1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অধ্যক্ষের শক্তিশালী চক্র এবং নুসরাত হত্যা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১১ এপ্রিল ২০১৯

ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি৷ বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি মারা যান৷ চিকিৎসকরা বলছেন, তাঁর শরীরের ৮৫ ভাগ পুড়ে যাওয়ায় শত চেষ্টা করেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি৷

https://p.dw.com/p/3Gcv9
প্রতীকী ছবিছবি: picture-alliance/E.Topcu

এখন প্রশ্ন হলো কাদের স্বার্থের বলি হলেন নুসরাত? ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদেই পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে৷ গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসার চারদিন পর তাঁর মৃত্যু হয়৷

এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলা ও তার সহযোগীদের৷ ২৭ মার্চ নুসরাতেরই অভিযোগে আটক হন সিরাজউদ্দৌলা৷ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ওই দিন নুসরাতকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করেন৷ এরপর মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ ও হুমকি দেয়া হয়৷ মামলা প্রত্যাহার না করায় নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়৷

ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে নোয়াখালী ও সোনাগাজীর বেশ কয়েকজন লোকের সাথে কথা বলা হয়েছে, যাঁরা ঘটনা সম্পর্কে জানেন৷ তাঁদের সাথে কথা বলে যা স্পষ্ট হয়েছে তা হলো, সাবেক জামায়াত নেতা অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা একটি ক্ষমতার বলয় গড়ে তুলেছিলেন৷ সেই বলয়ে ছিলেন পুলিশ, প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা৷ তাদের শক্তিতেই অধ্যক্ষ নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন, আর অভিযোগ হলে পারও পেয়ে যেতেন৷ এমনকি অভিযোগকারীরা উলটো হেনস্তার শিকার হতেন৷

যাদের নাম আসছে

সোনাগাজীর মাদ্রাসাটি একটি আলিয়া মাদ্রাসা এবং অনেক পুরনো ও উপজেলার সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা৷ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলা ১৫ বছর ধরে এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ৷ তিনি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক উপজেলা আমীর৷ তার বিরুদ্ধে নাশকতা, অর্থ আত্মসাৎ ও যৌন হয়রানির অভিযোগে তিন বছর আগে জামায়াত থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়৷ কিন্তু তারপর তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায় অবস্থান টিকিয়ে রাখেন৷

এক্ষেত্রে দুইজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম উচ্চারিত হচ্ছে৷ তারা হলেন সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম আর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মামুন৷ তবে স্বার্থের দ্বন্দ্বে মামুন সরে গেলেও মাকসুদ তার সঙ্গে ছিলেন৷

আব্দুল মান্নান

যৌন হয়রানির মামলায় ২৭ মার্চ আটক হওয়ার পর মাকসুদ শিক্ষার্থীদের দিয়ে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মিছিল বের করিয়েছিলেন৷ ডয়চে ভেলেকে একথা জানিয়ে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমীন বলেন, ‘‘মাকসুদ নানা স্বার্থের কারণে অধ্যক্ষের পক্ষ নেয়৷''

মাকসুদ মাদ্রাসার গভর্নিং বডিরও সদস্য৷

একই অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমীনের বিরুদ্ধেও৷ তিনি মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি৷

ফেনী ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাজীব ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হন সরকারি কর্মকর্তা৷ একারণে ভাইস চেয়ারম্যানই মূলত সব ক্ষমতার অধিকারী৷ ২৭ মার্চ যৌন হয়রানির ঘটনায় রুহুল আমীনই কৌশলে অধ্যক্ষকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন৷''

সোনাগাজী খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক মনির আহমেদ অভিযোগ করেন, ‘‘অধ্যক্ষকে বাঁচাতে পুলিশের সঙ্গে লেনদেন এবং দেন দরবার এই আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীনই করেন৷ আর অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা রুহুল আমীনসহ আরো যাদের গভর্নিং বডিতে নিয়েছেন, তারা লেখাপড়ায় কেউ হাইস্কুলের গন্ডি পার হতে পারেননি৷''

তবে রুহুল আমীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘আমিই অধ্যক্ষকে পুলিশের হাতে তুলে দেই৷''

প্রশাসনও অধ্যক্ষের সহযোগী

এর আগে গত সেপ্টেম্বরে আরও এক ছাত্রী অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করলে তাও আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রশাসনের সহায়তায় ধামাচাপা দেয়া হয়৷

মনির আহমেদ বলেন, ‘‘তখন অধ্যক্ষ সবার কাছে মাফ চান এবং বলেন ভবিষ্যতে এরকম কাজ আর করবেন না৷''

এদিকে, ওই ছাত্রী গভর্নিং বডির সভাপতি ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পিকে এনামুল করিমের কাছে অভিযোগ দিলেও তিনিও কোনো ব্যবস্থা নেননি৷ তার আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল আহমেদের কাছেও অভিযোগ করা হয়৷ তিনিও কোনো ব্যবস্থা নেননি৷

স্থানীয় লোকজন জানান, ওই পরিবারটি পরে চাপের মুখে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়৷

রফিকুল ইসলাম

তবে নুসরাতের ঘটনার পর সেই ছাত্রীটি আবার জবানবন্দি দিয়েছে পুলিশের কাছে৷

এদিকে, নুসরাত ২৭ মার্চ যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর অধ্যক্ষ আটক হলেও তাকে স্বপদেই বহাল রাখা হয়েছিল৷

এইসব ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সেপ্টেম্বরের ঘটনায় ওই মেয়েটির পরিবার পরে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়৷ আর ২৭ মার্চের ঘটনার সময় আমি নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত ছিলাম৷''

আওয়ামী লীগ নেতা রুহল আমীনও নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত থাকার কথা বলেছেন৷

যা করেছেন ওসি

২৭ মার্চ যৌন হয়রানির ঘটনার পর নুসরাতকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্মতা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন এবং ইন্সপেক্টর (তদন্ত) কামাল হোসেন৷ সেই জেরার ঘটনা তারা ভিডিও করেছেন৷ নুসরাতকে তারা অনেক আপত্তিকর এবং বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্ন করেন৷ নুসরাত দুই হাতে মুখ ঢেকে জবাব দিতে থাকলে তারা বারবার হাত সরাতে বলেন৷ শুধু তাই নয় নুসরাত কান্নায় ভেঙে পড়লে তারা বলেন, ‘‘তোমারতো কিছুই হয়নি, কান্নাকাটি করছো কেন?''

কোনো নারী সদস্যকে দিয়ে কথা না বলিয়ে ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা কথা বলেন৷ এক পর্যায়ে তারা নুসরাতকে বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করে ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করেন৷

মনির আহমেদ বলেন, ‘‘ওসি এবং তার সহযোগীরা যৌন হয়রানির ঘটনাকে নাটক বলে প্রচার করেছে৷ এটাকে নাটক বানানোর সব চেষ্টা তারা করেছে৷ আর পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার পর তারা এটাকে শুরুতে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে৷ ডিআইজি সোনাগাজীতে আসার পর এইসব বিষয় তাঁকে বলা হয়েছে৷ অধ্যক্ষকে বাঁচানোর জন্য ওসি প্রাথমিকভাবে দুই লাখ টাকা নিয়েছেন এই অভিযোগ প্রকাশ্যেই করা হয়েছে৷ আর ওসিকে টাকা পৌঁছে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আমীন৷''

ওসিকে এরই মধ্যে বদলি করে দেয়া হয়েছে৷ তিনি বুধবার ডয়চে ভেলের কাছে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন৷

আর ইন্সপেক্টর তদন্ত কামাল হোসেন দাবি করেছেন, ‘‘নুসরাতকে থানায় কারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আমরা জানা নেই৷ এধরণের কোনো ভিডিও আছে বলেও আমার জানা নেই৷ ভিডিওতে তো আমার কণ্ঠ নাই, শুনে দেখেন৷ আর যার কণ্ঠ আছে, সে কে আমি জানিনা৷''

এদিকে এই অধ্যক্ষের মামলা পরিচালনা করেন ফেনীর কাজির বাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন বুলবুল৷ তাকে বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে৷

জাহাঙ্গীর আলম নান্টু

অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

ফেনীতে উম্মুল কুরান প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা৷ এই প্রতিষ্ঠানের ১ কোটি ৩৯ লাখ ৪ হাজার টাকার চেক জালিয়াতি করে আত্মসাতের ঘটনায় তিনি গত ১০ জুলাই মাসে কারাগারে যান৷ পরে জামিনে মুক্তি পান৷

আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম নান্টু এই তথ্য জনিয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তার বিরুদ্ধে মাদ্রাসার ৪৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে৷ ২০১৪ সালে নাশকতা ও পুলিশের ওপর হামলার মামলায় সে ২০১৭ সালে কারাভোগ করে৷''

কেন তারা অধ্যক্ষের লোক?

যে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ তার পক্ষে কেন কাজ করে পুলিশ, প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগ নেতারা? মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য এবং সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল মান্নান জানান, ‘‘মাদ্রাসার একটি তিন তলা মার্কেট আছে৷ আরো একটি দোতলা মার্কেটের কাজ চলছে৷ এছাড়া মাদ্রাসার ভবন নির্মাণের কাজও শুরু হবে৷ এছাড়া একজন পীর এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফলে এখানে অনেক মানুষ দান করেন৷ আর মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষদের শতভাগ বেতন দেয় সরকার৷ কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন দিতে হয়৷ তাই মাদ্রাসার লাখ লাখ টাকা আয় আছে মাসে৷ এটি সোনাগাজীর সবচেয়ে বড় এবং পুরনো মাদ্রাসা৷''

স্থানীয় সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম বলেল, ‘‘এই টাকার ভাগ বাটোয়ারা করেন অধ্যক্ষ৷ তাই তাকে রক্ষা করতে সব মহলেরই কিছু লোক সক্রিয়৷ আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কমপক্ষে ১৫ জন প্রভাবশালী নেতা তার পক্ষে কাজ করেন৷''

আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘অতীতে আমরা মাদ্রাসা অধ্যক্ষের এইসব অনিয়ম, অপকর্মের প্রতিবাদ করেও কোনো ফল পাইনি৷ আমি নিজে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের কাছে৷ কোনো কাজ হয়নি৷ উলটো হয়রানির শিকার হতে হয়েছে৷ কারণ প্রভাবশালীদের সে পকেটে নিয়েছে৷ এর মাধ্যমে সে টিকে আছে এবং নানা অপকর্ম করে পার পেয়ে যাচ্ছে৷''

অধ্যক্ষের এইসব কাজের প্রতিবাদ যেসব শিক্ষকরা করেছেন তারাও হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ রফিকুল ইসলাম জানান, ‘‘কয়েকজন শিক্ষক তাকে মাদ্রাসার ভাবমূর্তি রক্ষায় চরিত্র ঠিক করতে বলায় তিনি তাদের শোকজও করেন৷''

জাহাঙ্গীর আলম নান্টু বলেন, ‘‘১৯৯৬ সালে তিনি এই মাদ্রাসায় যোগ দেন৷ এরপরই তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের নানা সুবিধা দিয়ে তার পকেটে রাখেন৷ ফলে যে-কোনো অপকর্ম করে অতীতে পার পেয়ে গেছেন৷''