1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কে বুদ্ধিজীবী

শাহনাজ মুন্নী
৯ জুলাই ২০২১

সহজ জ্ঞানে, সাধারণ ভাবে বুদ্ধিকে উপজীব্য করে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের বুদ্ধিজীবী বলা হলেও বিষয়টা এত সরল নয় আসলে৷ আদর্শিক ভাবে এমন একদল ব্যক্তিকে বুদ্ধিজীবী বলে ভাবা হয়, যারা সমাজ নিয়ে জটিল চিন্তা করেন৷

https://p.dw.com/p/3wGdt
শাহনাজ মুন্নী, সাংবাদিকছবি: privat

সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে মননশীল বিশ্লেষণ ও গবেষণা করেন এবং যাদের বিশিষ্ট ভাবনা চিন্তা সমাজকে প্রভাবিত করে৷ বুদ্ধিজীবীরা তাদের সময়ের নৈতিক চেতনাকে বিনির্মাণ করেন, সমাজ ও রাজনীতিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেন এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের চেতনা অনুযায়ী এসব বিষয়ে মতামত দেন৷ যিনি বুদ্ধিজীবী, ধরে নেয়া হয়, তিনি হবেন মানবিক, গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা এবং জনগণ ও সমাজের মঙ্গলকামী৷ তিনি হবেন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি, আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরোধী৷ তিনি কথা বলবেন জনগণের পক্ষে, থাকবেন শান্তি, ন্যায়, কল্যাণ ও সত্যের সঙ্গে৷

কারা প্রকৃত বুদ্ধিজীবী- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বিশ্বের বড় বড় পণ্ডিত ও চিন্তাবিদেরা৷ ইতালীয় চিন্তাবিদ গ্রামসি লিখেছিলেন, ‘সব মানুষই বুদ্ধিজীবী, কিন্তু সব মানুষই সমাজে বুদ্ধিজীবীর কাজ করে না৷' তার মতে, সমাজে অনেকে আছেন যারা ঐতিহ্যগতভাবেই বুদ্ধিজীবী যেমন, শিক্ষক, যাজক, পুরোহিত, ইমাম৷ আরেক দল আছে অর্গানিক বুদ্ধিজীবী, যারা সবসময়ই নিজ নিজ শ্রেণীগত অবস্থানে থেকে জগতকে ব্যাখ্যা করেন৷ তারা পুঁজিবাদী অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে চেষ্টা চালান জনমতকে প্রভাবিত করতে৷ 

ফরাসি দার্শনিক জুলিয়েন বেন্দা মনে করেন, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী তারাই যারা জাগতিক লাভের উর্ধ্বে উঠে নিঃস্বার্থ এবং আপোষহীন জ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত থাকেন৷ সত্য উচ্চারণে তারা থাকেন নির্ভীক, এমনকি সত্য প্রকাশের জন্য প্রাণ সংশয়ের মতো ঝুঁকি নিতেও তারা দ্বিধা করেন না৷ বরং জাতির সংকটে নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন৷      

আরেক দার্শনিক এডওয়ার্ড সাঈদের মতে বুদ্ধিজীবী এমন একজন ব্যক্তি যিনি স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের পক্ষে একটি নির্দিষ্ট বার্তা, একটি দৃষ্টিভঙ্গী ও একটি সুচিন্তিত মতামত জনগণের সামনে তুলে ধরেন৷ কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে সত্য প্রকাশ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না৷

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি বুদ্ধিজীবির দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে আরো পরিস্কারভাবে বলেছেন, ‘‘বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারের মিথ্যাগুলোকে জনগণের সামনে উন্মোচন করা৷’’

তার মতে,  বুদ্ধিজীবীরা যুক্তিভিত্তিক চিন্তা ভাবনা অনুসরণ করে রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কাজের চুল চেরা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করবেন এবং সেসব নিয়ে কথা বলবেন৷ তারা জনগণের পক্ষে থেকে সত্যকে অনুসন্ধান করবেন এবং তা জনগণের সামনে প্রকাশ করবেন৷ এই বুদ্ধিজীবীরা যে কোন পেশারই হতে পারেন৷ অধ্যাপক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, শিল্পবোদ্ধা, আইনজীবী বা হতে পারেন রাজনীতি আলোচকও৷

তবে বুঝতে হবে, বুদ্ধিজীবী কোন উপাধি নয়, পেশাও নয়, এমনকি এটি স্বভাবজাত বিষয়ও নয় বরং অনেকটাই হয়ে ওঠার ব্যাপার৷  জ্ঞানে, কর্মে, মননে, চিন্তায় এবং তার প্রকাশের চর্চার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ধীরে ধীরে বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠেন৷   

বুদ্ধিজীবীরা শক্তি ও ক্ষমতার বাইরে থেকে রাষ্ট্র ও সমাজের সমস্যাগুলি নিয়ে নিরপেক্ষভাবে আলোচনা করেন, বিরাজমান ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং সমাধানের পথ নির্দেশনা দেন৷ এর মাধ্যমে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় এবং তারা গণব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাজে সম্মান পান৷

তবে ক্লাসিক যুগের আদর্শবাদী নির্ভীক বুদ্ধিজীবীদের সম্মানের সেই জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে গেছে বহু আগে থেকেই৷ মূলত বুদ্ধিজীবীরা যখন থেকে তাদের দায়িত্বের স্বরূপ ভুলে, নিজেদের স্বাধীন ও শক্তিশালী মতপ্রকাশের অবস্থান থেকে পিছু হটলেন, যখন থেকে তারা চোখের সামনে অন্যায়-অবিচার ঘটতে দেখেও নীরব থাকলেন এবং নীতি নৈতিকতা ভুলে ক্ষমতাসীনদের অন্যায় আচরণের সাথে সুর মেলালেন তখন থেকেই মূলত তাদের অসম্মানের শুরু৷

১৯৭২ সালে আহমদ ছফা তার ‘বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিন্যাস’ গ্রন্থে তীব্র ভাষায় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতা বিষয়ে খোলামেলা সমালোচনা করেন৷ ৪৭ এর দেশভাগ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ - পর্যন্ত ২৪ বছরে এ অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীরা কিভাবে মানসিক দাসত্ব ও দৈন্যের চর্চা করেছেন তা ছফা তথ্য উপাত্তসহ তুলে ধরেন৷ সেই সময় তার একটি কথার খুব প্রচলন হয়েছিল৷ সেটা হচ্ছে, ‘‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না৷ এখন যা বলছেন সেটা শুনলে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঘটবে না৷’’

আহমদ ছফার মতে , বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা সুবিধাবাদি৷ তারা নিজেদের আখের গোছাতেই বেশি ব্যস্ত, সমাজের কল্যাণ সাধন তাদের উদ্দেশ্য নয়৷ মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে তারা নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি ব্যয় করতে আগ্রহী নন৷ নিজের স্বার্থের বাইরে তারা একচুলও নড়েন না৷  

বুদ্ধিজীবীর ইংরেজি প্রতিশব্দ ইন্টেলেকচুয়াল এর অপভ্রংশ ‘আঁতেল’ বহুদিন ধরেই বিদ্রুপার্থে এদেশে বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়৷ অনেকে একে ‘গালি’ হিসেবেও দেখেন৷ জনমনে ধারণা ‘আঁতেল’রা খামোকাই সহজ বিষয়কে কঠিন করে তুলতে পারদর্শী আর নিজের যতটা বুদ্ধি আছে তারচে বেশি প্রদর্শনের চেষ্টায় তৎপর৷ 

সবচে যেটা উদ্বেগজনক, বুদ্ধিজীবীতার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানটাই এখন যেন বহুলাংশে পাল্টে গেছে৷ অধিকাংশ জনগণ বুদ্ধিজীবী ধারণাটিকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে থাকেন৷ অন্যভাবে বলতে গেলে মানুষের কাছে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় নেই বললেই চলে৷ এর কারণ, বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততার উপর নির্ভর করে বুদ্ধিজীবীর পরিচয়৷ ফলে দলীয় বুদ্ধিজীবীদের দেখা যায়, যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশ্নহীন, নিস্ক্রীয়, নীরব৷ আবার তাদেরই কেউ কেউ হয়তো রাষ্ট্রযন্ত্রের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী হিসেবে রাষ্ট্রীয় সকল পদক্ষেপের পক্ষে সভা সেমিনার ও টেলিভিশনের টক শোতে ওকালতি করে যান৷ 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে কার লাভ, কার ক্ষতি?

শিক্ষবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক আবুল কাশেম ফজলুল হক সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে যথার্থই বলেছেন, ‘‘স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন চিন্তার চর্চা নেই৷ আত্মবিক্রীত বুদ্ধিজীবীরা কেবল অর্থ বিত্ত আর ক্ষমতার ধান্দায় লিপ্ত থাকেন৷’’ 

বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমরা কি সেরকমই দেখছি না? ‘বুদ্ধিজীবী’ নামধারীরা অনেকেই ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির স্বার্থে অবলীলায় নিজেদের নৈতিকতা বিসর্জন দিচ্ছেন৷ অনেকে যুক্ত হয়েছেন সাম্প্রদায়িকতা এবং শ্রেণী স্বার্থ রক্ষার সংকীর্ণ কার্যক্রমের সাথে৷ অনেকেই স্বেচ্ছায় সরকারি নীতি স্বার্থ ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন ৷

বাংলাদেশে এখন সত্যিকারের মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীদের খুঁজে পাওয়াই ভার, যারা আছেন তারাও নানা ধরনের চাপে অনেকটাই কোনঠাসা৷ এরই মধ্যে পুরনো পৃথিবীকে প্রায় ওলট-পালট করে দিয়ে এসেছে সোশাল মিডিয়ার যুগ৷ যেখানে প্রায় প্রত্যেকেই বিভিন্ন ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নিজস্ব বিচার বিবেচনার আলোকে মতামত দিয়েছন৷ নিজ নিজ জ্ঞান-বুদ্ধির আলোকে স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত চিন্তা ভাবনার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন৷ এর ফলে এখন ‘বুদ্ধিজীবী'র প্রাচীন ধারণাটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে৷ কে বুদ্ধিজীবী, আর কে নয় তা আসলে নির্ধারণ করবে কে? সমাজে সর্বব্যাপী মানসিক দাসত্ব, দীনতা ও আপোষকামিতার বিরুদ্ধে গিয়ে যথার্থ মৌলিকতার স্ফুরণ ঘটবে কীভাবে?

এক্ষেত্রে আহমদ ছফার কথাগুলোকেই আবার স্মরণ করি, ‘‘মানসিক দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাজটা হৈ হৈ করে হওয়ার কথা নয়৷ এতে প্রয়োজন সুন্দরতম ধৈর্য্য, মহত্তম সাহস, তীক্ষ্ণতম মেধা এবং প্রচণ্ড কূল ছাপানো ভালবাসা, যার স্পর্শে আমাদের জনগণের কুঁকড়ে যাওয়া মানসিক প্রত্যঙ্গে আশা আকাঙ্খা জাগবে এবং সাহস ফণা মেলবে৷’’

‘বুদ্ধিজীবী’ কোনো নাজেল হওয়া ব্যক্তি বা বস্তু নয়৷ সমাজ থেকেই বুদ্ধিজীবী উঠে আসেন এবং তার কর্ম, সৃজনশীলতা ও দায়িত্ববোধের প্রকাশ ঘটিয়েই তিনি অনেকের মধ্যে পৃথক হয়ে উঠেন৷ তবে বর্তমান নিয়ন্ত্রণকামী, অসহিষ্ণু সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তিক নির্ভীক কন্ঠ শুনতে পাওয়ার প্রত্যাশা এক ধরনের দুরাশা বৈকি৷ জানি না, এই ডামাডোলে বুদ্ধিজীবীর কাল একেবারেই বিলুপ্ত হতে চলেছে কি না!

তথ্যসূত্র :

১. বুদ্ধিজীবীর দায়/ আজিজুল রাসেল/ এনটিভি অনলাইন/৯ মার্চ, ২০১৫

২. বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস/ আহমদ ছফা / মুক্তধারা ১৯৭২

৩. বিশেষ সাক্ষাতকার : আবুল কাশেম ফজলুল হক/ প্রথম আলো/ ৪ জুলাই, ২০২১

৪. আমাদের সময় ও তার প্রেক্ষিত বোঝার জন্য নোম চমস্কি যেভাবে সাহায্য করেন/ মুহম্মদ গোলাম সারওয়ার/ শুদ্ধস্বর/ অক্টোবর ১, ২০১৯৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য