1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘কেউ যেন ক্ষতিপূরণ মামলা না করে’

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৯ মে ২০১৮

প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে বহু মানুষ৷ এমনই এক দুর্ঘটনায় ১৯৮৯ সালে মারা যান দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু৷ক্ষতিপূরণ মামলা করেছিলেন তাঁর স্ত্রী রওশন আখতার৷মামলা জিতেও এখন তিনি ক্ষুব্ধ, হতাশ৷

https://p.dw.com/p/2yMgl
ঢাকার রাস্তা
ছবি: DW/M. Mamun

দীর্ঘ ২৬ বছর মামলা চলার পর ২০১৬ সালে রওশন আখতারকে ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷ কিন্তু কোথায় কী? ডয়চে ভেলের কাছে দীর্ঘ এই আইনি লড়াইয়ের সমস্তটা খুলে বলেছেন রওশন আখতার৷

ডয়চে ভেলে: আপনার স্বামী ১৯৮৯ সালে একটা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান৷ এরপর তো আপনি একটা লম্বা আইনি যুদ্ধ চালিয়ে চালাচ্ছেন৷ তার সর্বশেষ অবস্থা যদি বলেন...

রওশন আখতার: সংক্ষেপে যদি প্রেক্ষাপটটা বলি, তাহলে ১৯৯১ সালে জানুয়ারি মাসে মামলাটা করা হলো৷ এরপর ১৪ বছর ধরে মামলাটা চলল৷ তারপর রায়ে আমাকে ৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা দিতে বলা হলো৷ আমি যেটা দাবি করেছিলাম সেটাই৷ অন্যদিকে শেখ ফজলে নূর তাপস হলেন আইনজীবী আর তাঁর আপন ভায়রা হলেন বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক৷ ওনারা আপিল করলেন৷ সেখানে আবার পাঁচ বছর লাগল হাইকোর্টে রায় হতে৷ ২০১০ সালে হাইকোর্টে রায় হলো৷ জজ কোর্টের রায় হয়েছিল ২০০৫ সালে৷ হাইকোর্টে টাকাটা কমিয়ে দেয়া হলো৷ তখন ২ কোটি ১ লাখ টাকা সাতদিনের মধ্যে দিতে বলা হলো৷ জজ কোর্টে ৩০ দিনের মধ্যে দিতে বলা হয়েছিল৷ এরপর তারা লিভ টু আপিল করল৷ সেখানে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে রায় হলো৷

‘দীর্ঘসূত্রিতা এবং আইনে কিছু ত্রুটি থাকার কারণে এই মামলাগুলো কেউ করে না’

সেখানে আপিল খারিজ হয়ে গেল৷ তখন প্রধান বিচারপতি এবং অন্য দু'জন বিচারপতি আমাকে বললেন যে, তাঁরা টাকাটা রি-অ্যাসেসমেন্ট করবেন৷ কারণ ১৯৯১ সালের মামলা ২০১৬ সালে হচ্ছে৷ তাই রি-অ্যাসেসমেন্টের ব্যাপার আছে৷ সুদে-আসলে বাড়বে এটাই হয়ত বলতে চেয়েছিলেন ওনারা৷ কথা ছিল, রি-অ্যাসেসমেন্ট করে ওনারা জাজমেন্টের কপি দেবেন৷ কিন্তু ছ'মাস হয়ে গেল জাজমেন্টের কপি আর দেয়া হয়নি৷ এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি অবসরে চলে গেলেন৷ আবার চার দিনের নোটিসে রিকল করল৷ তখন এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি৷ রিকল করে কী করা হলো.... তখন আবার ৩২ লাখ টাকা কমিয়ে দেয়া হলো৷ অর্থাৎ আমাকে ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা দিতে বলা হলো৷ তখন মৌখিকভাবে বলা হলো, সাত দিনের মধ্যে টাকাটা দিয়ে দিতে৷ কিন্তু লিখিত দেয়নি৷

ঐ সময়ের মধ্যে টাকা দেয়া তো দূরের কথা, উলটে আমাকে টাকা পাওয়ার জন্য লোয়ার কোর্টে মামলা ফাইল করতে হলো৷ সেই টাকাও দিচ্ছেই না৷ বরং প্রতিদিন কোর্ট থেকে রেকর্ডটা দেখে যায়, ফলোআপ করে যায়৷ যেহেতু টাকা দেয়নি, তাই তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার তিনটা প্লট মিলে পাঁচ বিঘা জমি ক্রোক করা হলো৷ এরপর আমাকে দু'বার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হলো৷ এতে এক লাখ টাকা খরচ হলো৷ এছাড়া আরো অনেক টাকা খরচ হয়েছে৷ সেখানে নিলামের যে ফর্মালিটিজ করা হয়, কিন্তু কেউ উপস্থিত হয় না৷ আসলে উপস্থিত হতে দেয় না৷ এভাবে গত মাস পর্যন্ত দু'বার নিলাম হয়ে গেছে৷ কেউ আসে না, ডাক ওঠে না৷ ফলে জমিটাও বিক্রি করা যায়নি৷ আর আমার টাকাও পাইনি৷

আপনি তো দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন৷ তা এই লড়াই করতে গিয়ে আপনার কী কী প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে?

প্রতিকূলতা বলতে কী? আক্ষরিক অর্থে না বললেও আমার লড়াইটা ছিল জাহাজের সঙ্গে ডিঙ্গি নৌকার৷ আমার প্রতিপক্ষ চরম ক্ষমতাশালী আর আমি ততই দুর্বল একজন কলেজ শিক্ষক৷ আমার পক্ষে এই লড়াইয়ে যাওয়া মানে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া৷ কারণ ওদের প্রচুর টাকা আর আমার নেই খাওয়ার পয়সা৷

এই লড়াইটা করতে গিয়ে আপনাকে তো প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়েছে?

প্রচুর টাকা৷ ১৯৮৯ সালে আমার বেতন যেখানে সর্বসাকুল্যে দেড় হাজার টাকা, তখন প্রতি মাসে ৬০০ টাকা রাখতে হতো ক্ল্যারিকাল ফি হিসেবে কোর্টের জন্য৷ বাকি টাকা দিয়ে কীভাবে চলেছি, তা আমি-ই জানি৷ বাবার বাড়িতে থাকি, তাই ভাড়া লাগে না৷ তখন আমার ছোট দু'টো বাচ্চা ছিল৷ নয় বছর আর পাঁচ বছর৷ সৈয়দ হাসান ইমাম স্কুলে তাদের ফ্রি পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিল৷ তারপর সৈয়দ হাসান ইমাম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে মাসে এক হাজার টাকার একটা ভাতা করে দিয়েছিলেন৷ এগুলো দিয়ে চলছিল৷ এছাড়া আমার বাবা সাহায্য করেছিলেন৷ আমার ভাই অ্যামেরিকায় থাকেন, তিনি কিছু সাহায্য করেছিলেন৷ তবে আমার শরীরের উপর দিয়ে পরিশ্রম গেছে৷

আপনার তো দু'টো ছেলে৷ এদের মধ্যে কয়েকদিন আগে একজনের বিয়ে হয়েছে৷ তাই না?

হ্যাঁ, কয়েকদিন আগে ছোট ছেলের বিয়ে হয়েছে৷ এই জার্নিতে আমাকে শারীরিকভাবে, আর্থিকভাবে, মানসিকভাবে এবং সামাজিকভাবে – এই চারভাবে পর্যদুস্ত হতে হয়েছে৷

এখনো আপনি তাহলে কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি?

পাইনি তো বটেই, উলটে আমাকে নিম্ন আদালতে দুই বছর ধরে মামলা চালাতে হচ্ছে৷ এতে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে৷ আপনি বলবেন টাকা কোথায় পাচ্ছেন? ৬ লাখ টাকা এককালীন পাওয়ার জন্য আমার পেনশন অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিয়েছি৷ অনেক ধার হয়ে গিয়েছিল৷ সেগুলো শোধ করার জন্য এটা করতে হয়েছে৷ পেনশনের টাকা দিয়ে, গ্রাচুইটির টাকা দিয়ে ধার শোধ করেছি৷ এখন ১০ বছর হলো আমি কোনো পেনশন পাই না৷ তাহলে বলবেন, মামলা চালাই কীভাবে? আমার যে ছেলেটা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ওর বেতনের টাকা দিয়ে এখন মামলা চালাচ্ছি৷ হয়ত বলবেন, ছেলেকে বিয়ে দিলেন কীভাবে? আমার ছোট ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোন নিয়ে বিয়ে করেছে৷ আর বড় ছেলে এমন চাকরি করে, যেখানে লোন করার সুযোগ নেই৷ ফলে তার বিয়েও দিতে পারছি না৷

আপনার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর আপনি কি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কোনো কাজ করেছেন?

না৷ আমি তো জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক ছিলাম৷ কবি নজরুল কলেজের শিক্ষক ছিলাম৷ আমার পারিবারিক ঝামেলা অনেক বেশি ছিল৷ আমার নিজের দু'টো বাচ্চা৷ তার ওপর আমার বাবা ২৫ বছর মানসিক রোগী ছিলেন, তাঁকে দেখতে হতো৷ এগুলো করার পর আমি যে আলাদা কোনো কাজ করব, তার কোনো উপায় ছিল না৷ এমনকি দু'টো পয়সা অন্য কাজ করেও উপার্জন করার সুযোগও ছিল না৷

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আমাদের দেশে যে আইন আছে, সেটা কি পর্যাপ্ত?

ক্ষতিপূরণ মামলাটাকে বলে ‘টট কেস'৷ এই আইনটা তো প্রথম আমাদের দেশে কার্যকর হলো আমার মামলা দিয়েই৷ বাংলাদেশে এ ধরনের মামলার এটাই প্রথম নজির৷ বিদেশে এই আইনে প্রচুর মামলা হয়৷ আমাদের দেশে দীর্ঘসূত্রিতা এবং আইনে কিছু ত্রুটি থাকার কারণে এই মামলাগুলো কেউ করে না৷

১৯৯১ সালে আপনি এই মামলা করেছিলেন৷ তখন এই মামলার কথা কেন মনে হলো?

