1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নাবালিকাদের বিয়ের হার উদ্বেগজনক

পায়েল সামন্ত
১২ ডিসেম্বর ২০১৮

নাবালিকা বিয়ে বন্ধে রাজ্যের প্রশাসন সক্রিয়৷ কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রকল্প নিয়ে প্রচার এবং ঢক্কানিনাদের শেষ নেই৷ তবুও ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্‌থ সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা মায়ের সংখ্যা বাড়ছে৷ 

https://p.dw.com/p/39wBq
Kanyashri, ein Projekt für Mädchen, das von West Bengal Govt eingeführt wurde, ist auf nationaler und internationaler Ebene gelobt worden
ছবি: DW/P. Samanta

মুর্শিদাবাদের বড়ঞায় রেজিনা খাতুনের সঙ্গে আলাপ একটি জুতোর দোকানে৷ কোলের শিশুটি তাঁর নাতি৷ শিশুটির মা কোথায় জানতে চাইলে তিনি জানান, শিশুর মা বাড়িতে৷ টিকা নেওয়া, ডাক্তার দেখানো, বাচ্চার জন্য কেনাকাটা করার মতো কাজগুলো তিনিই করেন৷ শিশুটির মা কি অসুস্থ? বয়স কত? জানা গেল, মায়ের বয়স সবে ১৭, প্রায়ই রোগে ভোগে৷ 

সরকারি প্রকল্পের পোস্টারে ছয়লাপ চারপাশ৷ আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি পাওয়া ‘কন্যাশ্রী' এখন ‘বিশ্বশ্রী' আখ্যায় ভূষিত৷ স্কুলছুট মেয়েরা এখন ‘মিড ডে মিল'-এর লাইনের প্রথম সারিতে বসে৷ নাবালিকারা নিজেরাই এখন বিয়ে ভাঙতে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়৷ বিপুল উৎসাহে কাজ করে চলেছে মীনা মঞ্চ বা কন্যাশ্রী যোদ্ধারা৷ তথাপি, নাবালিকা মায়েদের সন্তানধারণ করার নজিরে এ রাজ্যের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক৷ ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্‌থ সার্ভে বলছে, নাবালিকা মায়েদের সন্তানধারণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান একেবারে খারাপ দুটি রাজ্যের মধ্যে৷ ত্রিপুরাকে বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গই সবচেয়ে খারাপ৷ হিমাচল প্রদেশে যেখানে এই নাবালিকা গর্ভধারণের হার ২ থেকে ৩ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে ১৮ শতাংশ৷ যার মানে, প্রতি ১০০ জন মায়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ১৮ জনই অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন ১৮ বছরের নীচে, সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় যা অনেকটাই বেশি৷

রেজানা খাতুন

শহরের তুলনায় গ্রামে এই সমস্যাটা বেশি প্রকট বলে মনে করেন শহরের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক৷ একইরকম তথ্য সমীক্ষা থেকেও পাওয়া যাচ্ছে৷ জেলাগুলির মধ্যে মুর্শিদাবাদ শীর্ষে৷ এরপরে বাঁকুড়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা৷ সব ক্ষেত্রেই শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চলেই এই পরিসংখ্যান উদ্বেগের৷

নাবালিকা মায়ের সংখ্যা বৃ্দ্ধির কারণটা একদমই আর্থসামাজিক সমস্যা৷ এমনটাই মনে করেন মুর্শিদাবাদের রানিনগর ব্লকের একটি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আব্দুল হালিম৷ তাঁর মতে, ‘‘মুর্শিদাবাদ, মালদা, দুই ২৪ পরগনার মতো সীমান্তবর্তী জেলা থেকে মেয়ে পাচারের মতো ঘটনা ঘটে থাকে৷ তার ফলে নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণ থেকেই বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয় পরিবারকে৷ আর সংসারে প্রবেশ করলে নারীত্বের প্রমাণ দিতে অল্প বয়সেই প্রসবের ঝুঁকি নিতে হয়৷''

তাঁর মাদ্রাসাতেও নাবালিকা মায়েদের দেখা মেলে৷ তবে সেটা সংখ্যায় কম৷ কারণ, মীনা মঞ্চ এখানে ভালো কাজ করছে৷ তিনি জানালেন, ‘‘বারো ক্লাসের একটি মেয়ে মাদ্রাসায় আসে৷ তার একটি সন্তান আছে৷ তবে ওইটুকুই৷ আর তেমন কেউ নেই৷''

জেলাগুলিতে যে এ ব্যাপারে সচেতনতার অভাব, তা স্পষ্ট মুর্শিদাবাদের রেজিনা খাতুনের কথা থেকে৷ তাঁর কোনো ধারণাই নেই যে, নাবালিকা মা হওয়া সন্তান বা মা উভয়ের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে৷ তিনি জানান, তিনিও অল্প বয়সে মা হয়েছেন৷ তাঁর মেয়েও অল্প বয়সে মা হয়েছে৷ কোনো সমস্যা হয়নি৷

কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী, নাবালিকা অবস্থায় সন্তান প্রসবের ফল মা ও সন্তানকে সারাজীবনই ভুগতে হয়৷ তাছাড়া নাবালিকা মায়েদের গর্ভপাত ও রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে৷ এ ব্যাপারে চিকিৎসক এস এম রহমান বলেন, ‘‘মানসিকভাবে একজন নাবালিকা পরিপূর্ণ হয় না৷ মা হিসেবেও সে বাচ্চার দেখভালের ব্যাপারে ঠিকমতো যত্ন নিতে পারবে না৷ আর প্রসবের সময়ে প্রিম্যাচিওর বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই থাকে৷''

সুনন্দা মুখার্জী

রাজ্যে প্রসূতি বা শিশুমৃত্যুর হারও অনেক কমেছে বলে দাবি ওঠে৷ রাজ্যের এক স্বাস্থ্যকর্তার কথা অনুযায়ী, পরিবার পরিকল্পনায় আমাদের রাজ্যের ফল সারা দেশের মধ্যে সেরা৷ জন্ম নিয়ন্ত্রণে আশা কর্মী, এএনএম নার্স, ডাক্তাররা যে কাজ করেছেন তা বাহবা পাওয়ার যোগ্য৷ তাহলে মা-মাটি-মানুষের সরকারের রাজ্যে নাবালিকা মায়েদের সংখ্যা বাড়ছে কেন? এর কারণটা কি বাল্যবিবাহ নাকি অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব?

মেয়েরা যে আজও পরিবারের কাছে বোঝা, সেটা বললেন মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়৷ তাঁর মতে, বাল্যবিবাহ এটার একটা কারণ৷ বিয়ের পর নাবালিকার মাতৃত্বও অনেকটা অবাঞ্ছিত মাতৃত্বই৷ একটা নাবালিকার বিয়ে হলে তার মাতৃত্ব অবাঞ্ছিত মাতৃত্বই৷ সে শরীরে বাড়লেও মনে তো বাড়নি, তাই এটা বায়োলজিক্যাল মাতৃত্বই কেবল৷ সে মানসিকভাবে মা নয়৷ আবার যৌনতা সম্পর্কে ট্যাবুগুলোও ছোট ছোট মেয়েদের বেপথু করে৷ গর্ভপাত বা অবাঞ্ছিত মা হওয়া যার ফলশ্রুতি৷''

পশ্চিমবঙ্গে যেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে এত প্রচার, সেখানে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে নাবালিকারা এতটা অজ্ঞ কেন? সুনন্দা ব্যাখ্যা করেন, ‘‘আমাদের এখানে জীবনশৈলী শিক্ষাটা এখনো সেভাবে আসেনি৷ প্রশাসন ও শিক্ষকেরা চাননি৷ আমরা মনে করি, যৌনতার উপর পরিবারের কন্ট্রোল থাকবে৷ ফলে যৌনতার স্বাভাবিক দাবি ব্যহত হচ্ছে৷ নাবালিকারা শরীর আর বৌদ্ধিক দাবি একসঙ্গে মেনে চলতে পারে না৷ তাই তারা যৌনতার হাতছানিতে ভুল করে ফেলে৷ নাবালিকারা কনট্রাসেপটিভ ব্যবহার করে না৷ তাই গর্ভপাতের প্রয়োজনও হয়৷ যৌনতার সঙ্গে মাতৃত্ব মিলিয়ে দেওয়াটা ভয়ঙ্কর ভুল৷''

শহরতলি বা মফস্বলে অনেক নার্সিংহোমও গজিয়ে উঠেছে৷ অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের দায় এড়াতে সেসব জায়গা কতটা সহায় হচ্ছে? সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ড. হাসি দাশগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘অল্পবয়সি মায়েদের ভিড় যে হাসপাতালে লেগে রয়েছে, এমনটা নয়৷ আমাদের চোখে তেমনটা পড়ে না৷ সম্ভবত এমন ডেলিভারি যারা করাচ্ছে, তারা হাসপাতালের বাইরেই করাচ্ছে৷ হাসপাতালে করালে তারা তো ধরা পড়ে যাবে, এই ভয়টা তো থাকবেই৷ তবে এবার থেকে হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসাকেন্দ্রে ডেলিভারি হলে সেটা যাতে হাসপাতালের নজরদারিতে পড়ে, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷''

অজন্তা পাল

প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে এমন হওয়ার সম্ভাবনা যতটা, ঠিক ততটাই কম শহরের বুকে থাকা হাসপাতালগুলিতে৷ শহরের অনেক চিকিৎসকই তা মনে করেন৷ তাই জাতীয় সমীক্ষার সঙ্গে শহরের অভিজ্ঞতা সবসময় মেলে না৷ নীলরতন সরকার হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অজন্তা পাল ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘শহরে ১৪-১৫ বছরের মেয়েরা তেমনভাবে প্রসবকালীন সময়ে আসে না৷ এখানে কড়াকড়ি বেশি৷ অ্যান্টি-নাটাল পিরিয়ডে যে চেক-আপ হয়, তাতে বয়সের আইডি দিতে হয়৷ ফলে মূল শহরের হাসপাতালে এসব সমস্যা দেখা যায় না৷ তাই এই ঘটনা মূলত শহরের বাইরে দেখতে পাবেন৷ তবে বলতে পারি, নাবালিকা মায়েদের এখন দেখা যায় না৷'' পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের একটি বেসরকারি নার্সিংহোমের মালিক প্রদীপ বেরা জানালেন, ‘‘১৮- এর নীচে যারা আসে, তাদের সংখ্যাটা ১০ শতাংশ৷ যেটা আগের থেকে ৫ শতাংশ হলেও কমেছে৷'' 

হাসপাতালে সন্তানসম্ভবা মেয়েদের বয়স যাচাই হয় কীভাবে? তারা যে নাবালিকা নয়, সেটা কী দেখে বোঝেন? অজন্তা জানান, ‘‘অনেকে ম্যারেজ সার্টিফিকেট বা সঠিক কাগজপত্র দেখাতে পারেন না৷ তাদের জিজ্ঞেস করতে হয়৷ মুখের কথায় বিশ্বাস করতে হয়৷ সে ক্ষেত্রে বয়সে কারচুপি থাকলে আমাদের কিছু করার থাকে না৷ বিশেষ করে বিহার বা প্রতিবেশী রাজ্য থেকে যারা আসে, তাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি দেখা যায়৷''