1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গণপরিবহনে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়ানো’

মাসুম বিল্লাহ
২৫ এপ্রিল ২০১৯

প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় বলে গণপরিবহনে যাতায়াত বাংলাদেশের নারীদের জন্য রীতিমতো আতঙ্কের বিষয়৷ চিমটি কাটা, গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, চুল বা শরীরের কোনো অংশ স্পর্শ গণপরিবহনে নিয়মিত ঘটনা৷

https://p.dw.com/p/3HOKQ
Bangladesch Dhaka - Gedränge im Bus
ছবি: DW/M. R. Rahman

নারীদের চলাচল নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যাচ্ছে সেসব উদ্যোগ৷ এমতাবস্থায় সম্প্রতি ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না' নামের সামাজিক ক্যাম্পেইন বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷

বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে বাসে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করলে পুনরায় হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ প্রতিবাদী নারীকেই ‘টার্গেট' করার এই প্রবণতাকে ভয়াবহ হিসাবে বর্ণনা করেছেন নারী অধিকার কর্মী খুশী কবির৷ 

‘সমাধান হলো সমাজে দৃষ্টিভিঙ্গিটা পাল্টানো’

বিশ্বব্যাপী ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং' ক্যাম্পেইনের এই বাংলাদেশ সমন্বয়ক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সকল নারীই হয়রানির শিকার হয়েছে৷ একশ ভাগ, আমি বলব৷ প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁকে নিপীড়নের শিকার হতে হয় এবং ধর্ষণের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টগুলোতে৷ সেটা কিন্তু ভয়াবহ অবস্থা৷''

২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন৷ হয়রানির ভয়ে ১৩ শতাংশ নারী পাবলিক বাস এড়িয়ে চলেন বলে ২০১৬ সালের আরেকটি গবেষণায় উঠে এসেছে৷

বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও নারীদের ‘যৌনবস্তুতে' পরিণত করার কারণে হয়রানি বেড়ে চলেছে বলে মনে করেন নারীনেত্রী খুশী কবির৷ ‘‘বাংলাদেশে যে মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছে– নারী হচ্ছে একটা যৌনবস্তু, সে বাইরে কাজে যাচ্ছে, ঘুরছে, হাঁটছে, একজন নাগরিক হিসাবে, একজন মানুষ হিসাবে তার যে অধিকার আছে, তারা মনে করে যে এটা করা ঠিক না৷ যে-কোনো পুরুষের মাথার মধ্যেই (এটা) ঢুকানো হচ্ছে,'' ডয়চে ভেলেক বলেন তিনি৷
‘‘এটা হচ্ছে এ কারণে যে, এদেরকে ধরা হয় না৷ এদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়া হয় না, আমাদের যে ধরনের সংস্কৃতি চলে আসছে, পার পেয়ে যাওয়ার একটা অপসংস্কৃতি শুরু হয়েছে৷''

মানসিকতার পরিবর্তনের পাশাপাশি কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি সংস্থা ‘নিজেরা করি'র প্রধান খুশী কবির৷ গণপরিবহনে যৌন হয়রানি রোধে গণপরিবহনে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি চালক-হেলপার ও বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি৷ 

‘‘সমাধান হলো দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো৷ আমি যেটা মনে করি, শুধু ৯৯৯ ফোন করা না, এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা উচিত৷ পুলিশকে ফোন করার পর বাসের কন্ডাক্টর, বাস ড্রাইভার ও বাসের হেলপার এই তিনজনকে যদি শাস্তি দেওয়া হয়, তোমার বাসের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কেন এবং তুমি কেন নামাওনি?'' 

‘গা ঘেঁষে দাড়াবেন না'

বাংলাদেশে গণপরিবহনে যৌন হয়রানির ভয়াবহতার মধ্যে সম্প্রতি ‘গা ঘেঁষে দাড়াবেন না' লেখা টি-শার্ট বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷ সচেতনতার জন্য এই উদ্যোগকে বিকৃত করে প্রচারের চেষ্টা চালান কেউ কেউ৷

পহেলা বৈশাখে ‘গা ঘেঁষে দাড়াবেন না' লেখা ওই টি-শার্ট বাজারে আনে ঢাকার একটি ইন্টারনেটভিত্তিক নারীদের পোশাক ও অলঙ্কার তৈরির প্রতিষ্ঠান বিজেন্স৷ টি-শার্টটির ডিজাইনও করেন ওই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জিনাত জাহান নিশা৷

