1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জুলাই ১৯৭১: সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি ফুটবলও হলো ‘হাতিয়ার'

সালেক খোকন
২৮ জুলাই ২০২৩

২৬ মার্চ ২০২১ থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। এক বছর পর, অর্থাৎ, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ফিরে তাকানো শুরু করে ডয়চে ভেলে বাংলা।

https://p.dw.com/p/4UV70
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়  ফুটবল খেলেও অন্যরকম এক লড়াই হয়েছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফুটবল খেলেও অন্যরকম এক লড়াই হয়েছিল।ছবি: DW/H. Ur Rashid

বীরত্ব, গৌরব ও বেদনার সেই নয় মাসে পর্যায়ক্রমে ফিরে তাকানোর এই পর্বে থাকছে জুলাই ১৯৭১-এর কিছু ঘটনার কথা...

পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত ও পাল্টা আক্রমণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে প্রতি সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করে মুজিবনগর সরকার। পাশাপাশি প্রতিটি সেক্টরকে অঞ্চল ভেদে ভাগ করা হয় কয়েকটি সাব-সেক্টরে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা বাঙালি অফিসার, যারা পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, এমন সিনিয়র ও অভিজ্ঞ সামরিক অফিসারদেরই ১১টি সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। মূলত সেক্টর কমান্ডাররা মুজিবনগর সরকারের অধীনে প্রথমদিকে সীমান্ত এলাকায় এবং পরবর্তীতে যৌথ বাহিনীর সহযোগিতায় দেশের ভেতরের যুদ্ধেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সেখানে যারা ছিলেন যোদ্ধা, তাদেরকে নিয়ে তারা কাজ করেছেন, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতও করেছেন।

১১ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত কলকাতায় ৮ নং থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তরে মন্ত্রীপরিষদ, সেক্টর কমান্ডার্স এবং উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনেই বাংলাদেশ বাহিনীর নেতৃত্ব, সংগঠন, প্রশিক্ষণ, অভিযান, প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র- তৃতীয়, দশম, দ্বাদশ ও চতুর্দশ খণ্ড)

পর্যাপ্ত অস্ত্র ও যুদ্ধসরঞ্জাম না থাকায় মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন রণকৌশল গ্রহণ করতে হয়েছিল একাত্তরে। বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা ছিল সেই রণকৌশলেরই একটি অংশ। এর ফলে ছোট ছোট অঞ্চলেও প্রশাসনিক এবং সামরিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের গতিও যায় বেড়ে ।

একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত ও অনিয়মিত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা অংশ নিতেন সশস্ত্রবাহিনীর প্রথাগত যুদ্ধে। ‘জেড ফোর্স' নামে পরিচিত একটি বাহিনীর প্রথম ব্রিগেডটি ফাস্ট, থার্ড এবং এইট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয় জুলাই মাসে। এরপরই তাদের এসিড টেস্ট হয় ফাস্ট বেঙ্গল কামালপুর বিওপি, থার্ড বেঙ্গল বাহাদুরাবাদ ঘাট আর এইট বেঙ্গল নকশি বিওপি অপারেশনে। কামালপুর বিওপিতে ফাস্ট বেঙ্গল অপারেশনে ব্যর্থ হয়। সেখানে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তমসহ শহীদ হন ৬৫জন। নকশিতেও প্রাণ দেন ৩৬জন যোদ্ধা। একমাত্র বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনেই সফল হয় থার্ড বেঙ্গল। ওই অপারেশনের আদ্যোপান্ত জানা যায় থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার প্রয়াত এস আই এম নূরুন্নবী খান বীরবিক্রমের ভাষ্যে।

লড়াই এগোনোর মতো কোনো সুযোগই ওদের দিইনি আমরা: প্রয়াত এম নূরুন্নবী খান বীরবিক্রম

তার ভাষায়, ‘‘পাকিস্তানিদের শক্তিশালি ঘাঁটি ছিল বাহাদুরাবাদ ঘাট। ওই ঘাটের ফেরিতে ট্রেনের ওয়াগন পারাপার হতো। এর নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সেনা, এক কোম্পানি প্যারা মিলিটারি রেঞ্জার এবং ৫০জন স্থানীয় বিহারী ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য। মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানীয় একটি গ্রুপ এ অপারেশনে আমাদের সাহায্য করে। ১৬টি বড় পাটের নৌকায় ব্রহ্মপুত্র দিয়ে এগিয়ে যাই আমরা। ৩১ জুলাই ১৯৭১। ভোর ৪টা। নদীর মোহনায় নিরাপত্তায় থাকে আলফা কোম্পানি, দায়িত্বে ক্যাপ্টেন আনোয়ার। আর ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়ার্টার কোম্পানি নিয়ে ঘাটের পাশের এক মাদ্রাসায় অবস্থান করেন মেজর শাফায়াত জামিল স্যার। উনি আমার প্রটেকশনে থাকবেন। মর্টার বা কাভারিং ফায়ারও দিবেন। আমার ডি কোম্পানি সামনে এগিয়ে হিট করবে। এটাই ছিল পরিকল্পনা।''

বীর যোদ্ধার ভাষায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয় এভাবে, ‘‘পাকিস্তানি সেনারা ট্রেনের ওয়াগনগুলোতে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এই সময় রকেট লঞ্চার দিয়ে ওয়াগনগুলো আমরা উড়িয়ে দিই। লড়াইয়ে ওরা টিকতে না পেরে একদল ভয়ে পালিয়ে যায় সিরাজগঞ্জের দিকে। অনেকে পালায় নদীর পাড় ধরে। লড়াই এগোনোর মতো কোনো সুযোগই ওদের দিইনি আমরা। ভোর ৪টা থেকে ৬টার মধ্যেই সব সফলভাবে অপারেশন শেষ করি।''

অনেক অপারেশনে রক্তাক্তও হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ১৭ জুলাই ১৯৭১। সিলেটের কমলগঞ্জের ধলাইতে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণের সময় আর্টিলারির স্প্লিন্টারে আঘাতপ্রাপ্ত হন মো. মাকসুদুর রহমান। এই বীর শুনিয়েছেন ওই অপারেশনের গল্প, ‘পাকিস্তানিরা তখন বোম্বিং শুরু করে। একটা এসে পড়ে চা বাগানের একটা গাছের ওপর, সেটা ব্লাস্ট হতেই স্প্লিন্টার এসে লাগে আমার মাথা, নাক, পা-সহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। পুরো শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায়। ভেবেছিলাম মরেই যাবো। ওইদিন মফিজের চোখ ও নাভির নীচে গুলি করে পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যায় শমশেরনগর ক্যাম্পে। পরে তার লাশটাও ফেরত পাইনি আমরা।''

এভাবে রক্তাক্ত হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ থেমে থাকেনি। ১১ জুলাই কুমিল্লায় সেনাদের একটি দল চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজারের দিকে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাম্বুশ আক্রমণের মুখে পড়ে এবং ১৫ জন পাকিস্তানী যোদ্ধা নিহত হয়। একইদিন চাঁদপুরে দুই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা পাওয়ার স্টেশনের সামনে পাহারারত ২ পাকিস্তানি সেনা ও ২ পুলিশকে গ্রেনেড মেরে শেষ করে দেয়। খুলনার পাইকগাছায় লেফটেন্যান্ট শামসুল আরেফিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটিতে। এছাড়া ঢাকার গেরিলারা ১৯ জুলাই রাজধানীর উলুন পাওয়ার স্টেশন, খিলগাঁও পাওয়ার সাবস্টেশন এবং গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনে বিষ্ফোরণ ঘটায়। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ- সেক্টর দুই, মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স- খালেদ মোশাররফ)

মফিজের লাশটাও ফেরত পাইনি আমরা: মুক্তিযোদ্ধা মো. মাকসুদুর রহমান

এ সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও সরব হয়ে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। ‘রুখে দাড়িয়েছে বাঙালীরা'- এমন শিরোনামে ১৯ জুলাই নিউজউইক-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বিশৃংঙ্খলা সৃষ্টিকারী, অন্তর্ঘাতক ও অনুপ্রবেশকারীদের ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে সৈন্যরা।'' বাস্তবে ঘটছিল ঠিক তার উল্টো। পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে বাঙালিদের প্রতিরোধ আন্দোলন এতটাই দুর্বার হয়ে উঠেছিল যে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরগুলোই এর বড় প্রমাণ।

একইভাবে ১০ জুলাই দি ইকোনমিষ্ট এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করে ‘এখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিফৌজ'। ১১ জুলাই ব্রিটিশ গণমাধ্যম সানডে টাইমসের বিশেষ প্রতিবেদনে সাংবাদিক মারে শেলি বলেন, ‘‘পাকিস্তান দাবি করছে পূর্ববঙ্গ এখন সম্পূর্ণ স্থিতিশীল ও শান্ত যা পুরোদস্তুর মিথ্যা।' ৩১ জুলাই ইকনমিস্ট পত্রিকার প্রতিবেদনের শিরোনাম হয়, ‘বাংলায় পাকিস্তানিদের দিন শেষ হয়ে আসছে।'' (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস,বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র-ষষ্ঠ ও চতুর্দশ খণ্ড)

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বপ্নের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিল আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি ও তৎকালীন প্রশাসন। কিন্তু সেখানকার সাধারণ ও সচেতন মানুষ বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। গণহত্যার বিরুদ্ধে অভিনব প্রতিবাদ করেছিল আমেরিকার মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর শহরের মানুষ। বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দর থেকে অস্ত্র নিচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ জাহাজ-পদ্মা। ১৪ জুলাই ১৯৭১ তারিখে একদল শ্রমিক ও স্থানীয় জনসাধারণ যুদ্ধ জাহাজে অস্ত্র তোলার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ‘No arms to Pakistan', ‘End all Us Aid to pakistan'- লেখা ফেস্টুন নিয়ে প্রতিবাদ জানান তারা। এ ছাড়া কোয়ার্কাস নামের একটি দল কতকগুলো ডিঙি নৌকা নিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে পাকিস্তানের কার্গো জাহাজের গতিপথও বন্ধ রাখে। এ প্রতিবাদের নেতৃত্বে ছিলেন চার্লস খান। তার সঙ্গে ছিলেন মি. ডিক টেলর, স্যালি উইলবি, স্টেফানি হলিম্যান, অ্যালেক্স কক্স, চার্লস গুডউইন, ওয়েন লাউজার প্রমুখ। সেদিন এ আন্দোলনের কারণে তাদের গ্রেফতার করা হলে ধর্মঘট ডেকে বসে বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন।‘রক্তমাখা টাকা নেবো না' -এমন স্লোগান দিয়ে তারা পাকিস্তানি জাহাজে মালামাল তোলা থেকে বিরত থাকে। তাদের ভাষ্য ছিল এমন, ‘‘যে অস্ত্র তাদের জাহাজে তুলে দেওয়ার কথা, সেই অস্ত্রের গুলিই তো কেড়ে নেবে পূর্ব পাকিস্তানের নারী-শিশুসহ অসংখ্য মানুষের অমূল্য প্রাণ। বাল্টিমোরের শ্রমিকেরা এতটা বিবেকহীন নন যে, তাঁরা মানুষ হয়ে মানুষ হত্যার রসদ সরবরাহের অনুষঙ্গে পরিণত হবেন।'' (তথ্যসূত্র: Blockade- Richard K. Taylor)

এই অহিংস আন্দোলনের প্রভাব পড়ে আমেরিকার অন্যত্রও। ফলে সামরিক সরঞ্জাম না নিয়েই পাকিস্তানি জাহাজ ‘পদ্মা'র মতো নিউইর্য়ক থেকে ‘সুটলাজ' এবং ফিলাডেলফিয়া সিটি হারবার থেকে ‘আল-আহমাদি' জাহাজকেও ফেরত যেতে হয়েছিল।

শুধু অস্ত্র হাতেই নয়, স্বাধীনতার জন্য একাত্তরে একদল ফুটবলযোদ্ধা অন্যরকম করেছিলেন অন্যরকম যুদ্ধ। বাংলার জনপদ যখন রক্তাক্ত, ঠিক তখনই তারা স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি আর তহবিল গড়তেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ফুটবল ম্যাচ খেলার উদ্যোগ নেন। গড়ে তোলা হয় ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল'। পরিকল্পনাটি নিয়ে তারা সাক্ষাৎ করেছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গেও। ওই সরকারের সহযোগিতায় রচিত হয় ফুটবল পায়ে মুক্তিযুদ্ধের আরেক ইতিহাস।

প্রথম জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ও জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে খেলা শুরু হয়: সাইদুর রহমান প্যাটেল

ফুটবল পায়ে একাত্তরের সেই যুদ্ধের বিস্তারিত ঘটনা শোনা যায় দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান প্যাটেলের মুখে। তিনি বলেছেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ফুটবল দল গঠনের প্রস্তাবটি শুনে তাজউদ্দীন আহমেদ এর উদ্দেশ্যটি জানতে চান। বললাম, ম্যাচের গেট মানিটা আমরা মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে দেবো। পাশাপাশি আমাদের যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনেও এটা ভূমিকা রাখবে। আর আমাদের ফুটবল খেলোয়াড়রাও স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখার সুযোগ পাবে।

প্রস্তাবনাগুলো শুনে উনি জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ইয়াং চ্যাপ প্যাটেল। এত সুন্দর চিন্তা তোমাদের। কী করতে হবে বলো?

আমি বললাম, এজন্য সর্ব ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের অনুমতি লাগবে।

তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘সবকিছু আমি ও আমার সরকার করে দেবে।' এরপর প্রাথমিক খরচবাবদ চৌদ্দ হাজার রুপি আমাদের হাতে তুলে দেন।

তখন আমি কলকাতায় থাকলেও আমাদের কোনো খেলোয়াড়ের খোঁজ জানি না। কলকাতার রাস্তায় দেখা হয় আবাহনীর আশরাফ ভাইয়ের সঙ্গে। জানালেন ট্রামে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল প্রতাপ শংকর হাজরার। এছাড়া আলী ইমাম আছেন মোহনবাগান ক্লাবে, ইস্ট বেঙ্গলে আছেন ওয়ারীর লুৎফর। এরই মধ্যে বন্ধু মঈনকে পাঠালাম ঢাকায়। সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে বিখ্যাত খেলোয়াড় শাহজাহান, লালু ও সাঈদকে নিয়ে চলে আসে কলকাতায়।

এদিকে খেলোয়াড় আহ্বান করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল। তা শুনে আগরতলায় আসেন অনেকেই। নওশের, সালাউদ্দিন, এনায়েত, আইনুল হক ভাই ছিলেন নামকরা খেলোয়াড়। ভারত সরকারের সহযোগিতায় আগরতলা থেকে তাদেরও কলকাতায় আনা হয় বিমানে। আমি গেলাম আলী ইমাম ও প্রতাপ দা-কে আনতে।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে প্রথম যোগ দেন আশরাফ আলী ভাই, দ্বিতীয় প্রতাপ শংকর হাজরা দা ও নুরুন্নবী ভাই, তৃতীয় আলী ইমাম ভাই, চতুর্থ লুৎফর। এভাবে ১৮-২০ জনের মতো ফুটবলার কলকাতায় চলে এলে দল গঠন হয়ে যায়। পার্ক সার্কাস পার্কের ভেতরের মাঠে চলে অনুশীলন। দল গঠনের ২৬ বা ২৭ দিন পর বালুঘাট থেকে আসেন জাকারিয়া পিন্টু ভাই, আসেন তানভীর মাজহার তান্নাও। তান্না বেশ স্মার্ট ছিলেন, তাই ম্যানেজার করা হয় তাকে। আর জ্যেষ্ঠতার বিবেচনায় জাকারিয়া পিন্টুকে অধিনায়ক এবং সহ-অধিনায়ক করা হয় প্রতাপ শংকর হাজরাকে।''

সেই যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিগুলো প্যাটেলের কাছে এখনো তরতাজা। প্রথম ম্যাচের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম ম্যাচ হয় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর মাঠে, ২৫ জুলাই ১৯৭১ তারিখে। প্রতিপক্ষ ছিল নদীয়া একাদশ। লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে আমরা মাঠ প্রদক্ষিণ করবো, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইবো এবং ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগান দিয়ে খেলা শুরু করবো- এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে তখনও স্বীকৃতি দেয়নি ভারত। আট নম্বর থিয়েটার রোডের অস্থায়ী অফিসেও ওড়েনি বাংলাদেশের পতাকা। ফলে পতাকা ওড়ানো ও জাতীয় সংগীত বাজানোয় আইনি জটিলতা দেখা দেয়। পরিকল্পনার কথা শুনে নদীয়া জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ডিকে বোস শুধু বললেন, ‘আমার চাকরি থাকবে না'। আমরাও বেঁকে বসি, জাতীয় পতাকা ছাড়া খেলবো না। পরে ডিসি সাহেব সাহস করেই অনুমতি দিলেন। প্রথম জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ও জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে খেলা শুরু হয়। এটাই হলো ইতিহাস। ২-২ গোলে ড্র হয় ওই ম্যাচটি।''

দলের নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘অফিসিয়ালি গঠন করা হয়েছিল-বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি। ফুটবল ছাড়াও অন্যান্য খেলা আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল। কলকাতায় আমাদের বেতার কেন্দ্রের নাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ফলে যখন খেলতে নামি, স্থানীয়রাই আমাদের ডাকতে লাগলো ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল' বলে। সারা ভারতে মোট ১৬টি ম্যাচ খেলে এ দলটি। প্রাপ্ত গেটমানি ও অনুদানসহ মুজিবনগর সরকারের মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল সর্বমোট ১৬ লাখ ৩৩ হাজার রুপি জমা দিয়েছিল।

যুদ্ধ মানে রণাঙ্গনের লড়াই। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ফুটবল খেলে অন্যরকম এক লড়াইও হয়েছিল। মাঠে খেলে যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি ও যুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা- এমন নজির বোধহয় পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল' এদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবের ইতিহাস। যারা বিদেশের মাঠে প্রথম পাতাকা উড়িয়েছে, জাতীয় সংগীত গেয়েছে। এদেশের জন্মের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে ফুটবলও!