1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কল্পিত ইসলামিক জনগোষ্ঠী বা মুসলিম উম্মার ধারণা বদলে দিল অনেক কিছু

১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯

বিশ্বায়নের এই যুগে ধর্মের নামে রাজনীতির ব্যবহার ব্যাপক আকার নিয়েছে৷ বহু মুসলিম দেশে চলছে রাজনীতির স্বার্থে ধর্ম এবং ধর্মের স্বার্থে রাজনীতির ব্যবহার৷ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জঙ্গিবাদ ও মুসলিম উম্মার ধারণা৷

https://p.dw.com/p/Jk60
বিশ্বায়নের যুগে ইসলামি পুনর্জাগরণ : মিথ, স্মৃতি এবং অনুভূতি - এই ছিল নরওয়ের সম্মেলনের বিষয়বস্তুছবি: DW

সীমানাহীন একটি কল্পিত ইসলামিক জনগোষ্ঠী বা মুসলিম উম্মার ধারণা বদলে দিয়েছে অনেক কিছু৷ রাজনৈতিক ফায়দা লাভের আশায় উম্মার ধারণাকে জঙ্গিবাদের অপর এক নাম হিসেবে দেখতে শুরু করেছে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের অনেকেই৷ আর সেখানেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সেতুবন্ধের৷

ইসলাম নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানে মুসলিম উম্মা নামের একটি শব্দ হামেশাই শুনতে পাওয়া যায়৷ যার আক্ষরিক অর্থ - ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ গোটা মুসলমান সমাজ৷ এমনকি সম্প্রতি, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজিউল হাসান খান তাঁর এক বক্তৃতায় দাবি করেন, আমরা বাঙালি জাতি নই, আমরা ইসলামি উম্মা৷

Islamic Resurgence in the Age of Globalization
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে হিজাব পরিহিতা মোনা হাসানছবি: DW

কি এই ইসলামি বা মুসলিম উম্মা ?

সুদূর নরওয়েতে সাম্প্রতিক একটি সম্মেলনে ঠিক এ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করলেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিশেষজ্ঞ, ঐতিহাসিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং সাংবাদিকরা৷ বিশ্বায়নের যুগে ইসলামি পুনর্জাগরণ : মিথ, স্মৃতি এবং অনুভূতি - এই নামের আড়ালে আয়োজিত সম্মেলনের সংগঠক ইটসচাক ভাইসমান জানান : কল্পনা হিসেবে এর অস্তিত্ব আছে, বাস্তবে হয়তো নয়৷ সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে এবং বিশ্বব্যাপী এই সম্পর্ক আজ গড়ে উঠছে - কখনো ইন্টারনেটের মাধ্যমে অথবা কখনো কেবেল টিভির মাধ্যমে৷ এবং এই সূত্রে বলা যেতে পারে, উম্মার একটি সংহত ধারণা তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু, উম্মার মাঝে মতপার্থক্যও রয়েছে৷ কারণ, মুসলমানদের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্যও রয়েছে৷ তাদের মধ্যে জেহাদি রয়েছে, মধ্যপন্থী রয়েছে, এমনকি সুফিরা রয়েছে৷ ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান ভিন্ন৷ যেমন মিশরের মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাইজিরিয়া বা ভারতীয় মুসলমানদের থেকে আলাদা৷ আবার একই দেশে বসবাসকারী মুসলমানদের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে - পার্থক্য রয়েছে নারী-পুরুষে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে৷ সুতরাং, উম্মা কল্পিত এক জনগোষ্ঠী ছাড়া আর কিছু নয়৷

প্রশ্ন হল - আত্মপরিচয় ধর্মীয় সচেতনতা একই ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে কতটুকু যোগসূত্র সৃষ্টি করতে সক্ষম ? জাপানে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্যালি অগাস্টাইন বললেন : ধর্ম হিসেবে, সম্প্রদায় হিসেবে আত্মপরিচয় নিয়ে সচেতনতার একটা ব্যাপার গড়ে উঠতে দেখছি আমরা৷ আমার মতে, একই ধর্মের মানুষরা নিজেদের মধ্যে একটা ঐক্যসূত্র খুঁজতে চেষ্টা করে সবসময়েই৷ এ ঘটনা আঞ্চলিক স্তরে চোখে পড়ে৷ আর বর্তমানে মিডিয়ার বিস্তারের কারণে আন্তর্জাতিক স্তরেও এ ধরণের একটা সচেতনতা প্রত্যক্ষ করা যায়৷

