কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্ব-দরবারে পাকিস্তানের ছবি
২৮ আগস্ট ২০২৩কড়া সেন্সরশিপ ও সমাজের কট্টর মনোভাবের সাথে লড়তে হয় পাকিস্তানের শিল্পীদের৷ চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরও শৈল্পিক স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া হয়৷ কিন্তু খুব ধীরে হলেও পরিবর্তন আসছে৷
২০১২ সালে চিত্রনির্মাতা শারমিন ওবায়েদ-চিনয় অস্কার জেতেন তার তথ্যচিত্রের জন্য৷ প্রথম পাকিস্তানি হিসাবে এই পুরস্কার জেতেন তিনি৷ এর পার বছর পর, দ্বিতীয় অস্কার জেতেন তার ছবি ‘আ গার্ল ইন দ্য রিভার: দ্য প্রাইস অফ ফরগিভনেস'-এর জন্য৷
আপাতত শারমিন ব্যস্ত তার নতুন কাজ নিয়ে৷ ২০২৫ সালে মুক্তি পাবে তার পরিচালনায় ‘স্টার ওয়ার্স' সিরিজের ছবি৷ এই প্রথম কোনো অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি ও অশ্বেতাঙ্গ নারী হিসাবে এই সিরিজ পরিচালনা করবেন তিনি৷
আরেক তরুণ পরিচালক আসিম আব্বাসি ব্যস্ত বিখ্যাত কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ ‘দ্য ফেমাস ফাইভ'-এর একটিা পর্ব নিয়ে৷
অবশেষে মঞ্চ পাচ্ছে পাকিস্তানের সিনেমা
স্থানীয়দের মতে, পাকিস্তানের তরুণ নির্মাতাদের সাফল্যে নতুন করে শক্তি পাচ্ছে দেশের চলচ্চিত্র শিল্প৷ কিন্তু কতটা বাস্তবিক এই ধারণা?
শারমিন এ বিষয়ে বলেন, ‘‘বহু বছর ধরে নানা কারণে পাকিস্তানের পরিচালকরা দেশের বাঁধাধরা গতের বাইরে কাজ করতে পারছিলেন না৷ কিন্তু এখন নতুন চিত্রনির্মাতারা সাহস দেখাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হোক বা যুক্তরাজ্যে গিয়েও কাজ করার৷''
তিনি যোগ করেন, ‘‘শুধু পরিচালকরাই নয়, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও যাচ্ছেন (যেমন, ফাওয়াদ খান, মেহউইশ হাওয়াত, আহাদ রাজা মীর)৷ এটা প্রমাণ করে যে, তরুণ প্রজন্ম তাদের শিল্পের জন্য যে কোনো জায়গায় গিয়ে কাজ করতে পারে৷''
‘‘কিন্তু পাকিস্তানে সিনেমা বানানো কঠিন, বিনিয়োগ নেই, সরকারি সমর্থন নেই, কিন্তু সেন্সরশিপ আছে৷ চিত্র নির্মাতারা চান এমন গল্প বলতে যেগুলি সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ৷ আর সেই গল্পের খাতিরে দেশের বাইরে যেতে হলেও তারা যাবেন৷ আমার মতে, চিত্র নির্মাতারা সম্মান চান৷ তাদের শিল্প সম্মানের দাবীদার৷ আমার খুব আনন্দ হয় যখন দেখি আমার সহকর্মীরা সারা বিশ্বে সিনেমা বানাচ্ছেন৷''
চমকে দেওয়া
পাকিস্তানি সিনেমার সাম্প্রতিক সাফল্য বিষয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শক ও ডিস্ট্রিবিউটার নাদিম মান্দভিওয়ালা মনে করেন, এতে করে দেশের পরিচালকরা অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন৷
