1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঘাস চাষ বা খিচুড়ি রান্না শেখা ভ্রমণের মনস্তত্ত্ব

গোলাম মোর্তোজা
৪ ডিসেম্বর ২০২০

জনজীবনের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এদেশে হাসি-রসিকতার বিষয়ে পরিণত হয়েছে৷ এটা জনবিরোধী কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টদের একটি সার্থকতা৷ তবে আজকের বিষয়, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বিষয়ে৷

https://p.dw.com/p/3mDUe
পর্তুগাল
ছবি: imago

সরকারি কর্মকর্তাদের বিষয়ে যাওয়ার আগে একজন ‘হঠাৎ প্রতিমন্ত্রী’র একটি ঘটনা বলি৷ কারাগারের মান-উন্নয়ন কি করে করা যায়, সরেজমিন পরিদর্শন করা করা দরকার৷ বেছে নেওয়া হলো কানাডা৷ কিন্তু কানাডার কারাগারের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেল না৷ প্রতিমন্ত্রীকে গাড়িতে কারাগারের চারপাশ ঘুরিয়ে দেখানো হলো৷ এই সংবাদগুলো যখন থেকে আসতে শুরু করলো, মানুষের হাসির খোরাক যোগানো তখন থেকেই শুরু হলো৷

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার সংবাদ যখন সামনে আসতে শুরু করলো, প্রথমে মানুষ ধাক্কা খেলো৷ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো-সত্যি? যখন দেশের মানুষ জানলো, দুটি ক্যামেরা কেনার জন্যে তিনজন সরকারি কর্মকর্তা জার্মানি গেছেন!

বিস্ময়ের সকল সীমা ছাড়িয়ে গেল৷ বিস্ময় তখন হাসি রসিকতায় পরিণত হলো৷

প্রশ্ন হলো, এর কারণ কী বা মনস্তাত্তিক ব্যাখ্যা কী? সঠিক ব্যাখ্যা জানা যেত যদি কোনো সমাজবিদ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতেন৷ তা কেউ করেন নি৷

সাধারণভাব বোঝা যায়, গণতন্ত্র বা জবাবদিহিতাহীন সরকার ব্যবস্থায় স্বেচ্ছাচারিতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে৷ বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় জবাবদিহি ছাড়া ব্যবস্থাপনা এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে৷ নির্বাচনই গণতন্ত্র বা জবাবদিহির একমাত্র উপাদান নয়৷ তবে বাংলাদেশের মত দেশের ক্ষেত্রে নির্বাচন গণতন্ত্র বা জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার প্রধানতম উপাদান৷ ভোট দেওয়ার ক্ষমতা ছাড়া জনগণের হাতে আর কোনো ক্ষমতা থাকে না,যা দিয়ে তারা রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ডের জবাব দিতে পারে৷ প্রশ্ন থাকলেও দেশে এর প্রতিফলন দৃশ্যমান হয়েছিল ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৯ সালে৷ ২০১৪ সাল থেকে যা আর কার্যকর নেই৷ ভোট ছাড়া নির্বাচন বা দিনের ভোট রাতে হয়ে যাওয়ার নির্বাচনি ধারার প্রচলন হয়েছে বাংলাদেশে৷ নির্বাচন বিষয়টিও হাসি-রসিকতায় পরিণত হয়েছে৷

জনগণকে ক্ষমতাহীন করে দেওয়া সরকার পদ্ধতিতে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে প্রশাসন৷ যা বাংলাদেশে এখন যে কোনো বিবেচনাতেই তা দৃশ্যমান৷ প্রশাসন বা সরকারি কর্মকর্তারা ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে এবং তারাই সরকারকে ক্ষমতায় রাখছে, এটা তাদের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে৷ ফলে সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে এমন মানসিকতা গড়ে উঠেছে যে,আমাদের অনেককিছু পাওয়ার আছে৷ নিয়ম-নীতি বহির্ভূত হলেও, তা পেতে হবে৷ এই মানসিকতার একটি প্রকাশ বিদেশ ভ্রমণ৷ একথাও সত্যি যে, বিদেশ ভ্রমণপ্রীতি সরকারি কর্মকর্তাদের ভেতরে সব সময়ই ছিল৷ এখন তা বেড়েছে৷ সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে চক্ষু-লজ্জা৷

গণমাধ্যমের কারণে বিদেশ ভ্রমণের অযৌক্তিক কিছু ঘটনা যখন প্রকাশিত হয়,তখন তারা লজ্জা পান না৷ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন৷ ‘সাংবাদিকেরা কিছু জানে না’-এই তত্ত্ব নিয়ে সামনে এসে কথা বলেন৷

‘ঘাস চাষ শিখতে’ বিদেশ যাওয়ার পক্ষেও তাদের যুক্তি দিতে দেখা যায়৷ ‘পুকুর পুনখনন’ ‘খিচুরি রান্না শেখা’র মতো বিদেশ সফরকেও তারা যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন৷ গণমাধ্যমের চাপে যখন তাদের এমন কিছু ভ্রমণ বাতিল হয়ে যায়, তখন তারা ক্ষিপ্ত হয়ে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষেদাগার করতে থাকেন৷ আমরাই সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছি, আর আমাদেরকে নিয়ে কথা! মানসিকতা থাকে এমনই৷

কিন্তু এতে তাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় খুব একটা ব্যাঘাত ঘটে না৷ একটি পরিকল্পনা বন্ধ হলে, দশটি পরিকল্পনা নিয়ে তারা অগ্রসর হন৷তাদের কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না৷ সরকার পরিচালনারারীরা তাদের বিষয়ে তদন্ত-শাস্তি তো দুরের কথা, কিছু জানতেও চাইতে পারে না৷ ফলে তারা হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য৷

গোলাম মোর্তোজা, সাংবাদিক
গোলাম মোর্তোজা, সাংবাদিকছবি: Golam Mortoza

বাংলাদেশে প্রকল্প নির্ভর দেশ৷ বিদেশী ঋণের প্রকল্পে চলে দেশ৷ যারা ঋণ দেয় ও প্রকল্প প্রণয়নে ভূমিকা রাখে,তারা এটা জানে যে একাধিক বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ না থাকলে, সরকারি কর্মকর্তারা প্রকল্প পাস করবেন না৷ ফলে তারাও যে কোনো প্রকল্প প্রণয়নের সময় মূলত দুটি দিক খেয়াল রাখেন৷ একটি নতুন গাড়ি কেনা এবং অন্যটি বিদেশ ভ্রমণ৷বিদেশ ভ্রমণ বা গাড়ি কেনা দেশের জন্যে কতটা উপকরী বা আদৌ দরকার আছে কিনা, তা বিবেচনায় থাকে না৷

বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গে ভাতা সম্পৃক্ত থাকে, আত্মীয় বা বন্ধুর বাসায় থেকে অনেক ক্ষেত্রে পাঁচ তারকা হোটেলের ভাড়ার সমপরিমাণ ডলার তুলে নেওয়া যায়৷ আর দেখা হয় নতুন নতুন দেশ৷ একারণে অনেক সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে স্ত্রী-সন্তানদেরও ‘নিজ খরচে’ সঙ্গী করেন৷

রাজনৈতিক সরকার যদি শক্তিশালী না হয়, সরকার যদি জনগণের উপর নির্ভর না করে সরকারি কর্মচারীদের উপর নির্ভর করে ক্ষমতায় থাকে, তবে অন্যান্য অনিয়ম-দুর্নীতির মতো বিদেশ ভ্রমণও বন্ধ হবে না৷ কমবেও না৷ সরকারি পর্যায়ে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ি হবে৷ চেষ্টা থাকবে তথ্য যাতে প্রকাশিত না হয়, সাংবাদিকরা যেন না জানে৷ চাপা দেওয়া সমাধানে বিশ্বাসী বাংলাদেশ৷ ধারণা করি,আগামি দিনে সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণও চাপা দিয়ে বা গোপনে করার কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়িত হবে৷