1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সংস্কৃতির অবহেলায় ঊর্ধ্বগামী উগ্রতা

জনি হক ঢাকা
১২ নভেম্বর ২০২১

বাংলাদেশে সংস্কৃতিচর্চা কি সর্বস্তরে ক্রমাগত কমছে? শহর থেকে গ্রাম অবধি সাধারণ মানুষের জীবন থেকে বাঙালির সংস্কৃতি কি দূরে সরে যেতে বসেছে? সেই শূন্যস্থানেই কি ঢুকে পড়ছে উগ্রতা?

https://p.dw.com/p/42vaa
Bangladesch Theater | Jatra Theater
ছবি: BTV

একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রতিদিনের অধিবেশন সূচির শুরুতে থাকতো কোরআন থেকে তেলাওয়াত, তরজমা ও তাফসির। একইসঙ্গে গীতা, বাইবেল কিংবা ত্রিপিটক পাঠ রাখা হতো। তারপর কোনো কোনো বিশেষ আয়োজনে দেখা যেতো নবাব সিরাজউদ্দৌলা কিংবা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী  নিয়ে যাত্রা।

বিটিভিতে এখনও প্রতিদিন সকাল ৭টায় কোরআন থেকে তেলাওয়াত, তরজমা ও তাফসির দিয়ে দিনের শুরুটা হয়। জনসংযোগ বিভাগও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে৷ কোরান তেলাওয়াত, তরজমা ও তাফসিরের পর একেক দিন গীতা পাঠ, বাইবেল পাঠ কিংবা ত্রিপিটক পাঠও দেখানো হয়। জাতীয় প্রচারমাধ্যমে এই একটি ক্ষেত্রে অন্তত সব ধর্মের সহাবস্থান খুব দৃশ্যমান। বিটিভির বর্তমান মহাপরিচালক সোহরাব হোসেনের দাবি অবশ্য তার চেয়ে অনেক বেশি, ‘‘আমাদের গোটা অনুষ্ঠানমালায় ধর্মনিরপেক্ষ বার্তা থাকে। এসব আয়োজনে সকল ভাবনার প্রতিফলন ও চিন্তা রয়েছে।''

তবে আবহমান কাল থেকে বাঙালির জীবনের অংশ হয়ে থাকা সংস্কৃতিকে সারাবছর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ধারণ এবং প্রচার করার ক্ষেত্রে কিছুটা অক্ষমতা স্বীকার করছেন তিনি৷ তার দাবি, করোনা মহামারি শুরুর আগ পর্যন্ত বিটিভিতে মাসে একটি করে যাত্রাপালা দেখানো হতো। কিন্তু করোনার কারণে দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বিটিভির স্টুডিওতে যাত্রার চিত্রায়ন বন্ধ। তবে শিগগিরই যাত্রার সম্প্রচার শুরু করার আশ্বাস দিলেন বিটিভির মহাপরিচালক, ‘‘আমি সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলেছি। যাত্রাপালা নিয়ে একটি পরিকল্পনার কথা জানিয়ে শিল্পকলা একাডেমিকে বলেছি - সারা দেশে যেসব যাত্রাদল আছে তার একটা তালিকা দেন, আমরা তাদের নিয়ে যাত্রা আয়োজন করি। যাত্রা সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। সব জেলা থেকে একটি করে যাত্রা নিয়ে প্রচারের ইচ্ছে আছে।''

বিটিভিতে একসময় প্রচারিত ধারাবাহিক প্রামাণ্যচিত্র ‘যাত্রালোক' পরিকল্পনা ও পরিচালনা করতেন অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস। উপস্থাপনায় ছিলেন তার মা, একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেত্রী জ্যোৎস্না বিশ্বাস। সাত বছর আগে বিটিভিতে প্রচারিত ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা' যাত্রাপালায় ঘসেটি বেগম ও আলেয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেন ‘যাত্রা সম্রাজ্ঞী' জ্যোৎস্না বিশ্বাস এবং তার সুযোগ্য কন্যা অরুণা।

অরুণা বিশ্বাস মনে করেন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তোলায় যাত্রা শিল্প অতীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং সে ভূমিকা এখনো রাখতে পারে, কারণ ‘‘যাত্রা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ একটি জায়গা। যাত্রা আমাদের শিখিয়েছে, সত্যিকারের মানুষ ধর্ম নিয়ে কথা বলে না। মানবতা না থাকলে ধর্ম দিয়ে কী হবে? মানুষ নিজের মধ্যে যা ধারণ করে সেটাই মুখ্য। ধর্ম হলো যার যার বিশ্বাস।''

‘যাত্রা পরিবারে' বেড়ে উঠেছেন অরুণা বিশ্বাস। বাবা যাত্রাশিল্পের ‘নটরাজ'খ্যাত অমলেন্দু বিশ্বাস মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত। তাঁর অভিনীত ও নির্দেশিত ‘মাইকেল মধুসূদন', ‘লেনিন' ও ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা' যাত্রাপালায় দেশজ সংস্কৃতির স্বাদ ছিল। গুণী এ শিল্পীর জীবনাবসানের পর চারণ নাট্যগোষ্ঠীর মাধ্যমে ‘সুস্থ' যাত্রাপালার নিভু নিভু দীপ জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা দীর্ঘদিন চালিয়ে গেছেন জ্যোৎস্না বিশ্বাস।

নানান ছলচাতুরি ও অজুহাতে যাত্রা করার অনুমতি দেয় না বেশিরভাগ ডিসি: মিলন কান্তি দে

 কিন্তু এখন গ্রামবাংলায় অশ্লীলতার ‘অভিযোগে' অনেকটা ‘অচ্ছুত' হয়ে গেছে যাত্রাশিল্প। কেন এই অবস্থা? অরুণা বিশ্বাসের মতে, "যাত্রাকে নানান দোষ দিয়ে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা হয়েছে। যাত্রাকে ‘খারাপ কাজ' বলা হয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের মানুষ, মূলত তারাই ন্যক্কারজনকভাবে সেটি করেছে। সার্কাস, পুতুলনাচ, ভাটি গানের মতো দেশজ সংস্কৃতি থমকে দিয়েছে তারা। আজ এখানে-সেখানে ওয়াজ মাহফিল হয়। আমার কথা হলো– ওয়াজ হোক, কোনো অসুবিধা নেই; কিন্তু সেখানে ভালো কথা বলুন। মানুষের মনোবৃত্তি যেন সুন্দর হয় সেজন্য দেশ ও মানুষকে ভালোবাসার কথা বলা হলে ঠিক আছে। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। বেশিরভাগ ওয়াজ মাহফিলে ঘৃণা, ধর্ম ও নারী বিদ্বেষের কথা বলা হয়।”

নাট্যজন মামুনুর রশীদও মনে করেন ধর্মকে সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে একটি মহল, ‘‘আমাদের গ্রাম-গঞ্জে যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, সার্কাস হতো। এসবের জায়গা দখল করেছে ওয়াজ মাহফিল, সেখানে আমাদের সংস্কৃতিবিরোধী বক্তব্য ও নারীবিদ্বেষ প্রচার করা হয় এবং মুক্ত সংস্কৃতিচর্চার বিরুদ্ধে অনর্গল কথা বলতে থাকে লোকজন। আমার মনে পড়ে, কক্সবাজারে একটি সার্কাসের হাতিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ষড়যন্ত্রটা সেখান থেকেই শুরু। তারপর গ্রামীণ দুর্বৃত্ত ও জুয়াড়িরা মিলে অশ্লীল নৃত্য দিয়ে যাত্রার আসরকে জুয়ার আসরে পরিণত করে। বাউলদের চুল কেটে দেওয়া হয়েছে। এই যে পূজামণ্ডপে হামলা, এগুলো সেটিরই ধারাবাহিকতা। মেঘদল ব্যান্ডের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মামলা হয়েছিল। আমার প্রশ্ন, মামলাটি করার স্পর্ধা কোথা থেকে আসে? যে উকিল মামলাটি করেছিলেন, তিনিও আমাদের সংস্কৃতিবিরোধী চক্রেরই লোক।''

এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন, ‘‘যাত্রা করতে গেলে মাঠ লাগে, মাঠগুলো এখন দখল হয়ে গেছে। সেখানে এখন ধর্ম ব্যবসায়ীদের ওয়াজ চলে। সেটাও এক ধরনের বিনোদন। ওই বিনোদনে সবাই নিমজ্জিত। অথচ ধর্ম ব্যবসায়ীরা বলে বেড়ায়– টিপ দেওয়া খারাপ কিংবা শাড়ি পরা ভালো না; এসব হিন্দুরা করে। নাটক করা খারাপ, নাটকে মেয়ে যাওয়া খারাপ, এগুলো করলে আগুনে পুড়বে, দোজখে যাবে– এসব বয়ান এখনও দেওয়া হয়। তারা ভয় ধরিয়ে দেওয়ায় গ্রামে আগের মতো যাত্রা হয় না।''

অশ্লীলতা প্রসঙ্গে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে‘র বক্তব্য, ‘‘অশ্লীলতার বিষয়টা পুরোপুরিভাবে যাত্রা মালিকদের ওপর বর্তায় না, এমনকি শিল্পীদের ওপরও না। যেখানে যাত্রাপালা হয়, সেখানকার প্রভাবশালী মহল ব্যবসার স্বার্থে ‘অশ্লীল' পার্টির আয়োজন করে। কোনো কোনো মালিক এতে যুক্ত থাকে, তবে সবাই নয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশে অধিক রাতব্যাপী যাত্রা হলেই অশ্লীলতা ঢুকে পড়ে, অমার্জিত ব্যাপার ঘটে। এজন্য আমরা অশ্লীলতামুক্ত সান্ধ্যকালীন যাত্রার আবেদন জানাই। আমাদের কয়েক বছরের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত বছর থেকে অশ্লীলতা অনেকটাই কমে গেছে।''

তবে আশার কথা, দেরিতে হলেও যাত্রা নিয়ে মনোযোগী হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। ৬৪টি জেলার নিবন্ধিত ৭৯টি যাত্রাদলকে একটি করে যাত্রাপালা নির্মাণে ৭৫ হাজার টাকা করে প্রণোদনা দিচ্ছে এই সংস্থা। এছাড়া জ্যোৎস্না বিশ্বাস, মিলন কান্তি দে, তাপস সরকারসহ নির্বাচিত ১০ জন নির্দেশক ২ লাখ টাকা করে পাচ্ছেন। তারা প্রত্যেকে একটি করে যাত্রাপালা নির্দেশনা দেবেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাট্যকলা বিষয়ে পড়ানো হয় সেগুলোর নাট্যকলা বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে আটটি অ্যাকাডেমিক যাত্রাপালা নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি নিজস্ব একটি প্রযোজনা তৈরি করছে। যাত্রার আদিরূপকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরাই আয়োজকদের মূল লক্ষ্য। শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের উপ-পরিচালক আলি আহমেদ ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘যাত্রার বিবর্তন ঘটেছে। বাণিজ্যিকীকরণের প্রভাবে এর মূল উপস্থাপন রীতি ও আদল নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমরা অ্যাকাডেমিক যাত্রাপালা প্রযোজনার মধ্য দিয়ে আদিরূপটা তুলে ধরতে চাই।''

সারাদেশের জেলা পর্যায় থেকে যেসব যাত্রাদল নিবন্ধিত হতে চায় শিল্পকলা একাডেমি প্রতিবছর উৎসব করে তাদের দক্ষতা অনুযায়ী নিবন্ধন দিয়ে থাকে। আগে এই নিবন্ধনপত্র দিতো জেলা প্রশাসন। এখন নিয়ম পাল্টেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির হিসাবে ১৫ বছর আগে যাত্রাদল ছিল ৮৫টি, এখন সংখ্যাটা তাত্ত্বিকগতভাবে বাড়লেও মাঠপর্যায়ে তাদের পরিক্রমা কমেছে। প্রশাসনিক জটিলতার কারণেই মূলত যাত্রা অনুষ্ঠান হচ্ছে না।

মিলন কান্তি দে উল্লেখ করেন, মাঠে অনুষ্ঠান করতে ডিসির (জেলা প্রশাসন) অনুমতি লাগে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিসি যাত্রার অনুমতি প্রদানে অনীহা প্রকাশ করেন।মিলন কান্তি দে বলেন, ‘‘অনেকের মনমানসিকতা যাত্রামুখী নয়। নানান ছলচাতুরি ও অজুহাতে যাত্রা অনুষ্ঠানের আবেদন স্থগিত রাখা হয়। দুই-একজন ডিসি আছেন যারা অনুমতি দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাতে তো আর সুফল পাওয়া যায় না। আমাদের দরকার ৬৪ জেলায় যাত্রা অনুষ্ঠানের অনুমতি, কিন্তু সেটি আমরা পাচ্ছি না। ডিসিরা কিন্তু যাত্রাশিল্প উন্নয়নে একসময় অবদান রেখেছেন। এটা আমরা স্বীকার করি। যদিও সেটি যাত্রার সোনালি যুগের কথা। স্বাধীনতার পর মাইকেল মধুসূদনের জীবনী নিয়ে যাত্রা করে বিখ্যাত হন অমলেন্দু বিশ্বাস। সেই পালা আয়োজন করেছিলেন যশোরের ডিসি আব্দুস সামাদ। তার অবদান কখনো ভোলার নয়। তারপর কুমিল্লার একজন ডিসির সঙ্গে ১৯৭৯ সালে আমাদের পরিচয় হয়। তিনি যাত্রাশিল্পীদের অনুদান দিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকার ডিসির সহযোগিতায় গুলিস্তানে একমাস যাত্রার আয়োজন করেছিলাম। একটা সময় জেলা প্রশাসন আগ্রহী হয়ে যাত্রাপালার অনুমতি দিতো। কিন্তু এখন সেরকম ডিসি পাওয়া খুব দুরূহ ব্যাপার।''

ডিসি এবং ভণ্ডদের দাপট...

এখনকার ডিসিদের অনাগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি নাসিরউদ্দীন ইউসুফ সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ডয়েচে ভেলেকে, ‘‘নাটারের বাগাতিপাড়ায় যাত্রাপালা চর্চা করে আমাদের গ্রাম থিয়েটার। সেখানে যাত্রা আয়োজনের অনুমতি চাইতে গেলে থানা থেকে বলে দিলো করা যাবে না। পরে ডিসি আর এসপিও বললেন করা যাবে না। শেষবার যখন যাত্রাপালা করেছিলাম সেসময় ১০-১৫ হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিল। আমাদের বাধা দেওয়ার কারণে এবার যাত্রা করতে পারিনি। এখন আমরা প্রশাসন ও সমাজের সমর্থন পাই না।''

মামুনুর রশীদও প্রশাসনকে একহাত নিলেন, ‘‘শিল্পকলা একাডেমিগুলো ডিসিসহ ভণ্ডরা মিলে দখল করে রেখেছে। তারা কোনো কাজ না করে বরাদ্দ অর্থ মেরে দেওয়ার চেষ্টায় থাকে। ভয়ঙ্কর একটা সময় আমরা অতিক্রম করছি। এখনই যদি সবাই সচেতন না হই এবং নিজস্ব উদ্যোগেসংস্কৃতি চর্চা শুরু না করি তাহলে এগুলো আরো বাড়তে থাকবে।''

দেশ অপেরার প্রধান মিলন কান্তি দে জানালেন, চলতি মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পেশাগত নিশ্চয়তার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেবে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ। তাতে কী থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘কিছুদিন আগে আমরা সংগঠনের নেতারা একটি বৈঠক করেছি। আমাদের প্রথম দাবি– যাত্রা অনুষ্ঠানের অবাধ অনুমতি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া কলকাতা থেকে যাত্রাদল ডাকার প্রবণতা দূর করার পাশাপাশি যাত্রাশিল্পীদের জন্য পৃথক বার্ষিক ভাতা বরাদ্দ করতে হবে। দেশে হাজার হাজার যাত্রাশিল্পী থাকলেও বছরে মাত্র তিন-চার জন ভাতা পায়, এটা মোটেও উচিত না। করোনাকালে প্রায় দুই বছর যাত্রাশিল্পীরা মানবেতর জীবনযাপন করেছে। নিম্ন আয়ের শিল্পীদের তো দুর্বিষহ কষ্ট ছিল। কতদিন না খেয়েই থাকতে হয়েছে তাদের। আমরা সংগঠন থেকে চাল-ডালসহ নিত্যপণ্য ও নগদ টাকা দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। যাত্রাশিল্পীদের দুরবস্থা বর্ণনার অযোগ্য।''

ওয়াজ মাহফিলে মুক্ত সংস্কৃতিচর্চার বিরুদ্ধে অনর্গল কথা বলা হয়: মামুনুর রশিদ

শিল্পী যখন দিনমজুর

বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে অনেক ধরনের লোকসংগীতের প্রচলন ছিল। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা, কবিগান, কীর্তন, ঘাটু, গাজন, বারোমাসি, ধামালি, পটুয়া প্রভৃতি ছিল বাঙালির অঙ্গে মাখা। অঞ্চলভেদে ভিন্নতা দেখা গেলেও এগুলোতে মিশে আছে প্রকৃতি, মানবপ্রেম, সরলতা ও সুখ-দুঃখের কথা। কিন্তু এখন আর সেভাবে এসব লোকসংগীত শোনা যায় না। সংগীত এখন অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর। এ কারণে লোকজ সংগীতশিল্পীদের দিনমজুরের কাজ করেও জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে।

এমনই এক শিল্পী রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের রত্না সেন। ছোটবেলা থেকে তিনি সংগীতপিয়াসী। কোথাও লোকজ গান শুনলে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারতেন না। গানই ছিল তার ভালো লাগা। নিজে নিজেই চর্চা করেছেন তিনি। সাত-আট বছর বয়স থেকে ভাওয়াইয়া গেয়েছেন। একসময় বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন বিষয়ক নাটিকায় অভিনয়ও করেছেন।

২০১৩ সালে পাকস্থলীতে টিউমারের অস্ত্রোপচারের কারণে রত্না সেনের সংগীতচর্চায় ভাটা পড়ে। এরপরও গেয়েছেন। কিন্তু করোনার কারণে আর সংগীত পরিবেশনায় পাওয়া যায়নি তাকে। ঘরে নিজের ঘুমানোর জায়গার পাশেই একটি হারমোনিয়াম রেখেছেন। আগে নিয়মিত বাদ্যযন্ত্রটি নিয়ে বসতেন। কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকে আর সেটি ব্যবহার করা হয়নি। কৈশোরে বিয়ে হয়েছিল৷ সেই বিয়ে টেকেনি। এরপর আর ঘর বাঁধেননি। তিনি ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘গান গেয়ে মনের খোরাক মেটে আমার। যেসব জায়গায় অনুষ্ঠান করেছি, সবখানে বাহবা ও পুরস্কার পেয়েছি, সুনামও অর্জন করেছি। কিন্তু সেই তুলনায় আয় হয়নি। মাসে একটি-দুটি অনুষ্ঠানে গান গেয়ে আমার সংসার চলতো না। খেয়েপরে বাঁচার জন্য সবসময় দিনমজুরের কাজ করেছি। এখনও মাঠে-ঘাটে দিনমজুরের কাজই করে যাচ্ছি। দিনমজুর হলেও সংগীত ছাড়তে পারিনি।''

নারায়ণগঞ্জের বাউল আবদুল হাই দেওয়ান জানালেন, করোনা মহামারির কারণে দুই-আড়াই বছর ধরে খুব খারাপ সময় কেটেছে তাদের। তার কথায়, ‘‘গান গেয়ে আমাদের সংসার চলে। কিন্তু করোনার মন্দাবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। গ্রামে-গঞ্জে গাইতে গেলে অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না। অনুমতি পেলেও কিছু কিছু লোকের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় আমরা প্রতারণার শিকার হই। এ কারণে গাইতে গিয়ে বাউলদের সমস্যায় পড়তে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের প্রতি একটু সহৃদয় হলে আনাচে-কানাচে গান গেয়ে বাংলার ঐতিহ্য বাউল গান ধরে রাখতাম। তাহলে বাউলরা গান গেয়ে মোটামুটি চলতে পারতো। আমাদের রোজগার বলতে তিন-চার মাস গান গাওয়ার সুযোগ মেলে, সেই আয় দিয়েই সারাবছর টেনেটুনে চলতে হয়। আমাদের তো কোনো ব্যবসা নেই। গানের ওপর নির্ভর করেই চলতে হয়।''

লোকজ গানের শিল্পী কুদ্দুস বয়াতি উল্লেখ করেন, ‘করোনার মধ্যে শিল্পীরা এমনিতেই অসুবিধার মধ্যে রয়েছে, বিশেষ করে লোকসংগীত শিল্পীরা। আগের মতো কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না, সরকারও তেমনভাবে কোনো অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয় না। বাউল শিল্পীরা মাজার-টাজারে মোটামুটি গান করে। তবে তারা শান্তিতে নেই।''

মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের মানুষ যাত্রাকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা করেছে: অরুণা বিশ্বাস

শিল্পীদের পারফর্ম করতে দেয়া হচ্ছে না

লোকসংস্কৃতি গবেষক সাইমন জাকারিয়া ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘যাত্রাশিল্পীরা মর্মান্তিক সময় পার করছে, কারণ, তাদের পারফর্ম করতে দেওয়া হচ্ছে না। সংগীতশিল্পীরা গান গাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সার্কাস সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করার জন্য প্রশাসন ও সরকার দায়ী। তাদের কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয় না। পুতুলনাচের শিল্পীরা ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছেন। তাদের খোঁজ আমরা রাখি না। আমরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চর্চাকারীদের কোনো তালিকা করিনি। তাদের সুরক্ষার কোনো উদ্যোগ নেইনি। গ্রামীণ পর্যায়ে সাংস্কৃতিক মনস্তত্ব বিকাশ ও চর্চার জন্য যে উদ্যোগ সরকারি ও বেসরকারি এবং সামাজিকভাবে দরকার, সেগুলো আমরা কেউই করিনি।''

মুস্তাফা জামান আব্বাসী মনে করেন নানা কারণে লোকজ ঐতিহ্য ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব সমাজে আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। তিনি ‘ভাওয়াইয়া সম্রাট' আব্বাস উদ্দিন আহমেদের পুত্র। নব্বই দশকে বিটিভিতে লোকসংস্কৃতির পরিচয়বাহী অনুষ্ঠান ‘ভরা নদীর বাঁকে' গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা করতেন। তার মতে, ‘‘লোকসংগীতের এখন বেহাল অবস্থা। যারা গান গাইতেন তাদের জীবিকা নেই, চারদিকে কোনো অনুষ্ঠান নেই। কাজেই পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। কিছু অনুষ্ঠান টিভি চ্যানেলে হলেও সেগুলোর মান অনেক কমে গেছে। কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। আমার মনে হয়, লোকসংগীতের সঠিক চর্চা হয় না। যারা গাইতে পারে না তারা কোনোরকমে গেয়ে দেয়। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা লোকজ গানগুলো ভালোভাবে শুনছে না, শিখছে না।''

তবে রাধারমণ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়ও ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘লালনের গানের পাশাপাশি এখন রাধারমণের গানের প্রাণচাঞ্চল্য অনেক বেড়েছে। তবে বারোয়ারি গানের চর্চা বেশি অর্থাৎ যিনি রাধারমণের গান করেন তিনি লালন, হাছন রাজা আর ভাওয়াইয়া গানও করেন। শুধুই রাধারমনের গান করার শিল্পী নেই বললেই চলে। অন্তত ঢাকা শহরে নেই।''

অনেক চ্যানেল, অনেক অনাদর

বহু বছর ধরেই এক চ্যানেলের দেশ নেই বাংলাদেশ। এত বেসরকারি চ্যানেল; কিন্তু মানুষে মানুষে ঐক্য ও ধর্মীয় সম্প্রীতি ধরে রাখা বা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে এমন কিছু দেখানোর পরিকল্পনা কি গুরুত্ব পায় চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান পরিকল্পনায়? পেয়েছে কখনো? কোথাও কি যাত্রা, পালাগান, গম্ভীরা, কবিগান, বাউল গান, পল্লিগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি বা পুঁথিপাঠের কোনো ঠাঁই আছে?

একসময় গ্রামবাংলার মানুষের বিনোদনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল পুতুলনাচ, সার্কাস, বায়োস্কোপ ইত্যাদি। সেগুলোও এখন প্রায় বিলুপ্ত। কেন এমন হলো? এসব রক্ষার জন্য কবে কী করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়? কী করেছে বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি টেলিভিশন, রেডিওসহ আমাদের পুরো গণমাধ্যম? নাসিরউদ্দীন ইউসুফের মন্তব্য, ‘‘টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একটা কৃত্রিম সংস্কৃতিকে প্রচার করছে। শেকড়ের সংস্কৃতিগুলোর মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের সামনে জাতিগত ঐতিহ্য তুলে ধরতে পারে তারা।''

নাট্যকার বৃন্দাবন দাসের দৃষ্টিতে, জাতির মধ্যে সহনশীলতা বাড়াতে পারে, চিন্তার উদ্রেক করতে পারে তেমন নাটক নেই এখন। তার মন্তব্য, ‘‘এখন এমন নাটক হচ্ছে যেগুলোতে নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই নেই। সংস্কৃতি চর্চার বিপরীতে স্থুল সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে বলেই বিভিন্ন অপকর্ম হচ্ছে। নাটক, সিনেমা আর ইউটিউব যা-ই বলেন, সবই সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। কে কত কম পয়সা খরচ করে নাটক বানিয়ে নেবে সেই চেষ্টায় মত্ত, সেটা নাটক হচ্ছে নাকি হচ্ছে না সেসব নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। তবে এর মাঝেও বিপরীত স্রোতের কেউ কেউ আছেন যারা ভালো কাজ করার চেষ্টা করছে, যারা সমাজের জন্য ভালো কিছু করতে চায়।''

সারাদেশে যে বিপর্যয় ঘটেছে তাতে বড় আকারের সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন: নাসিরউদ্দীন ইউসুফ

সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রত্যাশা

শেকড়ের সংস্কৃতিতে উদার অনেক কিছু মিশে আছে। মানুষে মানুষে মিলনের কথাই বলে সংস্কৃতি। দেশজ সংস্কৃতির মধ্যে ঐক্যের বার্তা রয়েছে। গান, কবিতা, পুঁথি পাঠে আছে। জাতি ও মেধার বিকাশ শিল্প-সংস্কৃতির মাধ্যমে বেশি হয়। কিন্তু এখন সংস্কৃতি যেন হাঁটছে উল্টো পথে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে কথা উঠছে, বাংলাদেশে কি এখন নতুনভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার, যাতে দেশে যে উগ্রবাদ প্রসারিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে উদারতার বাণী সব মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ায় সংস্কৃতিকর্মীরা ভূমিকা রাখতে পারেন? নাসিরউদ্দীন ইউসুফ  মনে করেন, ‘‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আমাদের একটি সাংস্কৃতিক জায়গা দরকার। কারণ, এই জায়গাটি ছোট হয়ে এসেছে। জায়গাটা আর আগের মতো নেই। সারাদেশে যে সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে তাকে সব ধর্মের মানুষকে একটি সহাবস্থানে ফিরিয়ে আনতে বড় আকারের সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন, যেখানে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষ মিলে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া টিকে থাকা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে যদি সংস্কৃতি চর্চা না থাকে; নাটক, গান, পালা গান, নাচ, যাত্রাপালা যদি আমরা বন্ধ করে রাখি, তবে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে। আগের জায়গায় ফিরে যেতে আমাদের সংগঠিত হতে হবে। তাহলে হয়ত ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।''

মামুনুর রশীদের কথায়, ‘‘আমরা যদি নিজেদের সংস্কৃতি লালন করতে না পারি তাহলে সব শেষ। বর্তমান সরকারকে বলা হয় সংস্কৃতিবান্ধব, আমরা সংস্কৃতির জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ চাই।''

বৃন্দাবন দাস উল্লেখ করেন, ‘‘ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির কোনো বিরোধ নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে বা রাজনৈতিকভাবে সংস্কৃতি চর্চার পথ বন্ধ হয়ে গেলে একটা বিপরীত স্রোত বা অপসংস্কৃতি গ্রাস করবে সমাজকে, এটাই স্বাভাবিক। তৃণমূল পর্যায়ে সংস্কৃতির কোনো চর্চা নেই, কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। যদিও কোনোদিনই ছিল না, রাষ্ট্রীয়ভাবেও কোনোদিনই ছিল না। যদি থাকতো তাহলে আজকের এই দুরবস্থা দেখতে হতো না। গ্রামাঞ্চলে শীত মৌসুমে রাতভর যে যাত্রা হতো, অশ্লীলতার নামে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যাদের বয়স ২০-৩০ বছর তারা যাত্রা কী জিনিস জানেই না। তাহলে এখন জেনারেশন কীভাবে গড়ে উঠবে? এগুলো নিয়ে রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক কোনো ভাবনা নেই। যার ফল আমরা ভোগ করছি। উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। এটি খুবই স্বাভাবিক। আপনি যে গাছ লাগাবেন সেই ফলই পাবেন।''

অরুণা বিশ্বাস মনে করিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী, ‘খাদ্যের অভাবে কেউ মরে না, কিন্তু আনন্দের অভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটে। এখন অনেক বাঙালিই আনন্দের অভাবে মারা যায়। কারণ আমরা সংস্কৃতিশূন্য হয়ে পড়ছি। আমাদের দেশে টিভি নাটক ছাড়া সংস্কৃতি বলতে কিছু নেই। না আছে ফিল্ম, না আছে থিয়েটার। থিয়েটারের মানুষজনও এখন সংগ্রাম করছেন। তাদের আর্থিক নিশ্চয়তা নেই। তারপরও মনের খোরাক মেটাতে তারা কষ্ট করে হলেও নাট্যচর্চা ধরে রেখেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া যেমন জীবন চলে না, সংস্কৃতির মুক্তি ছাড়াও জীবন চলে না।''