1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

হারিয়ে গেছে পুজোর গান

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

কলের গানের কলকাতা সেই কবেই অতীত হয়ে গেছে, তারপর এসেছে ক্যাসেট ও সিডি-ডিভিডির যুগ৷ এই কয়েক বছর আগেও পুজোর নতুন বাংলা গান বাজারে আসতো৷ অথচ এখন যেন হারিয়েই গেছে বাঙালির পুজোর গান৷

https://p.dw.com/p/2jTV3
Indien Indian Festival Durga Puja 2016
ছবি: DW/ P. Tiwari

রেল লাইনের ধারে কাশ ফুলের দোলা, বাগানে শিউলির কুঁড়ি জানান দিচ্ছে পুজো আর বেশি দূরে নেই৷ শরতের আলোর বাঁশি বেজে উঠলেই নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে বাজারে এসে যেত একেবারে আনকোরা নতুন পুজোর গান৷ হেমন্ত-মান্না-শ্যামল-মানবেন্দ্র-নির্মলেন্দু চৌধুরীদের স্বর্ণযুগের মতো আদৃত না হোক, শ্রীকান্ত-লোপামুদ্রা-রাঘব-শুভমিতাদের কয়েক বছর আগে প্রকাশিত গান এখনও মানুষ কান পেতে শোনে৷ তবে পুজোর গানের সেই স্বর্ণালি দিন আর নেই৷

পরিস্থিতিটা প্রযুক্তির ব্যাপক পরিবর্তনে অনেকটাই পাল্টে গেছে৷ বাড়িতে বাড়িতে কলের গানের মতোই এখন শো-পিস হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে ক্যাসেট প্লেয়ার৷ সিডি-ডিভিডি প্লেয়ারটা মাঝেমধ্যে গেয়ে উঠলেও তার পরমায়ু ফুরিয়ে এলো বলে৷ তাই এখন পুজো এলে নতুন গান দূরের কথা, শারদীয় সিডি-ডিভিডি প্রকাশের সংখ্যাও কমে গেছে৷ তাই এ সময়ের শিল্পীরা বাংলা ছবিতে গাইলেও বেসিক রেকর্ড, যাকে আমরা বাংলা আধুনিক গান বলে জানি, সেই ধারাটি ক্রমশ শুকিয়ে আসছে৷ কেন এই হাল হচ্ছে আধুনিক গানের? রবীন্দ্র-নজরুল-অতুলপ্রসাদ-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তের গানের বাইরে বাংলা গানের যে ধারা হিমাংশু দত্ত, সুধীন দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, শচীন দেব বর্মনদের হাত ধরে খ্যাতির শিখর ছুঁয়েছিল, তার এই অবস্থা কেন?

Nirmalendu Chowdhury Gemälde
নির্মলেন্দু চৌধুরীর সময়কার স্বর্ণযুগ কি হারিয়ে গেল?ছবি: DW/P. Samanta

স্বর্ণযুগের শেষ প্রজন্মের শিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এ জন্য প্রযুক্তিকেই দায়ী করছেন৷ ১৯৬৩ সালে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে তিনি প্রথম পুজোর গান রেকর্ড করেন৷ তার পরের বছর সলিল চৌধুরীর সুরে গাওয়া ‘পাগল হাওয়া' বাংলা আধুনিক গানের একটি মুক্তো৷ পাঁচ দশক পেরিয়েও সেই গানের আবেদন কমেনি৷ প্রবীণ শিল্পী বলেন, ‘‘আসলে প্রযুক্তির এত দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে যে, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি বদলাতে পারছে না৷ এখন সকলের হাতে স্মার্টফোন৷ তাতে ইউটিউবের মাধ্যমে গান শোনা যায়, কিনতে হয় না৷ এর ফলে রেকর্ড কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ তাদের ব্যবসায় মন্দা থাকলে নতুন সিডি-ডিভিডি বেরোবে কী করে?'' নতুন গানের ক্ষেত্রে এই ভাটা কেন? জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘পুরনো গানের সিডি-ই যদি বিশেষ বিক্রি না হয়, তা হলে নতুন গান প্রকাশের ঝুঁকি ব্যবসায়ীরা নেবেন কী করে? এখনও ভালো গান হচ্ছে, কিন্তু ব্যবসায়িক দিকটা দুর্বল হওয়ায় গানের চর্চা মার খাচ্ছে৷ এর ফলে ভালো গান তৈরির সম্ভাবনা কমছে৷ এটা একেবারে একটা দুষ্টচক্র৷''

'ব্যবসায়িক দিকটা দুর্বল হওয়ায় গানের চর্চা মার খাচ্ছে'

এ প্রজন্মের শিল্পীরা তাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছেন৷ অনেক শিল্পী অনিয়মিতভাবে হলেও পুজোয় ইউটিউবে গান প্রকাশ করছেন৷ এতে রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি, রেকর্ডিং ও আনুষঙ্গিক খরচ এড়ানো যাচ্ছে৷ মোবাইল ডেটা ভারতে এখন খুব সস্তা হওয়ায় অনলাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইউটিউব বা অন্য মিউজিক ওয়েবসাইট দেখায় বাধা নেই৷ সেখানে গান প্রকাশ করলে নিমেষে তা পৌঁছে যাচ্ছে শ্রোতার স্মার্টফোনে৷ প্রযু্ক্তির এই বিপ্লবের তত্ত্ব মেনে নিলেও সংগীতশিল্পী অন্তরা চৌধুরী বেশি দোষ দিচ্ছেন বিপণন ও বাণিজ্যকে৷

তাঁর মতে, ‘‘গানের মান খারাপ হয়েছে এটা মানতেই হবে৷ শুধু প্রযুক্তিকে দোষ দিলে হবে না৷ আমার বাবার (সলিল চৌধুরী) আমলে যে ভালো সুর ও লিরিক তৈরি হতো, এখন কি তেমন তৈরি হয়? এখন গান গাইতে গেলে সেই মানের কথা-সুর পাওয়া যায় না৷ তাই শুধু স্মার্টফোনে গান শোনা হচ্ছে বলে নতুন গান হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়৷'' জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ও একই সুরে বলেছেন, ‘‘ভালো গান যারা তৈরি করতেন, তাঁরা সবাই চলে গেছেন৷ সে দিকে একটা ঘাটতি তো রয়েছেই৷''

এই অবক্ষয়ের জন্য বিপণনকে দুষছেন অন্তরা৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘এটা মার্কেটিংয়ের যুগ৷ সেই জন্যই নতুন বাংলা ছবির গান রমরমিয়ে চলছে৷ পুজোর গানের থেকে ছবির গানের প্রচার অনেক বেশি৷ প্রযোজকরা বিপুল টাকা ঢালছেন, তার জোরেই টিভি-এফএমের মাধ্যমে বারবার শুনিয়ে হ্যামার করা হচ্ছে৷ কিন্তু আধুনিক বাংলা গানের প্রচার কই?৷''

'গানের মান খারাপ হয়েছে, শুধু প্রযুক্তিকে দোষ দিলে হবে না'

সলিল-কন্যার বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার অনেক মিল৷ একাধিক বাংলা মিউজিক চ্যানেল এবং কলকাতার বিভিন্ন এফএম স্টেশন খুললেই নতুন বাংলা ছবির গানই মূলত শোনা যায়৷ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও এসব গানেরই রমরমা৷ তাই কখনও না-শোনা আধুনিক গান গণমাধ্যমে প্রচারিত না হলে শ্রোতারা গাঁটের কড়ি খসিয়ে এ সময়ের শিল্পীদের সিডি-ডিভিডি কিনবেন কেন? শুধু বাংলা নয়, হিন্দি গানের বেসিক রেকর্ডের ক্ষেত্রেও বিপদ ঘনিয়েছে একই কারণে৷ অন্তরা বলেন, ‘‘হিন্দি গানের ক্ষেত্রেও দেখুন, শুধুই ফিল্মের গানেরই জয়জয়কার৷ ব্যক্তিগত অ্যালবাম, গজল সেভাবে নতুন করে তৈরি হচ্ছে কই? সুতরাং প্রযুক্তি নয়, বিপণন আর প্রচারই আসল ব্যাপার৷''