তিনি বলেন, ‘‘দ্য লেজেন্ড অফ দ্য মওলা জাটের ব্যবসায়িক সাফল্যের পরেও অনেকে ভাবতে পারেননি যে বিশ্বের বক্স অফিসে আমরা এমন সাফল্য পাব৷ এটা অবশ্যই মনোবল বাড়ায়৷''
কিন্তু দেশে সফল হতে আরো অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয়, জানান তিনি৷
তার মতে, ‘‘আরো বেশি ছবি বানাতে আমাদের আরো সক্রিয় হতে হবে৷ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি তাতে ভূমিকা রাখবে৷ যে দশজন ছবি বানাবেন, তার মধ্যে একজন না একজন নজর কাড়বেনই৷''
এ বিষয়ে শারমিনও একমত৷
তিনি বলেন, ‘‘প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন এই খাতে সার্বিক উন্নয়ন না আনতে পারলেও এতে করে নতুন প্রজন্মের পরিচালকরা নিজেদের পথ বেছে নেবার একটা সুযোগ পাবেন৷ কিন্তু সার্বিকভাবে শিল্পের উন্নতি হবে না৷''
স্থানীয় বক্স অফিসের হতাশাময় চিত্রের কথা বললেন বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ আলি জেন৷
তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধটা অনেকটা কঠিন৷ প্রথমে করোনা সংকট ধাক্কা দিলো৷ এছাড়া ভারতীয় ছবি এখানে দেখানো বন্ধ হওয়ায় দেশের একটি বড় মাল্টিপ্লেক্স সংস্থা তাদের সিনেমা হলের সংখ্যা গত চার বছরে ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে৷ ২০২৪ পর্যন্ত কোনো বড় বাজেটের ছবির সম্ভাবনা নেই৷ একমাত্র হলিউডের ইংরেজি ছবির বদৌলতে আমাদের ব্যবসা টিকে আছে৷ এভাবে কত দিন চলবে জানিনা৷''
জীবন-মরণ লড়াই
‘‘আমরা এখন বাঁচা-মরার লড়াই লড়ছি'', বলেন মান্ডভিওয়ালা৷ তিনি বলেন, ‘‘যবে থেকে সরকার দেশে ভারতীয় ছবি মুক্তি পাওয়া বন্ধ করেছে, আমাদের এগোনোর কথা ভুলে বাঁচার কথা ভাবতে হচ্ছে৷ এর বিকল্প না পাওযা গেলে এমনটাই চলবে৷ বিষয়টা হচ্ছে, পাকিস্তানিরা উর্দু বোঝেন, বলেন৷ ভারতীয় ছবির ভাষাও ওটাই৷ মানুষ বুঝতে পারে এই ছবি৷''
অভিনেতা আদনান শাহ টিপু স্থানীয় ছবির মান নিয়ে সন্দিহান৷
তিনি বলেন, ‘‘আমি চিরকালই মনে করে এসেছি যে আমাদের শিল্পের মানের পেছনে বিনিয়োগ করা উচিত৷ প্রযোজনার মানের উন্নতি দরকার৷ আর সিনেমার টিকিটও এখন সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে৷ বলুন তো, কে কিনবে সাড়ে সাতশো পাকিস্তানি রুপির (২৭০ বাংলাদেশি টাকা) টিকিট? জনসাধারণের সাধ্যের মধ্যে সিনেমাকে না আনতে পারলে কিছুই হবেনা৷''
বৈচিত্র্যের অভাবের এই অভিযোগ বিষয়ে মান্ডভিওয়ালা বলেন, ‘‘পুরোনো দিনে আমরা শুনতাম যে শুধু একই ধরনের মানুষ সিনেমা দেখতে আসেন৷ ফলে, সিনেমায় বেশি করে গান-নাচ রাখতেই হতো৷ সেটা এখন পাল্টে গেছে৷ এখন শিক্ষিত সমাজও সিনেমা দেখে৷ আমাদের তুলনায় হলিউডে অন্য মাত্রার বৈচিত্র্য রয়েছে৷ তা সত্ত্বেও আমার মতে, দেশের জণগণই ঠিক করা উচিত, তারা কী ধরনের সিনেমা দেখবে৷’’
মোহাম্মদ সলমান (করাচি)/এসএস