আমার স্বামীর অবদান এবং পাণ্ডিত্য বিবেচনা করে সংবাদ কর্তৃপক্ষ তখন আমাকে ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে দেয়নি৷ তারা বলল, আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হবার নয়৷ কিন্তু আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা চালাব৷ আসলে আমার তখন কোনো ধারণাই ছিল না৷ তখন এই মামলার আইনজীবী ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক৷ মারা গেছেন উনি৷ আমি একদিন ওনার বাসায় গেলাম৷ তখন ওনার জুনিয়র আমাকে বললেন, ‘সংবাদ থেকে তো কোনো টাকা দেয় না, এই মামলা আমরা কীভাবে চালাব?' তখন আমি বললাম, ‘তাহলে আমি মামলা তুলে নেই৷ কারণ আমার পক্ষে এই মামলা চালানো সম্ভব নয়৷

যেহেতু সংবাদ টাকা দেয় না, সেহেতু এই মামলা চালিয়ে কোনো লাভ নেই৷' তখন আমিনুল হক আমাকে বললেন, ‘প্লিজ আপনি মামলাটা তুলে নেবেন না৷ আমি এটা চালাব৷ আমাদের দেশে এই ক্ষতিপূরণ মামলার কোনো নজির নেই৷ আমি একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই৷ আমার ভাই সার্জেন্ট জহুরুল হককে যখন আগরতলা মামলায় মেরে ফেলল, তখন এক টাকা দাবি করে পাকিস্থান সরকারের বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছিলাম৷ নজির সৃষ্টি করার জন্য৷ কিন্তু এরপর মুক্তিযুদ্ধ হলো৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানও নেই৷ ফলে সেই মামলাও নেই৷ এখন আপনার মামলা পেলাম, এটা দিয়ে একটা নজির সৃষ্টি করতে চাই৷' এরপর উনি মারা গেলেন৷ ফলে মামলাটাও হারিয়ে গেল৷ কারণ ঐ  মামলার কোনো বাপ-মা ছিল না৷ এরপর বর্তমান যিনি আইনজীবী খলিলুর রহমান, তাঁর সঙ্গে আমাদের একটা পারিবারিক যোগাযোগ ছিল৷ ওনার কাছে যখন গেলাম, তখন মামলার কোনো কাগজপত্র আমাদের কাছে নেই৷ শুধু অভিযোগ আর উত্তর নিয়েই উনি অ্যামেন্ডমেন্ট করে মামলা আবার চালু করলেন৷ তখন থেকে উনিই মামলা চালাচ্ছেন৷

আপনি যাদের সঙ্গে লড়াই করছেন, তারা তো অনেক ক্ষমতাধর৷ তারা কি কখনও আপনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে? অথবা লাঞ্ছনাকর কোনো পরিস্থিতিতে কখনও পড়েছেন?

না৷ তারা এই কাজ কখনও করেনি৷ তারা এতটাই প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাশালী যে তাদের কাছে আমি অতি তুচ্ছ এক জীব৷ আমাকে কাউন্ট করার মতো কোনো প্রয়োজনীয়তা তাদের নেই৷

সমঝোতার জন্য তারা কি তখন আপনাকে প্রস্তাব দিয়েছিল?

আমাকে তারা কোনো প্রস্তাব দেননি৷ আমার স্বামী যখন মারা গেল, তখন বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক ছিলেন আমানুল্লাহ সাহেব৷ উনি সমবেদনা জানাতে ওনার ভাইকে এবং মামলার আইও-কে একবার আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন কম্প্রোমাইজ করার জন্য৷ আমি তো তখন আসলে মামলাও বুঝি না, কম্প্রোমাইজও বুঝি না৷ আমি ছিলাম তখন ইমব্যালেন্সড৷ ফলে প্রশ্ন আসেনি যে কত টাকা দেবে বা কী পাবো৷

নিম্ন আদালতে আপনি জেতার পর কি তারা কখনও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে?

না, তারা কোনো যোগাযোগ করেনি৷ বরং নিম্ন আদালতে ঘুরতে ঘুরতে আমি এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ওনাদের আইনজীবীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, ভাই আমাকে দু-চার লাখ টাকা দিয়ে দিন৷ আমি আর এই মামলা চালাব না৷ আপনি ওনাদের সঙ্গে আলাপ করুন৷ তখন তার কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাইনি৷

আপনার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন৷ প্রতিদিনই বহু মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন৷ এই সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যদি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আপনি কিছু বলতে চান...

এই মামলা করে আমি ভিকটিম হলাম৷ কারণ এই মামলা করে টাকা পাওয়ার কোনো উপায় এখনও আমি দেখছি না৷ তাই অপরপক্ষ যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে আমি সবাইকে পরামর্শ দেবো যে তারা যেন ক্ষতিপূরণ মামলা না করেন৷ আপসে যদি তারা কিছু দেয়, সেটা হাত পেতে নেয়া উচিত৷ মামলা করে টাকা পাওয়ার জন্য যে পদ্ধতি বা আইন, সেটা আমাদের দেশে সেভাবে নেই৷

সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে আপনি কি মামলা করবেন?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান