1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ক্ষমতার লড়াইয়ে চরমপন্থা কী?

৩০ এপ্রিল ২০১৯

চরমপন্থা কী? বাম কী? বিপ্লব কী? কখনও কি ভেবেছেন, পুরোটাই ক্ষমতার লড়াইয়ে হার-জিতের ওপর নির্ভর করে কিনা? আজ যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী, লড়াইয়ে জিতলে তারাই মুক্তিযোদ্ধা হবেন না, এর নিশ্চয়তা কী?

https://p.dw.com/p/3Hcvf
ছবি: picture alliance/Luisa Ricciarini/Leemage

ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে প্রথম ব্যবহার শুরু হয় রাজনৈতিক টার্ম হিসেবে ‘বাম' শব্দের ব্যবহার৷ কিন্তু এখন মূলত সমাজতন্ত্রের সমর্থকদের এক কাতারে ফেলে ব্যবহার করা হয় বামপন্থি শব্দবন্ধটি৷

১৭৮৯ সালে রাজা ষোড়শ লুইকে সরিয়ে ফরাসি রিপাবলিক গঠনের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় গঠন করা হয় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি৷ রাজার ক্ষমতা কতটুকু হবে, সে নিয়ে ছিল আলোচনা৷

অ্যাসেম্বলিতে বিপ্লবের সমর্থকরা বসতেন সভাপতির বাম দিকে৷ অন্যদিকে রাজার সমর্থকরা বসতেন ডান দিকে৷ সে থেকেই এস্ট্যাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ব্যক্তি, গোষ্ঠি ও দলকে বামপন্থি নামে অভিহিত করা শুরু হয়৷

কিন্তু আমার লেখা বামপন্থিদের নিয়ে নয়, বরং চরমপন্থা নিয়ে৷ সেক্ষেত্রেও আলোচনায় আসে ফরাসি বিপ্লব৷

মানুষ স্বভাবগতভাবেই জেনারালাইজ করতে খুব ভালোবাসে৷ যে কোনো কিছুকে ট্যাগ দিয়ে একটি গোষ্ঠিবদ্ধ করাটাই আমাদের প্রকৃতি৷ ফলে হোন্ডা একটি ব্র্যান্ডের নাম হলেও, আমরা সব কোম্পানির মোটরসাইকেলকেই হোন্ডা বলে ডাকি, বাসায় টয়লেট ক্লিনার যে কোম্পানিরই হোক, সেটাকে আমরা হারপিক মনে করি৷

একইভাবে, রাজনীতি, উদ্দেশ্য, কর্মকাণ্ড যাই হোক না কেনো, সমাজতান্ত্রিক ‘নামধারী' দলগুলোকে খুব সহজেই আমরা ‘বাম' বলে চিহ্নিত করি৷ অন্য সব দলগুলোকে অবশ্য আমরা ‘ডান' বলতে রাজি না৷

একইভাবে, জঙ্গি বলতে আমরা ‘ইসলামি' বুঝি, চরমপন্থি বলতে আমরা ‘পেকিংপন্থি' সশস্ত্র দলগুলোকে বুঝি, ‘পাহাড়ি' বলতে আমরা দেশের সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিকে বুঝি৷

আবারও ফিরে যাই ফরাসি বিপ্লবে৷ মূলত অর্থনৈতিক সংকটই ছিল ফরাসি বিল্পব শুরু কারণ৷ ফরাসি সমাজ ছিল তিন ভাগে বিভক্ত, এই ভাগগুলোকে বলা হতো একেকটি ‘এস্টেট'৷ রাজা ছিলেন প্রথম এস্টেট, ধনী, প্রভাবশালী অভিজাত ব্যক্তিরা ছিলেন দ্বিতীয় এস্টেট, আর সমাজের সবচেয়ে বড় কিন্তু গরিব অংশটি ছিল তৃতীয় এস্টেট৷

সমাজব্যবস্থা এমন ছিল, উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদের মালিক না হলে, কারো পক্ষে এক এস্টেট থেকে অন্য এস্টেটে নিজের উত্তরণের কোনো উপায় ছিল না৷ ফলে সমাজের সবচেয়ে বড় অংশ হয়েও সব দুর্দশা ভোগ করতে হতো তাঁদেরই৷ এমনকি, রাজার পরিবার ও অভিজাতদের কোনো কর দিতে না হলেও, জনগণকে সব বোঝা বহণ করতে হতো৷

এক পর্যায়ে অর্থনৈতিক দুরবস্থা এতটাই অসহনীয় হয়, এক টুকরো রুটির দাম পৌঁছায় এক সপ্তাহের বেতনের সমান দামে৷ তবে তখনও থেমে থাকেনি রাজপরিবারের ভোগবিলাস৷

রানি মারি আঁতোয়ানেত নাকি তখন বলেছিলেন – রুটি খেতে না পারলে ওরা কেক খায় না কেন? এ কথা আসলেই রানি বলেছিলেন কিনা, তা নিয়ে অবশ্য ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত নন৷ কিন্তু ক্ষমতায় থাকা রাজা-রানির পক্ষে যে জনগণের দুর্দশা বোঝা আসলেই কতটা কষ্টকর, সে বিষয়ে তো একটা ধারণা পাওয়াই যায়৷

১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই, কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে ফরাসি জনতা৷ সূত্রপাত হয় ফরাসি বিপ্লবের৷ মানুষ এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল, খালি হাতে ইট খুলে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয় পুরো দুর্গ৷

এরপর শুরু হয় সহিংস এক পরিস্থিতি৷ বিপ্লবের প্রতি আনুগত্য নেই, রাজাকে আবার ক্ষমতায় ফেরাতে চাইছে, এমন সন্দেহ হলেই তাকে দেয়া হতো মৃত্যুদণ্ড৷ শিরোশ্ছেদের যন্ত্র গিলোটিন তখন পেয়েছিল রাষ্ট্রীয় নিধনযন্ত্রের মর্যাদা৷ ইতিহাসে এই পর্যায়কে ‘রেইন অফ টেরর' বা ‘আতঙ্কের রাজত্ব' বলে অভিহিত করা হয়৷

আমরা চরমপন্থা কাকে বলবো? ক্ষুব্ধ প্রজারা যখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে কারাগার লুট করছিল, অস্ত্র লুট করছিল, রাজপরিবারকে আক্রমণ করছিল, সেটাই চরমপন্থা? কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে প্রজারা যখন না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছিল, সেটা দেখার দায়িত্বটা ছিল কার? পরবর্তীতে বিপ্লবীদের মতভেদের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় বসেন নেপোলিয়ন বোনাপার্তে৷ অবসান ঘটে ফরাসি রিপাবলিকের৷

সমাজে মূলত চার ধরনের মানুষ থাকেন – ১) যাঁদের হাতে থাকে সম্পদ ও ক্ষমতা, চাইলেই সমাজ পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন এঁরা, ২) যাঁরা প্রচণ্ড কষ্টেও চুপচাপ সবকিছু মেনে কোনো রকমে জীবন পারে করে দিতে চান, ৩) যাঁরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন, নিজের তোয়াক্কা না করে সবকিছু পালটে ফেলার স্বপ্ন দেখেন, এবং ৪) যাঁরা ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১, ২ ও ৩ কে সুবিধামতো ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করতে চান৷

ফরাসি বিপ্লবে ১ নং অবস্থানে থেকেও রাজা-রানি, বা অভিজাতরা কখনই ২ এবং ৩ নম্বরে থাকাদের পরিস্থিতি বুঝতে চাননি৷ এটা ২ নম্বরে বাস করা অসহায় মানুষ দীর্ঘদিন সহ্য করে গেলেও মানতে চাননি ৩ নম্বরে থাকারা৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিটি বিল্পবেই মতোই ৪ নম্বরের কাছেই হারাতে হয় সব সুফল৷

ইতিহাসের এ পুনরাবৃত্তি বরাবরই হয়েছে৷ বাংলাদেশও এর বাইরে নয়৷ ১৯৪৭-১৯৭১, কখনই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাঙ্গালিদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে সচেষ্ট হয়নি, বরং নিজেদের মত চাপিয়ে দিতে চেয়েছে৷ দীর্ঘদিন অসহায় মানুষ তা সহ্য করলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ রূপ নেয় সশস্ত্র যুদ্ধে, স্বাধীন হয় বাংলাদেশ৷

HA Asien | Anupam Deb Kanunjna
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

কিন্তু নচিকেতার গান – ‘ইটস এ গেম' অনেকেরই শোনা৷ গানটির একটি লাইন এরকম – রাম যদি হেরে যেত, রামায়ণ লেখা হতো, রাবণ দেবতা হতো সেখানে৷ কোনো কারণে বাংলাদেশ যদি হেরে যেত, পাকিস্তান জিতে যেত, স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গাদ্দার' পরিচয়টি হয়ত ‘পূর্ব পাকিস্তানেও' স্কুলের পাঠ্য হয়েই থাকত৷

গণতন্ত্রকে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপরিচালনার সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা বলে যুক্তি দিয়ে থাকেন অনেকে৷ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে উদার গণতন্ত্রের ধারণাও জনপ্রিয় বেশ কিছুদিন ধরেই, উদার গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত সংখ্যালঘুর ওপর চাপিয়ে না দিয়ে সবার মতের গুরুত্বই দেয়া হয়৷

কিন্তু তাতেও কি আসলে সবার মত গুরুত্ব পায়? পায় না৷ কোটি কোটি মানুষের সবার মত সমান গুরুত্ব দেয়া কোনোমতেই সম্ভব না৷ কিন্তু অন্তত এই বোধটা জাগ্রত করা সম্ভব, রাষ্ট্র আপনার দুঃখ-দুর্দশা, আপনার মত, আপনার অধিকার প্রকাশে সমান সুযোগ নিশ্চিত করে

জঙ্গি বা চরমপন্থিদের আত্মসমর্পণের পর পুনর্বাসনের চিন্তা না করে, তাঁদের যাতে সে পথে যেতে না হয়, বা কেউ স্বার্থ হাসিলে সেদিকে নিয়ে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থা করুন৷

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবার মত নির্ভয়ে প্রকাশের ব্যবস্থা করুন৷ পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, সব জায়গায় যাতে একে অপরের মতকে আমরা শ্রদ্ধা করতে শিখি, সে নীতি শিশুকাল থেকে চর্চার মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করুন, নিজেরাও চর্চা করুন৷ অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনায় ‘বন্দুকযুদ্ধ', ‘ক্রসফায়ার', ‘আত্মসমর্পণ', ‘পুনর্বাসন' শব্দগুলো শুনতে ভালো লাগলেও, তাতে দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান সম্ভব নয়৷

আবার ফরাসি বিপ্লবের দু'টো তথ্য দিয়েই শেষ করি৷

- ফ্রান্স ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় রাজা ষোড়শ লুই ও রানি মারি আঁতোয়ানেতকে গ্রেপ্তার করে বিপ্লবীরা৷ গিলোটিনের কথা আগেই বলেছি৷ এই গিলোটিন যাতে আরো কর্মক্ষম হয়, সেজন্য রাজা লুই ত্রিকোণাকৃতির ধারালো ব্লেড লাগাতে বলেছিলেন৷ দুঃখজনক হলেও সত্য, ফরাসি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সেই গিলোটিনেই রাজা ষোড়শ লুই ও তাঁর স্ত্রী রানি মারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ গিলোটিন দিয়ে চরমপন্থা সাময়িক দমন সম্ভব, নির্মূল সম্ভব নয়৷

- মৃত্যুর আগে রানি মারির সবশেষ কথা ছিল, ‘আমি দুঃখিত'৷ তবে তিনি সেটা প্রজাদের উদ্দেশ্য করে বলেননি৷ যারা তাঁকে গিলোটিনে চড়াতে নিয়ে এসেছে, তাঁদের একজনের পায়ের ওপর উঠে যাওয়ায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন৷ অথচ প্রজাদের দুঃখ সঠিক সময়ে বুঝে দুঃখ পেলে তাঁকে হয়তো ব্যথাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করতে গিলোটিনে ধারালো ব্লেড লাগানোর জন্য ৫০টি স্বর্ণমুদ্রা ঘুস দিতে হতো না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান