শিক্ষার্থী মাধ্যমিকের কোন স্কুলে যাবে৷ কারণ, মাধ্যমিকে গিমনাজিউম, রেয়ালশুলে ও হাউপ্টশুলে ছাড়াও গেজাম্টশুলে নামের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের স্কুল রয়েছে৷ 

গিমনাজিউমে মূলত শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য তৈরি করা হয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে গ্রেড ১২ বা ১৩ শেষ করে শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার এনট্রান্স পরীক্ষা (এ লেভেল) অথবা হাইস্কুল ডিপ্লোমা পরীক্ষা দিতে হয়ে৷ এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা বা গবেষণা করবেন, এমনটি আশা করা হয়৷

রেয়ালশুলেতেও (গ্রেড ৫-১০) গিমনাজিউমের বিষয়গুলো পড়ানো হয়৷ তবে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আছে৷ যেমন, বিদেশি ভাষার বিষয়ে ভিন্ন ধরনের চাহিদা থাকে৷ মূলত শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতে প্রযুক্তি বা বিজনেস স্কুলে পড়ার জন্য তৈরি করা হয়৷ যারা ভালো করে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে গিমনাজিউম বা গেজাম্টশুলেতে সুইচ করতে হয়৷

এই স্কুলেও অন্যান্য উচ্চ মাধ্যমিকের বিষয়গুলো পড়ানো হয়, তবে ধীর গতিতে৷ এখানে মূলত কারিগরি শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেয়া হয়, যেন তারা ভবিষ্যতে কারিগরি স্কুল বা এ সংক্রান্ত শিক্ষানবিশী কর্মসূচিতে ভর্তি হতে পারে৷ তবে ভালো ফল করলে এখান থেকেও রেয়ালশুলে ডিপ্লোমা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে৷

গেজাম্টশুলের ধারণাটি তুলনামূলক নতুন৷ তিন টায়ারের স্কুল পদ্ধতির বিপরীতে এর উৎপত্তি মূলত ৬০ ও ৭০-এর দশকে৷ এখানে গিমনাজিউম, রেয়ালশুলে ও হাউপ্টশুলে তিনটি স্কুলের ধারণাকে একীভূত করা হয়েছে৷ এখান থেকে শিক্ষার্থীরা গ্রেড ১৩ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে পারে, অথবা ৯ম বা ১০ম গ্রেড পাশ করে কারিগরি স্কুলে যেতে পারে৷ বর্তমানে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছে এ ধরনের স্কুলের চাহিদা ব্যাপক৷

এ পদ্ধতি নিয়েও অন্য সমালোচনা আছে৷ তবে এখানে যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, অনেক কম বয়সেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে একরকম ধারণা পেয়ে যান৷ এমনকি পরবর্তীতে তাদের আগ্রহ ও যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে পরিবর্তনও করতে পারেন৷ তাতে জীবনের দুর্লভ সময়টুকু বেঁচে যায়৷

আমাদের এখানকার আধুনিক চিন্তা হলো, ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেই হলো, আর কোথাও আটকাবে না৷ উচ্চবিত্তরা তো বটেই শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাও কষ্ট করে হলেও শিশুদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর চিন্তা করছেন৷ এর একটি কারণ, প্রচলিত বাংলা পদ্ধতিতে আস্থা হারানো৷ তারচেয়ে বড় কারণ, সবাইকে ইংরেজি বলতে হবে৷ দ্বিতীয়টি, সমাজের কথিত উঁচুশ্রেণিতে পদার্পণ৷

আরো আছে৷ এই শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির বেশিরভাগেরই চিন্তাভাবনা এখন বিদেশমুখী৷ এর কারণ, রাষ্ট্র তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারছে না৷ এই পরিস্থিতি নিয়ে আরো গভীরে ভাবতে হবে৷ কারণ জনশক্তিকে সঠিক কাজে লাগাতে হলে এবং তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ অবদান পেতে হলে তাদের পেছনে সঠিক বিনিয়োগ করতে হবে৷ শিক্ষাব্যবস্থাকে আস্তে আস্তে চাহিদাভিত্তিক ও শ্রমকেন্দ্রিক করে তুলতে হবে৷ বছরের পর বছর যেভাবে চলে আসছে, সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে নিয়মিত পূণর্মূলায়ণ করতে হবে৷ তাতে পৃথিবী থেকে চলে যাবার সময়, মায়ার টান থাকলেও, সঙ্গে স্বস্তিটাও থাকবে আরেকটু বেশি৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য