খুব স্বাভাবিকভাবেই, আত্মপরিচয় বা আইডেন্টিটি-কে কিছু মানুষ তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে৷ আবার একই সময়, পরিচয়ই মানুষকে একটি বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করে৷ এবং সেই সঙ্গে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকে ভিন্ন বলে চিহ্নিত করে৷ ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমেই প্রকাশ পায় কোন ব্যক্তির ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচিতি৷ তার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় ব্যক্তিগত বিশ্বাস, স্মৃতি অথবা অনুভূতির প্রকাশ৷ আর ধর্মের কথা বললেই চলে আসে ধর্ম প্রচারকদের কথা৷ মুক্ত অর্থনীতির এ যুগেও তাদের দেখা যায়৷ জানালেন ইসরায়েল থেকে আসা শশ বেন-অরি৷ তাঁর কথায় : মসজিদ অথবা শুক্রবারের নামাজ থেকে শুরু করে অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাঝে আমরা তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করি৷ অবশ্য ব্যক্তি বিশেষের ওপর একজন ধর্ম প্রচারকের জনপ্রিয়তা নির্ভর করে৷ অর্থাৎ, ক্যারিসমার তারতম্যে তিনি কম বা বেশি জনপ্রিয় হতে পারেন৷ তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পেতে পারে৷ কোন একটা সময় তিনি হয়ত নিজের একটা ওয়েবসাইটও খুলে বসেন৷ চলে ইমেল মারফত কথোপকথন৷ এহেন কোন কোন ধর্ম প্রচারকদের আবার বিশাল সংখ্যক ফ্যানও থাকে৷ বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের জনপ্রিয়তা হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকে কম নয়৷

Islamic Resurgence in the Age of Globalization
সম্মেলন সংগঠক ইটসচাক ভাইসমান (ডানে) এবং ঐতিহাসিক মার্ক সেডগভিক (মাঝে)ছবি: DW

জনপ্রিয় ঐতিহাসিক বিশ্বাস

কিন্তু, এর থেকেও বড় সমস্যা থেকে যায় মানুষের মননে৷ যাকে ঐতিহাসিক মার্ক সেডগভিক চিহ্নিত করেছেন জনপ্রিয় ঐতিহাসিক বিশ্বাস হিসেবে৷ তাঁর মতে, কোন বিশেষ সময়ের ইতিহাস লিখতে হলে সে সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা ছাড়াও মানুষের স্মৃতি এবং বিশ্বাসের গুরুত্ব অপরিসীম৷ তাঁর কথায় : পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই উম্মার ধারণা নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত৷ তারা চিন্তিত জিহাদিদের তত্ত্ব নিয়ে, তাদের দর্শন নিয়ে৷ আর সেটা হওয়াই যে স্বাভাবিক৷ যেমন আরব বিশ্বের অনেকের ঐতিহাসিক বিশ্বাস কিন্তু জিহাদি দর্শনের বেশ কাছাকাছি৷ আর সে জন্য উম্মার ধারণাটিও বহু ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে৷ সেই বিশ্বাস থেকেই জিহাদিরা শক্তি সঞ্চার করে৷ কিন্তু সমস্যাটা হলো এর বিপরিতমুখী একটি ইতিহাস তৈরি করা৷ কারণ, মানব মনে জনপ্রিয় ঐতিহাসিক বিশ্বাস সত্যিই অত্যন্ত গভীর হয়৷ একে প্রতিরোধ করার একমাত্র পথ - কর্ম নয়, কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করা৷ আর তাহলেই প্লেন দিয়ে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা বা জঙ্গিবাদ তার সমর্থন হারাতে পারে৷

সত্যি, নাইন-ইলেভেনের ঘটনাকে কার না মনে আছে ! তাহলে কি এহেন একটা ধারণাকে কেন্দ্র করেই কী মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে ইসলামি জঙ্গিবাদ ? নরওয়ের সম্মেলন সংগঠক ইটসচাক ভাইসমান কিন্তু জানালেন অন্য তথ্য৷ তিনি বলেন : ১৯৬০ থেকে, বিশেষ করে ১৯৭০ সাল থেকে ইসলামি পুনরুত্থান প্রত্যক্ষ করছি আমরা৷ এদের মধ্যে বেশিরভাগের ভিত্তিই মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে৷ আশ্চর্যের বিষয়, এটা এমন একটা সময় ঘটতে শুরু করে, যখন বিশ্বায়ন শুরু হয়েছে সবে৷ সে সময় এক নিমেষেই পৃথিবীটা যেন হাতের মুঠোয় চলে আসে৷ নতুন নতুন মিডিয়া, প্রচার মাধ্যম চলে আসে বাজারে৷ সেই সূত্র ধরে অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হয়৷ ইসলাম আরো গুরুত্ব পেতে থাকে৷

Islamic Resurgence in the Age of Globalization
সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন দেশ-বিদেশ থেকে আসা বিশেষজ্ঞ, ঐতিহাসিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং সাংবাদিকরাছবি: DW

ইসলামের পুনরুত্থান বা পুনর্জাগরণ তো আর জঙ্গিবাদ নয়

ভারতের জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জার্মান বংশোদ্ভূত মিশায়েল ডুশের মতে, ইসলামের সঙ্গে জঙ্গিবাদকে এক সঙ্গে দেখলে চলবে না৷ কারণ, যে কোন ধর্মের মানুষই জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে৷ আর ইউরোপেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না৷ বর্তমানে জার্মানিতে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বাড়ছে৷ কিন্তু, এটা কোন ধরণের ভয়ের কারণ নয়৷ সেখানকার অমুসলমানরা বা অমুসলমান তরুণ সম্প্রদায় মুসলমানদের তুলনায় কোন অংশে কম বা বেশি শঙ্কার কারণ কখনোই নয়৷ বরং সমাজে সব ধর্মের সহাবস্থান এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-নির্ধারণ করাটাই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা উচিৎ৷ জানান মিশায়েল ডুশে৷

তাহলে ? আদতে উম্মার পিছনে কি ধরণের উদ্দেশ্য কাজ করে থাকে ? নিজেকে হিজাবের আড়ালে লুকিয়ে রাখা তুর্কী বংশোদ্ভূত মোনা হাসান জানান : ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলনের অনেকটাই মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি গড়ে তুলতে বিশেষভাবে আগ্রহী৷ এ যেন সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক - সব ক্ষেত্রে এক ধরণের কল্যাণমুখী চেতনা তৈরি করা৷ তবে বর্তমান সময়ে, ইসলামি উম্মার অস্তিত্বের কথা ভাবতে গেলে, রাজনৈতিক দিকটাকেই প্রাধান্য দিতে হবে৷ ব্যাপারটা দেখতে হবে মুসলমানদের আবেগ অনুভূতি, চিন্তাভাবনা, আশা, আকাঙ্ক্ষা - তাদের পরস্পর সম্পর্কে আগ্রহের প্রেক্ষাপটেই৷ তারপর অবশ্য সেটাকে অন্য এক পর্যায়ে টেনে নেওয়া যেতে পারে৷ মানবজাতির বাকি অংশের ব্যাপারে তাদের আগ্রহের প্রেক্ষাপটে দেখা যেতে পারে উম্মাকে৷

তাছাড়া, এক দেশের মানুষ আবেগের সঙ্গে উম্মা ব্যাপারটি যেভাবে অনুধাবন করেন, অন্য দেশের মুসলমানরা হয়ত সেভাবে দেখে না৷ ইসলামে ছোট জাতের মুসলমান বা দ্ররিদ্রদের উপহাস অথবা অবজ্ঞা করার কোন বিধান নেই৷ অথচ মধ্যপ্রাচ্যে নাকি বাংলাদেশিদের মিসকিন বলে অবজ্ঞা করা হয়৷ ন্যায্য মজুরি থেকে তাদের অনেককে বঞ্চিত করার অভিযোগ আছে৷ এবং প্রতিবাদ করলে, নির্দয় প্রহারে জোর করে দেশে ফেরৎ পাঠানোর ঘটনাও বিরল নয়৷ সেক্ষেত্রে, কল্পিত জনগোষ্ঠী হিসেবে উম্মার ধারণা কি আদৌ কার্যকর হওয়া সম্ভব ?

প্রতিবেদক: দেবারতি গুহ

সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক