1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জার্মানিতে হেট স্পিচ ইতিহাসের অঙ্গ

২৭ মার্চ ২০১৮

‘হেট স্পিচ' কথাটার অর্থ যদি ‘বিদ্বেষমূলক ভাষণ' হয়, তবে জার্মানির মতো পশ্চিমা বিশ্বের বহু দেশে তা রোখা নিয়ে যতটা মাথা ঘামানো হচ্ছে, ‘ভাষণের' মূলে যে ‘বিদ্বেষ' রয়েছে, তার কার্যকারণ নিয়ে ততটা মাথা ঘামানো হচ্ছে না৷

https://p.dw.com/p/2ulvY
ছবি: picture alliance/dpa/S. Stache

জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালে জার্মানিতে অন্তত ৯৫০টি মুসলিম বিরোধী অপরাধের ঘটনা ঘটেছে৷ মুসলিম অধিবাসী অথবা মসজিদের উপর আক্রমণ ও মসজিদের দেয়ালে নাৎসি স্বস্তিকা আঁকা ও গালিগালাজ লেখা ছাড়া বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে হুমকির চিঠি পাঠানো হয়েছে৷ সেই সঙ্গে রয়েছে তথাকথিত ‘হেট স্পিচ'৷

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে ‘ইসলামীকরণের' বিরুদ্ধে ৯০টি বিক্ষোভ সমাবেশ অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু অভিবাসন বিরোধী ‘পেগিডা' গোষ্ঠীর মিছিলগুলি বাদ৷ তার কারণ কি এই যে, ‘পেগিডা'-র কার্যকলাপ অন্তত পরোক্ষভাবে ইসলাম তথা মুসলিম বিরোধী হলেও, সেগুলি ‘অপরাধ' হিসেবে গণ্য নয়? এভাবে দেখলে পর্যায়ক্রম দাঁড়ায়: সবার আগে পরিসংখ্যান, প্রেস ও পাবলিক যা চায়; তার পর আসে ‘অপরাধ' ও তার আইনগত কুটকচালি; সবার শেষে আসে ইসলাম তথা মুসলিম বিদ্বেষ – যা কিন্তু যাবতীয় এ ধরণের ‘অপরাধ' ও সেই সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের মূলে৷

বিদ্বেষের আবহাওয়া

বর্তমান জার্মান সংসদে উগ্র দক্ষিণপন্থি এএফডি দলের ৯২ জন বিধায়ক আসন গ্রহণ করেছেন, যা অবশ্যই সংসদীয় গণতন্ত্রের অঙ্গ৷ কিন্তু তার ফলে জার্মানিতে ‘বিদ্বেষের' আবহাওয়া যেন এক ধরণের আনুষ্ঠানিক ও প্রতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে, যার ফল ও ফলশ্রুতি সুদূরপ্রসারী হতে পারে৷ এ বিষয়ে বিরোধী বামদলের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উলা ইয়েল্পকের একটি মন্তব্য অনুধাবনযোগ্য: ‘‘ইসলাম বিদ্বেষিরা এখন রাজপথ থেকে সংসদে ঢুকে পড়েছেন ও জার্মানিতে মুসলিম জনজীবন সম্পর্কে সংসদের বক্তৃতামঞ্চ থেকে দেশের সামাজিক আবহাওয়া বিষাক্ত করে তুলছেন৷''

ইয়েল্পকের মন্তব্যের একটি অর্থ করা যেতে পারে যে, ইসলাম বিদ্বেষী ভাষণ না হলেও, ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব এখন জার্মান সংসদে জায়গা করে নিয়েছে৷

হেট স্পিট বিরোধী আইন

হেট স্পিচ বলতে যে শুধু ইসলামবিদ্বেষ বোঝায় না, তা আমরা সকলেই জানি, যেমন আমরা জানি যে, বিদ্বেষ, বিরোধ ও সংঘাত মানবজীবন ও মানব (অ)সভ্যতার অঙ্গ৷ এবং যেহেতু হেট স্পিচ প্রসঙ্গে ইতিমধ্যেই সংসদের বক্তৃতামঞ্চের কথা এসে পড়েছে, সেহেতু এবার নজর দেওয়া দরকার, হেট স্পিচ-এর কর্মক্ষেত্র ও পরিধি আজ ঠিক কোথায় ও কিভাবে বেড়েছে৷ এক্ষেত্রে প্রথমেই আসবে সোশ্যাল মিডিয়া৷ জার্মানিতে গত শুভ নববর্ষে একটি আনকোরা নতুন অনলাইন হেট স্পিচ বিরোধী আইন চালু হয়েছে, যার মূল সূত্র হলো, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলিকে রিপোর্ট করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপত্তিকর বা বিদ্বেষমূলক পোস্টগুলি অপসারণ করতে হবে৷ সেযাবৎ আবার জার্মানিতে হেট স্পিচ বনাম ফ্রি স্পিচ গোত্রীয় একটি তাত্ত্বিক বিতর্ক চলেছে৷ মনে রাখতে হবে, এই বিতর্কে ফ্রি স্পিচ বা বাকস্বাধীনতার এক প্রবক্তা খোদ এএফডি দল৷

২০১৭ সালে জার্মান সংসদীয় নির্বাচনের আগে উগ্র দক্ষিণপন্থি অ্যাক্টিভিস্টরা কিভাবে হেট স্পিচ ছড়িয়ে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল, তা আজ কারো অজানা নয়৷ অপরদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার মতো একটি লোভনীয় ও ধারালো অস্ত্র রাস্তাঘাটে পড়ে থাকলে তার যে অপব্যবহার হতে পারে এবং হয়ে থাকে, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷ সেই সোশ্যাল মিডিয়ার পিছনে আবার  রয়েছে ফেসবুক, টুইটার ও গুগল-এর মতো বড় বড় কোম্পানি ও তাদের আর্থিক স্বার্থ৷ সুবিশাল এই পটভূমিতে হেট স্পিচের মরণকামড়ও শুধু লালপিঁপড়ের কামড় বলেই মনে হতে পারে – কিন্তু হেট স্পিচের মজা হলো, তা গোখরো-কেউটের মতো এক কামড়ে বিষ ঢেলে দেয় না; কুটুস কুটুস করে কামড়ে ধীরে ধীরে শরীরের গোটা রক্তটাকেই বিষিয়ে দেয়৷ কাজেই সাবেক জার্মান আইনমন্ত্রী – আগামীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী – হাইকো মাস যে ফেসবুক, টুইটার ও গুগল-এর মতো ইন্টারনেট জায়ান্টদের হেট স্পিট সময়মতো না সরালে পাঁচ কোটি ইউরো জরিমানার ভয় দেখিয়েছেন, তাতে প্রমাণ হচ্ছে যে, তিনি হেট স্পিচের গুরুত্ব বোঝেন: হেট স্পিচের ওজন লাগে না, পরিসংখ্যান লাগে না, বার্ড ফ্লুর মতো বিদ্বেষের ভাইরাস বাতাসে ছড়ায়, পশুপাখিতে ছড়ায়৷

অরুণ শঙ্কর চৌধুরী, ডয়চে ভেলে
অরুণ শঙ্কর চৌধুরী, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Henriksen

সেদিন আর এদিন

ওদিকে এএফডি দল নতুন অনলাইন হেট স্পিচ বিরোধী আইনের নাম দিয়েছে ‘‘সেন্সরশিপ আইন'' আর আমি ভাবছি সুদূর ও নিকট অতীতের দু'টি অভিজ্ঞতার কথা, এই জার্মান নামের দেশটিতেই৷ বছর ৩০-৩৫ আগের কথা৷ গরমের দিন সন্ধ্যায় রাইনের ধারে একটু নদীর হাওয়া খেতে যাচ্ছি; কাছের পানশালা থেকে রঙে থাকা এক জার্মান ভদ্রলোক বেরিয়ে হঠাৎ অজানা বঙ্গসন্তানকে দেখে বললেন: ‘‘দেখো, এখানে থাকবে, ভালোভাবে থাকবে৷ বেচাল করলেই অ্যাডল্ফ এসে...'' – মুখ দিয়ে মেশিনগানের মতো আওয়াজ করে বুঝিয়ে দিলেন, ‘অ্যাডল্ফ', মানে অ্যাডল্ফ হিটলার আমার মতো বিদেশি-বহিরাগতদের বেচাল দেখলে কি করতেন৷ হেট স্পিচ বোধহয় তখনও আবিষ্কার হয়নি৷

৩৫ বছর পরের ঘটনা৷ আমার পরিচিতএক জার্মান ডয়চে ভেলের অফিসের কাছে রাইনআউয়ে, মানে বন শহরের ময়দান কিংবা রমনায় মালির কাজ করেন৷ তিনি শোনাচ্ছিলেন, তিনি কিভাবে এক পেট্রোল পাম্পের মালিকের সঙ্গে পেমেন্ট নিয়ে বাকবিতণ্ডা করতে গিয়ে একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলে কি বিপাকেই না পড়েছিলেন! এক্কেবারে ৬০ ইউরো জরিমানা!

‘‘সে কী! কী বলেছিলেন আপনি?''

‘‘আর কিছু নয়, পয়সাকড়ির ব্যাপার তো, তাই বলেছিলাম: ‘আমাকে কি ইহুদি পেয়েছ?'''

দেখা যাচ্ছে, সে আমলে হেট স্পিচ ছিল না, হেট স্পিচ বিরোধী আইন ছিল না, কিন্তু বাস্তববুদ্ধি ছিল – আর সেই সঙ্গে জরিমানা৷

আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত?