1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্কুলশিক্ষকের উদ্ভাবন পরিবেশবান্ধব বাইক

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

সারা বিশ্বেই বিকল্প জ্বালানির সন্ধান চলছে৷ পশ্চিমবঙ্গের অখ্যাত গ্রামের এক স্কুলশিক্ষক ইতিমধ্যে বানিয়েছেন সৌরশক্তি চালিত মোটরবাইক৷ আশা করা হচ্ছে, এর ফলে কমবে বিশ্ব উষ্ণায়নের দাপটও৷

https://p.dw.com/p/3D04b
ছবি: DW/P. Samanta

বিকল্প জ্বালানি

সৌরশক্তি ইতিমধ্যেই বিকল্প পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে৷ সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে চলছে নানা উদ্ভাবনও৷ বিশ্ব উষ্ণায়নের দাপট ঠেকাতে সৌরশক্তি চালিত বাস, ট্রাম ইতিমধ্যে সাড়া ফেলেছে৷ পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার হাঁসখালি ব্লকের ৩০ বছরের যুবক শুভময় বিশ্বাস নিজের ক্ষুদ্র আয়োজনেই তৈরি করে ফেলেছেন সৌরশক্তি চালিত মোটরবাইক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘প্রথম থেকেই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করব, এই ইচ্ছেটা মনে ছিল৷ তাছাড়া যেভাবে পেট্রোলের দাম উত্তরোত্তর বাড়ছে, তাতে নিজের বাইকের পেট্রোল খরচ কমানোর জন্যও এটা তৈরির তাগিদ ছিল৷ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছোট গাড়ি, বড় গাড়িও চালানো যাবে৷'' পেশায় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক শুভময়ের বাড়ি থেকে স্কুলের যাতায়াতে নিয়মিত ১৫-১৬ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে হয়৷ পেট্রোলের সেই খরচ এড়াতেই শুভময় সৌরচালিত বাইকের কথা ভেবেছেন৷ মাত্র ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করে তিনি এই সৌরশক্তিতে চালিত বাইকের পরিকল্পনা করেছেন৷ আপাতত নিজের এই উদ্ভাবনের পেটেন্ট নেওয়ার আবেদনের পথে হাঁটছেন তিনি৷

‘‘এতে রয়েছে ম্যাগনেটিক ইঞ্জিন, সেটি চলবে আয়নিক ব্যাটারির চার্জে’’

মোটরবাইক মানেই তা জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত, বিশ্বজুড়ে এখন এই যানেরই রমরমা৷ পেট্রোলে চলা বাইক পরিবেশ দূষণ করে, এই সংকটের কথা জানা গেলেও ভারত-বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে বাইকের জনপ্রিয়তা বাড়ছে৷ প্রয়োজনের তাড়না ছাপিয়ে বাইক হয়ে উঠেছে শখ পূরণের চাবিকাঠি৷ শখও থাকবে, পরিবেশও বাঁচবে, এমন পথই দেখাচ্ছেন শুভময়৷ বাইক নির্মাণের কৃৎকৌশল ডয়চে ভেলের কাছে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি৷কী ম্যাজিক লুকিয়ে আছে এই বাইকে যে, তা পেট্রোল ছাড়া চলবে, তাও আবার প্রচলিত ইঞ্জিন ছাড়াই? শুভময় বলেন, ‘‘এতে দহনকারী ইঞ্জিন নেই, যা জ্বালানি পুড়িয়ে শক্তি জোগায়৷ এতে রয়েছে ম্যাগনেটিক ইঞ্জিন৷ সেটি চলবে আয়নিক ব্যাটারির চার্জে৷ লেড বা অ্যাসিড লেড ব্যাটারিতে নয়৷ প্রচলিত এই ব্যাটারির তুলনায় সেটির ওজন দশভাগের একভাগ, চার্জ ধরে রাখার ক্ষমতাও অনেক গুণ বেশি৷''

সাশ্রয়কারী ও পরিবেশবান্ধব

ভারতের বাজারে অনেকদিন ধরেই সহজলভ্য ব্যাটারি চালিত বাইক৷ কিন্তু সেই বাইক খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি৷ একদিকে চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার সমস্যা রয়েছে, অন্যদিকে গতিও শ্লথ৷ এই সমস্যার সমাধান করেছেন শুভময়৷ তিনি বলেন, ‘‘সৌর প্যানেল লাগানো থাকছে বাইকের সঙ্গে৷ তা থেকে শক্তি মিলবে৷ তার উপর থাকছে বিশেষ ডায়নামো৷ এই অটোমেটিক ম্যাগনেটিক ইনডাকশন রেজোনেটর ডায়নামো দিয়ে চার্জ হবে বাইক চলতে চলতে৷ ফলে শক্তি সংরক্ষণ হবে এবং বাইক ছুটবে অনেক বেশি দূরত্ব পর্যন্ত৷'' শুভময়ের দাবি, এ ক্ষেত্রে কারো বাড়িতে সৌর প্যানেল বসানো থাকলে খুব সুবিধা হবে৷ একই সঙ্গে বাইক ও বাড়িতে বসানো প্যানেলে চার্জ দেওয়া যাবে৷ ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যে পুরো চার্জ হয়ে যাবে৷ এই বাইকের গতিও একেবারে খারাপ নয়৷

উদ্ভাবকের বক্তব্য, ‘‘একবার পুরো চার্জ দিয়ে বেরোলে যদি কেউ প্রতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে বাইক চালান, তাহলে ৭০-৮০ কিলোমিটার অক্লেশে সফর করতে পারেন৷ আর যদি গতি কমিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ৩০-৪০ কিলোমিটারে নিয়ে আসেন, তাহলে ১০০ কিলোমিটার স্বচ্ছন্দে বাইক চেপে ঘুরে বেড়ান৷ বাড়িতে সৌর প্যানেল লাগালে নাকি পাঁচ বছর কোনো জ্বালানি খরচই নেই৷''

কতটা পরিবেশবান্ধব শুভময়ের বাইক? আবিষ্কারক শুভময় বলেন, ‘‘পেট্রোলের ৬০ শতাংশ পুড়ে যে শক্তি হয়, তা দিয়ে সাধারণ বাইক চলে৷ বাকিটা শব্দ, তাপশক্তি হিসেবে নির্গত হয়৷ পরিবেশ দূষণকারী ক্ষতিকর কণাও তৈরি হয়৷ সৌর বাইকে এই দূষণের অবকাশই নেই৷ তার উপর, ইলেকট্রিক বাইকে যে ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়, তা অ্যাসিড লেড ব্যাটারি৷ এতে পরিবেশের মারাত্মক দূষণ হয়৷'' কিন্তু, শুভময়ের বাইকের আয়নিক ব্যাটারি মাটিতে মিশে যেতে পারে৷ তিনি পুরোনো বাইকের কাঠামো ব্যবহার করে বাইক তৈরি করে ফেলেছেন৷ ওয়েল্ডিং করে পুরোনো গিয়ার কাজে লাগিয়েছেন৷ হেডলাইটে ৯টি এলইডি আলোর সামনে গ্লাস প্রোজেক্টরের ব্যবস্থা করেছেন৷ এর সাহায্যে কম শক্তি খরচ করে দ্বিগুণ আলো মিলছে৷

এই প্রয়াসকে স্বাগত জানিয়েছেন শিবপুর আইআইটি-র অধ্যাপক শান্তিপদ গণচৌধুরী৷ রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতরের প্রাক্তন এই সচিব বলেন, ‘‘খুবই ভালো চেষ্টা৷ তবে এই বাইকের ক্ষেত্রে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে৷ বাইকের একাংশের শক্তি সৌর প্যানেল থেকে আসতে পারে, পুরোটা নয়৷ বাইক চালানোর সময় অভিমুখ পরিবর্তনের ফলে প্যানেলে সূর্যালোক সমানভাবে পড়বে না, সেক্ষেত্রে শক্তি উৎপাদনে তারতম্য হতে পারে৷ এটা শক্তিমূল্য যোগ করতে পারে৷ অর্থাৎ, ইলেকট্রিকে বাইক চার্জ করার পর বাড়তি শক্তির উৎস হিসাবে সৌরশক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷''

সাধ ও সাধ্যকে অতিক্রম

শুভময় এই চর্চার মধ্যে রয়েছেন বহুদিন ধরে৷ এটাই তাঁর একমাত্র উদ্ভাবন নয়৷ ছোট থেকেই, বিশেষ করে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি এমন অনেক কিছু উদ্ভাবন করে চলেছেন৷ শুভময় বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই আমার বিজ্ঞানী হওয়ার শখ৷ ১৯৯৮ সালে স্কুল লেবেলে বিজ্ঞান মেলায় পুরস্কারও পেয়েছি৷'' দূষণমুক্ত চিমনি বা প্লাস্টিক পুড়িয়ে অভিনব পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব ইটও তৈরি করেছেন তিনি৷ কিন্তু শুভময়ের দাবি, তাঁর এসব উদ্ভাবন চুরি হয়ে গিয়েছিল৷ তাই অনেকটা হতাশা থেকেই নিজের ডায়েরির ব্লু প্রিন্ট নিয়ে আর মাথা ঘামাননি তিনি৷ এরপর অনেকদিন পর তিনি আবার উদ্ভাবন করলেন এই পরিবেশবান্ধব মোটরবাইক৷

রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন থেকে সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর শুভময়ের ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়রিংয়ের শাখায় নানা গবেষণা করবেন৷ কিন্তু বাদ সাধল মায়ের ক্যানসার৷ ২০০৩ সালে মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ায় শুভময় বাধ্য হন প্রাইমারি স্কুলে চাকরি নিতে৷ এরপর বন্ধ হয়ে যায় শুভময়ের পড়াশোনা আর গবেষণার নেশা৷ এরপর বছর পাঁচেক আগে শুভময় স্কুলে যোগদান করেন৷ মায়ের ক্যানসার এখন অনেকটাই আয়ত্তের মধ্যে৷ এখন প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি করার সঙ্গে সন্ধেয় কচিকাঁচাদের অবৈতনিকভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা দেন৷ মাঝেমধ্যে নিজের বাইক নিয়ে কোনো রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পরিবেশের পক্ষে প্রচার চালান৷ অনেক কৌতূহলী মানুষ বাইকের বরাত দেন৷ কিন্তু, এত বাইক তৈরি করার পুঁজি নেই শুভময়ের৷ এ ব্যাপারে তিনি সহযোগিতা চান৷ সঙ্গে চান সবুজ বাইককে আরো উন্নত করে তোলার জন্য উচ্চতর গবেষণার সুযোগ৷