1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কোক স্টুডিও বাংলা : প্রান্তিক প্রতিনিধিত্বের বিপ্লব?

নাফিসা তানজীম
১৬ জুন ২০২৩

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কোক স্টুডিও বাংলা একটি নতুন নিরীক্ষার নাম। এর পক্ষে-বিপক্ষে এখন পর্যন্ত অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।

https://p.dw.com/p/4ShAc
TV Musik Sendung Coke Studio Pakistan
ছবি: Coke Studio

প্রচুর দর্শক-শ্রোতা বাংলাদেশের নিজস্ব গান ও সংস্কৃতির এই অভিনব ফিউশনকে স্বাগত জানিয়েছেন। অনেকে মনে করছেন যে এই ফিউশন হারিয়ে যাওয়া পুরনো ঐতিহ্যকে নতুন করে এখনকার প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কোক স্টুডিও বাংলার সমালোচনাও হচ্ছে। মোটাদাগে এই সমালোচনাগুলোকে মোটামুটি দু'ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

বাঙালি-অভিজাত-শিক্ষিত-শহুরে-মধ্য/উচ্চবিত্ত-সংস্কৃতিসেবী দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা

কোক স্টুডিও বাংলার এক ধরণের সমালোচনা এসেছে বাংলাদেশের বাঙালি, অভিজাত, শিক্ষিত, শহুরে, উচ্চ/মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিসেবীদের কাছ থেকে। তাঁরা সংস্কৃতির আদি-অকৃত্রিম ভার্সন রক্ষা করার পক্ষপাতী। যেকোন ধরণের নিরীক্ষামূলক ফিউশনকে তাঁরা ধরেন নেন "বিকৃতি” হিসেবে। অতীতে রবীন্দ্র সংগীত এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী গান নিয়ে করা নিরীক্ষাগুলোকে তাঁরা সহজভাবে গ্রহণ করেননি।

এই অভিজাত, উচ্চ/মধ্যবিত্ত, সংস্কৃতিসেবী গোষ্ঠীর বিপক্ষে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাদের যুক্তিগুলো মোটামুটি কোক স্টুডিও বাংলার পক্ষে গিয়েছে। বিপক্ষের যুক্তি বলেছে যে সংস্কৃতি একটি গতিশীল সত্তা। "আদি” এবং "অকৃত্রিম” সংস্কৃতি বলে আসলে কিছু নেই। যে সংগীত কোন ধরণের পরিবর্তন ছাড়া থেমে থাকে, সেই সংগীত একসময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যুগের পরিবর্তনের সাথে মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়। বিশ্বায়নের ফলে নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক উপাদান আমাদের স্থানীয় সংস্কৃতিকে যুক্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক।

এলিট, মধ্য/উচ্চবিত্ত গোষ্ঠীকে "ব্রাম্মণ্যবাদী” আখ্যা দিয়ে অনেকে বলেছেন যে কোক স্টুডিও বাংলা কিন্তু "লোক সংগীত” তৈরি করছে, এমনটা দাবী করেনি। তাই "গেল গেল” রব তোলারও কোন মানে নেই। কোক স্টুডিও বরাবরই বলে এসেছে তারা "ফিউশন” তৈরি করছে। এই ফিউশন গ্রামের সাথে শহরের মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে। পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনকে কিছুটা হলেও রুখে দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্যবাহী গানগুলোর প্রতি আগ্রহী করে তুলছে। প্রান্তিক অবস্থানে থাকা লোকশিল্পীদেরকেও কোক স্টুডিও বাংলার ফিউশন অর্থনৈতিক-সামাজিক নানাধরণের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দিচ্ছে ( আবির ২০২২; চক্রবর্তী ২০২৩)।

Youtube Screenshot Coke Studio Bangla
কোক স্টুডিও বাংলার ইউটিউব চ্যানেলছবি: youtube.com/@CokeStudioBangla

অ্যান্টি-ক্যাপিটালিস্ট, অ্যান্টি কর্পোরেট দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা

এই দৃষ্টিকোণ কোকা-কোলার পুঁজিবাদী আগ্রাসন কীভাবে বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা লোক সংস্কৃতি ও লোকশিল্পীদেরকে পুঁজি করে পণ্য বিক্রি করছে, সেই দিকটি তুলে ধরেছে। বাংলাদেশে ৯৪৮.৩৪ মিলিয়ন ডলারের কোমল পানীয়ের বাজার এখন প্রতিবছরে প্রায় ১০.১৪ শতাংশ হারে বাড়ছে (WMS 2023)। দক্ষিণ এশিয়াতে পেপসিসহ কিছু স্থানীয় কোমল পানীয়ের ব্র্যান্ডের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার উপায় হিসেবে কোকা-কোলা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। পাকিস্তান, ভারত, ব্রাজিলসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে কোকা-কোলা দেখেছে যে তরুণ ভোক্তাদের খুব কাছে

পৌঁছনোর মোক্ষম মাধ্যম হচ্ছে ফিউশন মিউজিক। তাই ভোক্তাকে আকৃষ্ট করে মুনাফা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কোক স্টুডিও তাদের মঞ্চে বিপ্লবী গান, সুফী গান, দেশাত্ববোধক গান, লোক সংগীতসহ সবধরণের গান এবং সবরকমের শিল্পীর সমাগম ঘটিয়েছে (ধানওয়ানি ২০১৪; পারভেজ ২০২২; মহসিন ২০২২; আকাশ ২০২৩)।

এই দু'ধরণের সমালোচনার প্রেক্ষিতে কোক স্টুডিও বাংলার সার্বিক প্রভাবকে বুঝতে হলে কিছু জিনিস আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।

কোকা-কলোনাইজেশান: বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশের অবস্থান

পৃথিবীর দুইশরও বেশি দেশে বর্তমানে কোকা-কোলা ব্যবসা করছে। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা শুরু করে কোকা-কোলা এখন পুঁজিবাদী ব্যবসা সম্প্রসারণের একটি বৈশ্বিক মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে (কোকা-কোলা, কোকা-কোলা বটলিং কোম্পানি ইউনাইটেড)। একদম শুরু থেকেই কোকা-কোলার মার্কেটিং-এর কৌশলগুলো অত্যন্ত আগ্রাসী এবং দীর্ঘমেয়াদী ছিল। কোকা-কোলা্র আমেরিকার ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশান, অ্যাকাডেমি অফ ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ও অ্যাকাডেমি অফ পিড্রিয়াট্রিক্সকে ফান্ড দেয়ার ইতিহাস আছে। কোকা-কোলা যে শরীরের জন্য উপকারী কোন পানীয় নয়, তা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। কোকা-কোলা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবেষকদের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় টাকা ঢেলেছে যাতে করে গবেষকরা তাঁদের গবেষণার প্রতিবেদনে খাদ্যাভাস পরিবর্তনের ওপরে জোর না দিয়ে শরীরচর্চার ওপরে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন (ভক্স ২০১৬)।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, বেশ কিছুদিন ধরে বিশ্বব্যাপী কোকা-কোলার বাজার পড়তির দিকে। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে শ্বেতাঙ্গ, শিক্ষিত, উচ্চ/মধ্যবিত্তরা স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে কোমল পানীয় পান করা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। শ্বেতাঙ্গ, উচ্চ/মধ্যবিত্তদের বাজার হারিয়ে কোকা-কোলা এখন তাদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে অভিবাসী, অশ্বেতাঙ্গ এবং নিম্নবিত্তদেরকে টার্গেট করছে। যেমন আমেরিকায় কোকা-কোলা কৃষাঙ্গ মানুষদের ওপরে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা "ব্ল্যাক লাইফস ম্যাটার” আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছে। একই সাথে এই কোম্পানি এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার জনবহুল দেশগুলোতে মার্কেটিং-এ বিপুল বিনিয়োগ করছে। এরই জের ধরে আমরা লক্ষ্য করি ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে কোকা-কোলা ৭৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তাদের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ শুরু করে। ২০২২ সাল থেকে এদেশে যাত্রা শুরু করে কোকা-কোলার অভিনব মার্কেটিং ক্যাম্পেইন কোক স্টুডিও বাংলা (ডেইলি স্টার ২০১৭)।

কোক স্টুডিও বাংলার প্রতিনিধিত্ব (রিপ্রেজেন্টেশান) বনাম অধিগ্রহণের (অ্যাপ্রোপ্রিয়েশান) রাজনীতি

কোকা-কোলার বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী মার্কেটিং-এর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে কোক স্টুডিও বাংলার সামাজিক প্রভাবকে রোমান্টিসাইজ করার কোন উপায় নেই। অনেকেই কোক-স্টুডিও বাংলার এদেশের প্রান্তিক ও তৃণমূল শিল্পী ও সংস্কৃতিকে রিপ্রেজেন্ট করার ব্যাপারটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন এই রিপ্রেজেন্টেশানে ক্ষমতার সম্পর্কগুলো কীভাবে চর্চিত হয়েছে? এই রিপ্রেজেন্টেশানই কি যথেষ্ট? এই রিপ্রেজেন্টেশান কতটুকু প্রতীকী আর কতটুকু কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে পেরেছে? রিপ্রেজেন্ট করতে গিয়ে কোক স্টুডিও বাংলা কি প্রান্তিক, তৃণমূল, লোকসংস্কৃতিকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট করেছে – অর্থাৎ প্রান্তিক মানুষদের যথাযথ সম্মতি-অংশগ্রহণ ছাড়াই তাদের জীবনের উপকরণগুলো নিজের মত

করে শহুরে তরুণসমাজের কানে শুনতে ভালো লাগবে এমনভাবে পরিবর্তন করে কোকা-কোলা বাজারজাতকরণের কাজে ব্যবহার করেছে?

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে কোক স্টুডিও বাংলা সুন্দরবনের জেলে, কাঠুরিয়া এবং মধুয়ালদের বনবিবির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছে অথবা জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী খনার কৃষিতত্ত্বভিত্তিক বচনগুলোকে রিপ্রেজেন্ট করে মিউজিক কম্পোজিশান করেছে, সেই একই কোম্পানি সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণ ঘটাচ্ছে এবং পানীয় জলের উৎসগুলোকে ধবংস করছে। প্লাস্টিকের ভারে জর্জরিত বাংলাদেশে কোকা-কোলা কোম্পানি চার হাজার ভলান্টিয়ারকে সাথে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে বর্জ্য পরিষ্কার করেছে (ইনক্যাপ ২০২২)। এক লিটার কোকা-কোলা তৈরি করতে প্রায় তিন লিটার খাবার পানির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোকা-কোলার প্ল্যান্টগুলোর আশে-পাশে খাবার পানির সংকট তৈরি হচ্ছে। সেই একই কোকা-কোলা কোম্পানি বাংলাদেশে ওয়াটার এইড, ঢাকা সাউথ সিটি কর্পোরেশান, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশান নিশ্চিতকরণ ও বর্জ্য পরিষ্কারের কাজ করছে (কোকা-কোলা)।

Bangladesch | NafisaTanjeem, Autorin
নাফিসা তানজীম, লেখক, গবেষক ও শিক্ষকছবি: privat

কোক স্টুডিও বাংলার সমর্থনে অনেকক্ষেত্রে যুক্তি দেয়া হচ্ছে যে এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করছে এবং তৃণমূল শিল্পীদেরকে সহায়তা করছে। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে কোক স্টুডিও বাংলা কোন "বিশুদ্ধ” সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করছে না। এটি বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পুনর্নিমাণ করছে। যে গান বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে-বনে-বাদাড়ে-দরগায়-নৌকা বাইচের আসরে পরিবেশন করা হতো, সেই গান যখন অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন স্টুডিওতে তুলে এনে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করা হয়, তখন সেটা হয়ে যায় একটি অত্যন্ত সাবধানে কিউরেট করা কাল্পনিক হেরিটেজ বা ঐতিহ্য। হ্যাঁ, যুক্তি দেয়া যেতে পারে যে সব হেরিটেজই তাহলে কাল্পনিক। আদিম ও অকৃত্রিম হেরিটেজ বলে আসলে কিছু নেই। হ্যাঁ, এই দাবীটি সত্য। এখানেই চলে আসে ক্ষমতার প্রশ্ন। হেরিটেজকে কিউরেট করার ক্ষমতাটি আসলে কার কাছে আছে?

শায়ান চৌধুরী অর্ণব বা প্রীতম হাসানের মত প্রথিতযশা মিউজিক ডিরেক্টরদের সাথে একজন ইসলাম উদ্দিন পালাকার, একজন অনিমেষ রায় বা একজন আলেয়া বেগমের ক্ষমতার ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। এই ক্ষমতার পার্থক্য তাঁদের শ্রেণী পরিচয়, লিঙ্গ পরিচয়, জাতিগত পরিচয় এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক পুঁজির সাথে নৈকট্যের ধরণ দিয়ে নির্ধারিত হয়। প্রীতম হাসান "দেওরা” গানটির একটি "বিহাইন্ড দ্যা ম্যাজিক” সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তিনি ফজলু মাঝির গান তাঁকে কোন কৃতিত্ব না দিয়ে বা তাঁকে পরিবেশনায় অন্তর্ভুক্ত না করে ব্যবহার করতে চাননি। তিনি বলেছেন কীভাবে তিনি শুধু ফজলু মাঝির কাজকে ব্যবহার করেননি, বরং তাঁর সাথে একটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করেছেন।

প্রীতমের বক্তব্যটিতে কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশান পরিহার করার ব্যাপারটি – অর্থাৎ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রথা ও সংস্কৃতিকে কোনধরণের কৃতিত্ব না দিয়ে কুক্ষিগত না করার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। প্রীতমের এই অবস্থান কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম সিজনের "প্রার্থনা” গানটির অবস্থানের চেয়ে ভিন্ন। "প্রার্থনা” কম্পোজিশানটিতে মাইজভান্ডারি ট্র্যাডিশানের "বাবা মাওলানা” গানটির লিড ভোকাল ছিলেন মিজান রহমান। মিজান মাইজভান্ডারি ট্রাডিশানের ভেতরের মানুষ নন। কিন্তু দ্বিতীয় সিজনেই প্রীতমের অ্যাপ্রচে আমরা একটি ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করি।

কিন্তু একজন সচেতন ব্যক্তি প্রীতমের পক্ষে কোক স্টুডিও বাংলার আগ্রাসী কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশানের খোল-নলচে বদলে দেয়া সম্ভব নয়। প্রীতম ফজলু মাঝির সাথে তাঁর ক্ষমতার সম্পর্কের ব্যাপারে সচেতন থাকলেও ফজলু মাঝি এবং তাঁর দলটিকে পারফর্ম করতে হয়েছে লুঙ্গির সাথে চামড়ার বেল্ট এবং সাদা স্নিকার পরে। বলা বাহুল্য, গ্রামবাংলার মাঝির পক্ষে সাদা রঙের স্নিকার পায়ে দিয়ে কাদা-পানির মধ্যে কাজ করাটা কোনভাবেই প্র্যাকটিক্যাল নয়।

এখানেই চলে আসে রিপ্রেজেন্টেশান (বিশেষ করে প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব) বনাম কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশানের প্রশ্নটি। আমাদের হারিয়ে যাওয়া লোকগান, শিল্পী, ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বের দরকার আছে কিনা? অবশ্যই আছে। এই কারণেই অনেকে বলছেন যে তৃণমূল পর্যায়ের এই শিল্পীদের পক্ষে আমাদের কর্পোরেট, পুঁজিবাদী মিউজিক ইন্ড্রাস্ট্রিতে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা অসম্ভব। কোক স্টুডিও বাংলা এই অসম্ভবকে সম্ভব করে কর্পোরেট স্পন্সরশিপ দিয়ে তাঁদের কাজগুলোকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরছে, নতুন প্রজন্মের মাঝে তাদের শ্রোতা তৈরি করছে - যেটা আর কেউ করেনি। কিন্তু স্পন্সরশিপের এই সুবিধা কতজন পাচ্ছেন? হাতে-গোনা চরম সৌভাগ্যবান কিছু প্রান্তিক শিল্পী যাঁরা কোন না কোনভাবে কোক স্টুডিও বাংলার নজরে পড়েছেন। গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শিল্পীরা কিন্তু এই টপ-ডাউন উদ্যোগ থেকে তেমনভাবে লাভবান হচ্ছেন না।

একজন প্রীতম হাসান যখন কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশানের কথা মাথায় রেখে ফজলু মাঝির কাজকে সম্মান জানিয়ে তাঁকে পারফর্মেন্সে অন্তর্ভুক্ত করেন, একজন অনিমেষ রায় যখন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বৃহত্তর পরিসরে উপস্থাপিত হাজং ভাষার প্রথম গানগুলো লেখেন এবং পরিবেশনা করেন, একজন ইসলাম উদ্দিন পালাকার যখন নারী-পুরুষের বাঁধা-ধরা পারফর্মেন্স ভেঙে গোলাপি লেহেঙ্গায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জেন্ডার ফ্লুয়িড পালাগান পরিবেশন করেন, একজন সোহানা রহমান যখন হিজাব পরে বাংলাদেশের হাতে গোণা নারী র‍্যাপারদের একজন হিসেবে আবির্ভূত হন, একজন যন্ত্রবাদক যখন "অ্যাননিমাস”-এর মত একটি বিপ্লবী, প্রতিষ্ঠানবিরোধী সংস্থার মুখোশের ছবি আঁকা গিটার বাজান অথবা আরেকজন যন্ত্রবাদক যখন হাতে প্রাইডের সাত রঙ্গা ব্যান্ড পরে কোক স্টুডিও বাংলার মঞ্চে সবধরণের ভালোবাসার স্বীকৃতির দাবীর নীরব কিন্তু চরম সাহসী রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট দেন – এই ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলো আমাদের সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের সংকেত দেয়।

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে কোক স্টুডিও চাইবে এই সাহসী, প্রথা ভাঙ্গা কাজগুলোর কৃতিত্ব দাবী করতে। এই কৃতিত্বকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট করে এবং বাজারজাত করে কোকা-কোলা বিক্রি করতে। কোন কৃতিত্বই কোক স্টুডিওর বা কোকা-কোলার নয়। তারা কিছু প্রগতিশীল মানুষকে তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে দিয়েছে কারণ প্রগতিশীল ব্র্যান্ড হিসেবে কোকা-কোলাকে পরিচিত করতে পারলে শহুরে, প্রগতিশীল, তরুণ ভোক্তাসমাজের কাছে যাওয়া সম্ভব।

আমাদের এটাও মনে রাখা দরকার যে আজকে কোক স্টুডিও বাংলার কারণে আমরা কোকা-কোলার সমালোচনা করছি। পেপসিসহ আমাদের স্থানীয় কর্পোরেট কোমল পানীয়ের ব্র্যান্ডগুলোও কিন্তু একই ভাবে মানুষের স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে।

পরিশেষে তাই বলা যায়, কোক স্টুডিও বাংলা আমাদের এখনকার প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু তর্ক-বিতর্ক-আলোচনা-সমালোচনা সামনে তুলে আনছে। আমরা কোক স্টুডিও বাংলাকে পছন্দ বা অপছন্দ করতে পারি। কিন্তু কোক স্টুডিও বাংলাকে উপেক্ষা করা আমাদের জন্য কঠিন। তাই এই আলোচনা-সমালোচনাগুলো চালিয়ে যেতে পারলে আমাদের পক্ষে হয়তোবা নতুন দিনের সমাজবদলের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা পাওয়া সম্ভব হবে।