কোন মুখে মোদীর সমালোচনা?
২ নভেম্বর ২০১৮স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের এক অতিকায় মূর্তি গুজরাটের সর্দার সরোবর বাঁধের পাশে খাড়া করে ইতিহাসে নাম তুলতে চাইছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ উচ্চতার হিসেবে এই মূর্তি বিশ্বের বৃহত্তম৷ অর্থাৎ জগৎসভায় ভারতের নামও উজ্জ্বল করবে এই মূর্তি, এমনটাই দাবি সরকার পক্ষ ও তাদের সমর্থকদের৷ কিন্তু সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, দেশে যখন এত সমস্যা, এমন ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, সরকারি শুল্কের চড়া হারের কারণে জ্বালানির দাম ক্রমশই বেড়ে চলেছে, সেখানে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করে একটা মূর্তি তৈরি করা কতদূর বিচক্ষণতার কাজ৷ ওই পরিমাণ টাকায় কী কী হতে পারত, কত ভুখা মানুষের খিদে মিটত, কত গ্রাম-মফস্সলে পরিকাঠামোর উন্নয়ন হতে পারতে— সেই পাল্টা হিসেব দিচ্ছেন সরকারবিরোধীরা৷ এবং এই সমালোচনার সুর পশ্চিমবঙ্গে একটু বেশিই চড়া৷ কিন্তু তারও পাল্টা যুক্তি উঠে আসছে৷ সরকারি অর্থ, প্রকারান্তরে জনগণের অর্থের এই অপচয় কি কোনো নতুন ঘটনা? প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা৷ পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কলকাতাসহ গোটা রাজ্য জুড়ে যে ব্যাপক সৌন্দর্যায়ণ শুরু হয়েছে, তার প্রয়োজনীয়তা কতটা, সেই প্রশ্ন উঠছে৷ এই যে সারা বছর ধরেই কলকাতার রাস্তাঘাট, সরকারি বাড়ি, সেতুপথ, সব নীল-সাদা রঙ করে দেওয়া হচ্ছে, এবং সেই রঙের কাজ কখনো বন্ধ হচ্ছে না, তাতে কার কী লাভ হচ্ছে? সারা বছর প্রচুর বাহারি আলোয় রাস্তার দুধার এবং মাঝের বুলেভার্ডের গাছপালা মুড়ে রেখে, শহরকে উৎসবের ঝলমলে সাজ পরিয়ে রেখে কোন উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে? জানতে চাইছেন অনেকেই৷
সমাজকর্মী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক সুদীপ্তা রায়চৌধুরী মুখার্জি কিন্তু প্যাটেলের মূর্তি বসানো এবং শহরকে সাজিয়ে তোলা— এই দুটোকে এক করে দেখতে নারাজ৷ তাঁর বক্তব্য, নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে কলকাতাসহ গোটা রাজ্য যেরকম হতশ্রী চেহারা নিয়েছিল, তাতে বাইরে থেকে কেউ এলেই পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে শুরুতেই একটা খারাপ ধারণা করে নিতেন৷ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, প্রয়াত রাজীব গান্ধীর একটি মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলেন সুদীপ্তা, যে ‘‘নব্বইয়ের দশকে এই রাজ্যে এসে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মৃত নগরী'৷ কিন্তু আজকে যখন অনেক রাতে আপনি উড়ান শেষ করে খুব ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন, তখন ভিআইপি রোড ধরে বাড়ি ফেরার সময় সারা দিনের ক্লান্তি কিছুটা লাঘব হবে৷’’
সুদীপ্তা খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রথম দর্শনে, অথবা দৈনন্দিন জীবনে এই ভালো বোধ করার বিষয়টিকে৷ খুব জোর দিয়ে বলছেন, ‘‘মানুষ যখন একটা ভালো, সুন্দর পরিবেশের মধ্যে দিয়ে কাজে যায়, তার কাজ করবার একটা ভালো (বোধ) তৈরি হয়৷ শিল্পে, বাণিজ্যে তার প্রভাব পড়বে৷’’ এর সঙ্গেই সুদীপ্তা রাখছেন শিল্পপতি এবং বিনিয়োগকারীদের এই রাজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি৷ একটা সুন্দর শহর, তাঁর মতে, একটা ভালো বিজ্ঞাপনের মতো৷
অন্যদিকে এক বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার অতনু প্রজ্ঞান বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন, সৌন্দর্যায়নের পিছনে এই বিপুল টাকা খরচ কিন্তু অর্থের সুপ্রয়োগ নয়৷ বরং অন্য অনেক জায়গায় সেই টাকা প্রকৃত উন্নয়নের কাজে লাগানো যেত৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘আমি যে রাজারহাট এলাকায় চাকরি করি, সেখান থেকে যখন রাত্রিবেলা বাড়ি ফিরি, তখন (দেখি) গোটা রাস্তাটা মুড়ে দেওয়া হয়েছে রকমারি আলোতে৷ ... অথচ একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বরের দিকের বাইপাসে কোনো আলো ছিল না৷’’ অতনুর সাফ কথা, ‘‘সৌন্দর্যায়ন বলতে কিছু এলাকার রাস্তাঘাট আলোকিত করা হলো, সারা শহরটাকে রঙ করা হলো, কিছু বাড়ি রঙ করা হলো, তা তো নয়৷’’ বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার প্রশ্নেও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন অতনু যে, এই যে লগ্নি টানার কথা বলে এত টাকা খরচ হচ্ছে, লগ্নি হিসেবে এ রাজ্যে তার কতটা ফেরত আসছে, আদৌ কতটা ফেরত আসছে, তার হিসেব কি কেউ কোনোদিন করেছে?