1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সমাজ চলছে মিডিয়ার বিচারে

গৌতম হোড়
২৪ জুলাই ২০২০

প্রায় প্রতিদিন হয়ে যাচ্ছে মিডিয়া ট্রায়াল৷ অভিযুক্তকে অপরাধী বানিয়ে, প্রশ্নকর্তাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে বিচার হয়ে যাচ্ছে মিডিয়ায়৷ হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে ব্যক্তিগত অধিকারে৷

https://p.dw.com/p/3frEj
Screenshot der Internetsite Tehelka.com
ছবি: Tehelka.com

যখন সাংবাদিকতায় ঢুকেছিলাম, তখন বিচারব্যবস্থার একটা প্রতিষ্ঠিত নিয়মের কথা বারবার আমাদের শেখানো হয়েছিল৷ যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি অভিযুক্ত৷ যত গুরুতর অপরাধের অভিযোগ থাকুক না কেন, তিনি অপরাধী নন৷ কিন্তু এই অভিযুক্ত ও অপরাধীদের মধ্যে যে অদৃশ্য রেখা আছে, সেটা এখন ক্রমশ মুছে যাচ্ছে৷ কতদিনে বিচার হবে, কবে তার রায় বেরবে, সেই রায় কী হবে, সে সবের অপেক্ষা করার দরকার কী? হাতে যখন কলম বা মাইক আছে, তখন ইনস্ট্যান্ট বিচার হয়ে যাক৷ না হলে টিভিতে জনপ্রিয়তার রেটিং বাড়বে কী করে, কাগজের কাটতিই বা হবে কী করে? তাই ইনস্ট্যান্ট কফি বা টু মিনিটস নুডলস-এর মতো ঝটিতি বিচার৷ সেখানে বিচার কখনো মিডিয়া করে, কখনো রাজনৈতিক দল, কখনো বা সামাজিক মাধ্যম অথবা প্রচুর মানুষের কোলাহল৷ শুরু হয়ে যায়, ফাঁসি দাও৷ অসম্মান করো৷ মানহানি করে দাও৷লঙ্ক লেপন করে দাও আদালতের আগেই রায় হয়ে গেল৷ আপাতত শান্তি৷ এবার পরের বিষয়ের দিকে ছোটা৷ 

ভারতে এখন খুব সহজেই কাউকে দেশবিরোধী, জাতীয়তাবিরোধীর তকমা দিয়ে দেওয়া হয়৷ দেয় কিছু মিডিয়া, দেয় কিছু রাজনৈতিক দল৷ সামাজিক মাধ্যমে ঘোর প্রচার শুরু হয়ে যায়৷ কেন দেশদ্রোহী? কারণ, তিনি হয়তো সরকারি লাইন অনুসরণ করছেন না৷ কারণ, তিনি প্রশ্ন করছেন৷ অস্বস্তিকর বিষয় তুলছেন৷ সঙ্গে সঙ্গে হাতে গরম বিচার, ওই ব্যক্তি, নেতা দেশদ্রোহী৷ মুম্বই ও দিল্লির টিভি স্টুডিওতে কতবার যে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের, ভারতের সঙ্গে চীনের যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া হলো এবং তাতে কে জিতবে তার রায় দিয়ে দেওয়া হলো, সেই সংখ্যা কি কেউ গুণে দেখেছেন? দেখলে জানা যাবে, সেই সংখ্যাটা যথেষ্ট ভারি৷

মিডিয়া ট্রায়াল বা লোকের বিচার কেমন হয়? অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে বিজেপি-র সভাপতি হলেন বঙ্গারু লক্ষ্মণ৷ দলিত নেতা৷ কিছুদিন পর গোপন ক্যামেরায় তোলা তাঁর ছবি দেখল সারা দেশ৷ সংবাদমাধ্যমের করা স্টিং অপারেশন৷ সাংবাদিক ব্যবসায়ীর পরিচয় দিয়ে বিজেপি সভাপতির কাছে গেছেন৷ বঙ্গারু লক্ষ্মণ তাঁর কাছ থেকে একগোছা নোট নিয়ে পাশের ড্রয়ারে রেখে দিলেন৷ সেই ছবি দেখে আঁতকে উঠল সারা দেশ৷ লোকের মনে একটা ধারণা আছে, রাজনীতিকদের অনেকেই ঘুষ খান৷ কিন্তু সেই ছবি তো সরাসরি দেখা যায় না৷ বঙ্গারু ও পরবর্তীকালে নারদ-কেলেঙ্কারিতে লোকে দেখেছেন, রাজনীতিকরা টাকা নিচ্ছেন৷ দুটোই স্টিং অপারেশন৷ এই ধরনের আরও স্টিং অপারেশন হয়েছে৷ এখানেও তো সেই নীতি অনুসারে চলতে হবে৷ বঙ্গারু থেকে শুরু করে বাকি সকলেই অভিযুক্ত৷ কারণ, তাঁদের অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হয়নি৷ বঙ্গারু প্রয়াত৷ নারদ নিয়ে সিবিআই এর তদন্ত চলছে তো চলছেই৷ এখনও ফল সামনে আসেনি৷ কিন্তু মিডিয়া ট্রায়ালে তাঁরা অপরাধী হয়ে গেছেন৷

কেন চোখের সামনে গোপন ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখার পরেও বলা যাবে না, তাঁরা অপরাধী? প্রথম কথা, সেই ছবির মধ্যে জালিয়াতি থাকতে পারে৷ ক্যামেরার কারসাজি থাকতে পারে৷ এডিট করে কিছু দৃশ্য বাদ দিয়ে কিছু জোড়া হতে পারে৷  তর্কের খাতিরে সেই সব সম্ভাবনাই থাকছে৷ তাছাড়া টাকাটা তাঁরা দলের তহবিলে দেওয়ার জন্য নিতে পারেন৷ দল রশিদ কেটে সেই অর্থ গ্রহণ করতে পারে৷ সেটা যদি করা হয়, তা হলে তার মধ্যে কোনো বেআইনি বিষয় নেই৷ কীভাবে প্রমাণ হবে, তাঁরা নিজের জন্য নিয়েছেন না কি দলের জন্য? তদন্তের পর পুলিশ চার্জশিট পেশ করবে, মামলা হবে আদালত শাস্তি দিলে বলা যাবে, তাঁরা অপরাধী৷

কিন্তু তার অনেক আগেই মিডিয়া ট্রায়ালে তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হয়ে যান৷ অবশ্য নারদ কেলেঙ্কারির পর একটা লোকসভা নির্বাচন হয়ে গিয়েছে৷ তারপর আরো এক বছরের বেশি সময় কেটে গিয়েছে, কিন্তু তদন্ত শেষ হয়নি৷ এরপর মামলা হবে৷ সেই রায় কবে আসবে তা কেউ জানে না এই দীর্ঘসূত্রিতার জন্য মিডিয়া ট্রায়াল বা জনগণের ট্রায়ালের ৷প্রবণতা বাড়তে থাকে৷ 

মিডিয়া ট্রায়াল যে কোনদিকে যেতে পারে তার উদাহরণও আমরা দেখেছ৷ পিটার মুখার্জি, ইন্দ্রাণী মুখার্জি এবং শিনা বোরা হত্যা কেলেঙ্কারি৷ ভারতে টেলিভিশনের যে কোনও সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করুন, কোন খবর সব চেয়ে বেশি চলে? উত্তর আসবে, থ্রি সি৷ ক্রিকেট, ক্রাইম ও সিনেমা, মানে বলিউড৷ আর এই তিন জগতের কেলেঙ্কারি হলে তো কথাই নেই৷ সমানে দেখিয়ে যাও৷ দর্শক গিলবে৷ টিভির জনপ্রিয়তার সূচক টিআরপি রেটিং ধাঁই ধাঁই করে বাড়বে৷ সেটা করতে গিয়ে কতরকম স্টোরি যে এলো৷ পিটার ও ইন্দ্রাণী কোথায় একসঙ্গে গিয়েছিলেন, কী পোশাক পরেছিলেন৷ ইন্দ্রানীর সঙ্গে অন্য কারো সম্পর্ক ছিল কি না? অর্থাৎ, তাঁর কোনো গোপনীয়তার অধিকার থাকতে পারে না৷ শিনা বোরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই তথ্যগুলি কতটা জরুরি, সে সব প্রশ্ন তখন অবান্তর৷ তখন ইন্দ্রাণী ও পিটার ভিলেন৷ তাঁদের জীবনের গোপন তথ্য সব ফাঁস করছে সংবাদমাধ্যম৷ এই যে কাউকে ভিলেনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করে মিডিয়া ট্রায়াল শুরু হয়ে যায় তা প্রকৃত অর্থেই ভয়ঙ্কর৷ এই একই ঘটনা ঘটেছে, সারদার মালিক সুদীপ্ত সেন ও তাঁর সহযোগী দেবযানী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে৷

এরকম কত উদাহরণই তো আছে৷ আদালতেরবাইরে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর বিচারের কাহিনি তো প্রসিদ্ধ৷ রাজীব গান্ধী সরকারের অর্থমন্ত্রী বফর্সের প্রশ্নে পদত্যাগ করলেন৷ তার আগেই মিডিয়ায় চলে এসেছিল বফর্সে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ৷ তারই মধ্যে এলো ভোটের সময়৷ বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং পকেটে ছোট ডায়েরি রাখতেন৷ সেটি বার করে সকলকে দেখিয়ে বলতেন, সব নাম এর মধ্যে আছে৷ যাঁরা বফর্সে ঘুষ খেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ হতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দেব৷ বিরোধীদের স্লোগান তৈরি হয়ে গেল-- গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়৷ তদন্তের আগে, আদালতের রায়ের আগে বিচার হয়ে গেল৷ রায় বেরিয়ে গেল৷ বিশ্বনাথ প্রতাপ ভারতের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হলেন৷ ১১ মাস ক্ষমতায় থাকলেন৷ বফর্সের দোষীদের নাম জানাতে পারলেন না৷ কাউকে শাস্তি দিতে পারলেন না৷ তারপর কত সরকার এল, গেল অভিযোগ প্রমাণ হলো না৷ 

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

তবে মিডিয়া ট্রায়াল যে সবসময় অর্থহীন তাই বা বলি কেমন করে৷ জেসিকা লালের হত্যার পর যা হয়েছিল, সেটা তো যাকে বলে আই ওপেনার৷ দিল্লির মডেল জেসিকা লালকে একটা পার্টিতে গুলি করে হত্যা করেছিল মণু শর্মা৷ তাঁর তিন বন্ধুর সঙ্গে সে পার্টিতে যায়৷ মণু শর্মার বাবা বিনোদ শর্মা হরিয়ানার প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী৷ মণুর বন্ধু ও সেই পার্টিতে যাওয়া বিকাশ যাদবের বাবাও রাজনীতিক ডি পি যাদব৷ যেখানে পার্টি হচ্ছিল, তার মালিকও ফ্যাশন ডিজাইনার এবং প্রভাবশালী মহলে প্রচুর যোগাযোগ ছিল৷ নিম্ন আদালত রায় দিল, বিনোদ শর্মা নির্দোষ৷ কিন্তু তারপর মিডিয়া ট্রায়াল চলল৷ একের পর এক খবর বের হতে থাকল৷ মতামতও৷ শেষ পর্যন্ত মিডিয়া ট্রায়াল ও জনমতের চাপে আবার মামলা হলো৷ দিল্লি হাইকোর্ট রায় বদল করে জানাল, মণু শর্মা দোষী৷ পরে সুপ্রিম কোর্টও শাস্তি বজায় রাখে৷

জেসিকা লালের মামলা দেখলে বোঝা যায়, মিডিয়া ট্রায়ালের জন্যই ন্যায় পাওয়া গিয়েছিল৷ না হলে, প্রভাবশালীদের ম্যাজিক কাজ করে গিয়েছিল প্রায়৷ তবে এটা হলো ব্যতিক্রম৷ যত দিন যাচ্ছে, ততই পরিস্থিতি খুব খারাপ জায়গায় চলে যাচ্ছে৷ ব্যক্তিগত অধিকার, গোপনীয়তার অধিকারের কোনো তোয়াক্কা করা হচ্ছে না৷ যা ইচ্ছে তাই বলা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে, দেখানো হচ্ছে৷ সামাজিক মাধ্যমের রমরমার পর এই প্রবণতা আরও বেড়েছে৷ সামাজিক মাধ্যমে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে লোককে৷ বিচার হোক বা না হোক, গায়ে ঠাপ্পা মেরে দেওয়া হচ্ছে৷ এটা ভয়ঙ্কর৷থেকে অন্যের হেনস্তা দেখে যাঁরা মজা পাচ্ছেন, তাঁরা একটা কথা বুঝতে পারছেন না, আগুন ছড়ালে তাঁর বাড়িও রক্ষা পাবে না৷ তাঁর বা তাঁর নিকটজনের বিরুদ্ধে এই ধরনের বিচার হলে, তখন বুঝবেন, ব্যথাটা কোথায় লাগে৷