বাসে নিজে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর এমন একটি ক্যাম্পেইন চালানোর চিন্তা মাথায় আসার কথা জানান জিনাত জাহান৷ এর আগের বছর একই লেখা দিয়ে ডিজাইন করা চুলের কাঁটা বাজারে ছেড়ে ওই ক্যাম্পেইন শুরু করার কথা জানিয়েছেন তিনি৷

নিজে হেনস্থার শিকার হওয়ার বর্ণনা দিয়ে জিনাত জাহান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি একজন বয়স্ক লোকের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলাম৷ কিন্তু বাসভর্তি লোকজন চুপ ছিল৷ তারা উল্টো আমাকে থামাতে চাইলেন৷ উনি বয়স্ক লোক৷ আমাকে দোষারোপ করতে শুরু করলেন, যেন অপরাধটি আমার৷

‘‘আমি প্রতিবাদ করেছিলাম বলে আমার উপর চড়াও হলেন সবাই৷ এরপর আমি নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে এটা শুরু করি৷ এর মধ্যে ব্যবসায়িক কারণের চেয়ে সচেতনতা বাড়ানোই ছিল মুখ্য৷''

প্রতিনিয়ত এভাবেই যৌন নিপীড়কদেরকে অন্যরা সহায়তা করে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷ ‘‘গা সয়ে যাচ্ছে সবার৷ প্রতিবাদের জায়গাটা তৈরি হোক, আমি সেটাই চেয়েছিলাম, যেন সবার বিবেক জাগ্রত হয়৷ যারা ভিকটিম, কেবল তাঁরা নয়, যাঁরা সেখানে আছে, সবার মুখ খোলা দরকার,'' বলেন জিনাত৷

‘‘এর বিরোধিতা করছেন তারাই, যারা বাসের মধ্যে সুযোগ পেলেই যৌন হয়রানি করছেন৷ তারা বলতে চাচ্ছেন, আমরা ব্যবসা করার জন্য এটা করেছি৷ ব্যবসা করার জন্য আরো অনেক কিছু করার আছে৷'' 

কাজে দিচ্ছে না ‘মহিলা বাস সার্ভিস'

রাজধানী ঢাকার রাস্তায় বাসের জন্য নারীদের অপেক্ষা আর দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায় হরহামেশা৷ দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর বাস পেলেও ভীড়ের কারণে ঠেলাঠেলিই তাঁদের নিত্যসঙ্গী৷ তার সঙ্গে যোগ হয় যৌন হয়রানি৷

ঢাকা শহরের কর্মজীবি নারীদের জন্য কয়েক বছর আগে ‘মহিলা বাস সার্ভিস' চালু হলেও সেটা নারীদের জন্য তেমন সুফল বয়ে আনছে না৷ ১৫টি রুটে এমন ১৭টি বাস চলছে, যা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন কর্মজীবী নারীরা৷ 

একবারই বিশেষ ওই বাসে চলাচলের সুযোগ হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী কাজী নাফিয়া রহমানের৷ চলাচলে সুবিধা থাকলেও বাস পেতে মুশকিলের কারণে আর তাতে ওঠেন না বলে জানিয়েছন তিনি৷ 

‘শুধু আইন করলে হবে না, আইনের বাস্তবায়ন হোক’

নাফিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই বাস সার্ভিস ভালো৷ চালক আর হেলপারও নারী৷ তবে সহজে পাওয়া যায় না এসব বাস৷ এগুলোর সংখ্যা এত কম যে, দেখা যায়, এক সপ্তাহে আমি একটা বাস পাচ্ছি৷ সে কারণে অন্য পরিবহনে যেতে হয়৷ সেখানে ধাক্কাধাক্কির কারণে এখন রাইড শেয়ারিংয়ের বাইকের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে৷''

পুরুষদের দখলে নারী আসন

২০০৮ সালে গণপরিবহনে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিধান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷ সেই সময় নারীদের জন্য ৩০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের বিধান করা হলেও পরে বড় বাসে ৯টি এবং মিনিবাসে ছয়টি আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত হয়৷

কিন্তু বাসগুলোতে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখলেও সেটা তাঁদের জন্য আর থাকছে না বলে জানিয়েছেন অনেকে৷ বেশিরভাগ সময়েই সেই আসনগুলো পুরুষ যাত্রীদের দখলে থাকছে৷ তাছাড়া সিটিং সার্ভিসের নামে চলা বাসগুলোতে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই৷

মিরপুর থেকে মহাখালীতে নিয়মিত যাতায়াত করেন কাজী নাফিয়া রহমান৷ সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন দুয়েকটা বাস বাদে বাকিগুলোতে মহিলা সিট নাই৷ লেখা আছে ঠিক, কিন্তু এটা আগের বিষয়৷

বিআরটিসির বা সরকারি বাসে বসা যায়৷ পুরুষ বসলে মহিলা আসলে উঠিয়ে দেওয়া হয়৷ যে বাসে মহিলা সিট রাখা হয়, সেখানেতো উঠাই যায় না৷''

এদিকে বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত আসনে কেউ বসলে বা তাদের বসতে দিলে এক মাসের কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাসহ আরো শাস্তির কিছু বিধান যুক্ত করে গত অক্টোবের সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাস হয়েছে জাতীয় সংসদে৷

নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ এবং আলাদা বাসের বিষয়ে এক প্রশ্নে নারীনেত্রী খুশী কবির বলেন, ‘‘উদ্যোগ ভালো৷ উদ্যোগ তো সমাধান না, এখানে আসল সমস্যা অ্যাড্রেস করছে না৷ যেখানে সমাজে পুরুষদের মানসিকতা আর চিন্তাটা এই ধরনের, সেখানে নারীদেরকে আবার আলাদা করে রাখা, সে যেন স্বচ্ছন্দে যেতে পারে, এটা তো সমাধান হতে পারে না৷ সমাধান হলো সমাজে দৃষ্টিভিঙ্গিটা পাল্টানো৷''

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী কাজী নাফিয়া বলেন, ‘‘মহিলা সিটে কেউ বসলে জরিমানা হবে বলে আইন হয়েছে৷ কিন্তু সরকারিভাবে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা তো নেই৷ শুধু আইন করলে হবে না, আইনের বাস্তবায়ন হোক৷'' 

‘যদি মামলা হয়, গ্রেপ্তার হয়, সেসবেরও কিন্তু আমরা আপডেট পাই’

৯৯৯ দিতে পারে সমাধান

বাংলাদেশে জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে গণপরিবহনে যৌন হয়রানির প্রতিকার চাইতে পারেন নারীরা৷ সেক্ষেত্রে নিকটস্থ থানার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানাচ্ছেন ৯৯৯-এর কার্যক্রম দেখভালকারী বিশেষ পুলিশ সুপার তবারক উল্লাহ৷ জরুরি নম্বরে ফোন করে যৌন হয়রানির প্রতিকার পাওয়ার ঘটনাও বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় সংবাদের শিরোনাম হয়েছে৷

জরুরি সেবা চালুর দেড় বছরে গণপরিবহনে যৌন হয়রানির মোট অভিযোগের সুস্পষ্ট সংখ্যা জানাতে না পারলেও এ ধরনের অভিযোগকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় বলে দাবি করেছেন তিনি৷ ‘‘যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের যে কোনো ঘটনার কলই আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখি৷ আমাদের প্রতি নির্দেশই আছে, অত্যন্ত জরুরিভাবে এবং কাল বিলম্ব না করে খুব সেনসিটিভলি যাতে আমরা বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করি৷ সেক্ষেত্রে কেউ যদি এই রকম কল করে, প্রথমেই আমরা সংশ্লিষ্ট থানার সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টা জানাই এবং থানার হেল্প নিয়ে তাঁকে কীভাবে সেবাটি দেওয়া যায়, সে চেষ্টা করে থাকি,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তবারক উল্লাহ৷

তিনি বলেন, ‘‘এখানে কল টেকার থেকে ডেসপাচারের কাছে হ্যান্ডওভার করা হয়৷ এ ধরনের সেনসিটিভ ইস্যুগুলো যতক্ষণ নিষ্পত্তি না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ডেসপাচার আপডেট নিতে থাকেন৷ যদি মামলা হয়, গ্রেপ্তার হয়, সেসবেরও কিন্তু আমরা আপডেট পাই৷ সর্বশেষ আপডেট পাওয়ার পরই আমাদের সেই কেইসটি ক্লোজ করতে হয়৷ এর আগে সেখান থেকে ব্যাক করার সুযোগ নেই৷''

এ উদ্যোগকে কার্যকর করতে পুলিশকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, ‘‘যদি এটা বাধ্যতামূলক হয়, পুলিশ তার কাজ সত্যিকারভাবে করে, (তাহলে) বাসে হয়রানির শিকার হলে সে যদি কমপ্লেইন করে আর ওই (অভিযুক্ত) যাত্রীকে যদি না নামিয়ে দেয়, তাহলে ওই বাসের কোম্পানি, ড্রাইভার, তাদের সবাইকে ফাইন করা উচিত এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত৷''