প্রযুক্তির উন্নয়নেই বাংলা গানের অবক্ষয়, এ কথা মানছেন না মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির কর্ণধাররা৷ স্বর্ণযুগের গীতিকার প্রণব রায়ের পুত্র প্রদীপ্ত রায় তাঁর রেকর্ড কোম্পানি চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন৷ তাঁর মতে, ‘‘এটা একেবারে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়৷ বিনোদনের উপকরণ বেড়ে যাওয়ায় ভালো গানের সেই চাহিদা আর নেই৷ তবে গান শোনা আদৌ কমেনি৷ বিনা পয়সায় গান শোনার ঝোঁক বেড়েছে৷ তাই সিডি কোম্পানির ব্যবসা মার খাচ্ছে৷ এ সব কোম্পানি যেমন উঠে যাচ্ছে, সিডি-ডিভিডির দোকানও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ হাতে গোনা যেসব দোকান খোলা আছে, সেখানে সিডির বদলে ইলেকট্রনিক গুডস্ বেশি বিক্রি হয়৷''

এ জন্য নতুন ফরম্যাটের উপর জোর দিচ্ছেন প্রদীপ্ত রায়৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘ফরম্যাট বদল না করলে এই শিল্প বাঁচবে না৷ কিন্তু সেটা কোন ফরম্যাট, তা নিয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তাও হচ্ছে না৷'' এবারও প্রদীপ্ত রায়ের সংস্থা থেকে পুজোর গান বেরোচ্ছে৷ তবে সব অ্যালবামই পুরোনো শিল্পীদের৷

'বিনা পয়সায় গান শোনার ঝোঁক বেড়েছে'

এ সব স্বর্ণযুগের গানের আকর আকাশবাণী কলকাতা৷ ‘অনুরোধের আসর'-এর মাধ্যমে শ্রোতার কাছে রেডিও পৌঁছে দিতো কালজয়ী গান৷ সহজেই তা জনপ্রিয়তা পেতো৷ আজ ডিজিটাল বিনোদনের যুগে এ সময়ের নতুন গান প্রচারের জন্য আকাশবাণীর মতো কোনো বিকল্প মঞ্চ নেই৷ তাই মণ্ডপে বাজে মানবেন্দ্র-নির্মলেন্দুদের সেই হারানো সুরই৷ পাড়ার জলসার মুক্তমঞ্চও নেই, যেখানে গান গাইবেন এ সময়ের শিল্পীরা৷ কলকাতা ও শহরতলির প্রেক্ষাগৃহে মুষ্টিমেয় দর্শকের সামনে নিজেদের গান গাওয়ার সুযোগ পান শ্রীকান্ত আচার্য, লোপামুদ্রা মিত্ররা৷ তাও মাঝেমধ্যেই দর্শক আসন থেকে হাঁক শোনা যায়, ‘‘দাদা, কফিহাউসটা (মান্না দে-র ‘কফিহাউসের আড্ডা') হবে নাকি?''

কলকাতায় সিডি-ডিভিডির দোকান এখন সত্যিই হাতে গোনা৷ অতীতের পতাকা ধরে রেখেছে ধর্মতলার এম বিশ্বাস অ্যান্ড সিম্ফনি৷ তারা বলছে, গান শোনা কমেনি, বিক্রি কমেছে৷ কথাটা ভুল নয়৷ রাস্তাঘাটে, ট্রেনে-বাসে বিভিন্ন বয়সের মানুষের কানে গোঁজা ইয়ারপ্লাগ দেখে মনে হবে এটাই বুঝি গানের স্বর্ণযুগ৷ এত সংগীতরসিক এ দেশে কবে কে দেখেছে? কিন্তু সিম্ফনির কর্তা প্রেমকুমার গুপ্তা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গান শোনা না কমুক, বিক্রি তো কমেইছে৷ তাই অনেক সিনেমার গানের এখন ফিজিক্যাল রিলিজ হচ্ছে না, ডিজিটাল রিলিজ হচ্ছে৷ তবু কিছু সিডি-ডিভিডি বিক্রি হয়, সেটাও মূলত পুরোনো গানের৷ যারা ডিজিটালে স্বচ্ছন্দ নয়, প্রধানত তারাই ক্রেতা৷ এদের সৌজন্যে নতুন আধুনিক বাংলা গানও কিছুটা বিক্রি হয় বৈকি! তবে পুজোর বাংলা গান বলে বিশেষ কিছু নেই৷''

তাই শরতের আলোর বাঁশি বাজলেও পুজোর গান আর বাজে না৷ বাঙালির অনেক কিছুর মতো সেটাও হারিয়ে গেছে প্রায়৷ শুধু টিকে আছে স্মৃতিতে৷