1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তাজমহলের অসম্মান, ভারতের জন্যই লজ্জার

রাজীব চক্রবর্তী নতুনদিল্লি
৬ অক্টোবর ২০১৭

বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য৷ ভারতের গর্ব৷ কিন্তু, উত্তরপ্রদেশ সরকারের পর্যটন মানচিত্রে স্থান পায়নি সেই বিস্ময় স্থাপত্য তাজমহল! তাজমহল না থাকলেও সেখানে কিন্তু বেনারসের গঙ্গা আরতি, গোরক্ষপুরের মন্দির ঠিকই আছে৷

https://p.dw.com/p/2lP7v
Taj Mahal
ছবি: DW/A. Chatterjee

গোরক্ষপুরের মন্দির কি সবাই চেনেন? এই মন্দির সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য – এর মূল পুরোহিত স্বয়ং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ

‌ উত্তরপ্রদেশ সরকারের পর্যটন দপ্তর সম্প্রতি ৩২ পাতার ঝকঝকে একটি বুকলেটে দেশি-‌বিদেশি পর্যটকদের কাছে রাজ্যের কী কী আকর্ষণীয়, ছবিসহ তার তালিকা প্রকাশ করেছে৷ সেখানেই তাজমহল নেই৷

আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটিদের ভারত সফরে তাজমহল ‘‌মাস্ট ভিজিট'‌-‌এর তালিকায় থাকলেও, তাজমহল যে রাজ্যে অবস্থিত, সেখানেই উপেক্ষিত৷ যোগী আদিত্যনাথ যে ‌রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সে রাজ্যে মুসলমান সম্রাটের পত্নীপ্রেমের অনন্য নিদর্শন ‘‌কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল'‌ তাজমহলের যে উল্লেখ থাকবে না, এ তো স্বতঃসিদ্ধ৷ আদিত্যনাথ সরকারের এহেন কীর্তিতে হতবাক সবাই৷ ওয়াকিবহাল মহল অবশ্য বিষটিকে বিছিন্ন ঘটনা মানতে নারাজ৷ বলা হচ্ছে, এর পেছনে রয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টির হিন্দু-‌মুসলিম তত্ত্ব৷

মুঘল আমলের আশ্চর্য শিল্পকলা দেখতে আগ্রায় প্রতি বছর গড়ে ৬০ লক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যটকের ভিড়৷ বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে লখনৌয়ে এই বুকলেট রিলিজ করেন রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী রীতা বহুগুণা যোশী৷ ঘটনায় তুমুল বিতর্ক তৈরি হওয়ায় তড়ঘড়ি বিষয়টিকে এড়াতে আসরে নামেন রীতা বহুগুণা যোশী৷ তাঁর দাবি, উত্তরপ্রদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে তাজমহল ছিল ও আছে৷

পর্যটন দপ্তরের ‌ডিরেকটর জেনারেল অবনীশ অবস্থি জানান, ‘‌‘‌পর্যটন বুকলেটে তাজমহলের নাম না থাকাটা ভুল৷ প্রো-পুওর ট্যুরিজম ক্যাটেগরিতে থাকা ১৫৪ কোটি টাকার প্রকল্পগুলিকেই এই বুকলেটে হাইলাইট করা হয়েছে৷ এই ক্যাটেগরিতে তাজমহলকেও রেখেছে সরকার৷'‌'‌ কিন্তু উত্তরপ্রদেশে সরকার যতই বিষয়টিকে লঘু করার চেষ্টা করুক, গত বছর জুন মাসে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের একটি বিবৃতি বিতর্ককে উস্কে দিচ্ছে৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘‌‌ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক গীতা ও রামায়ণ৷ তাজমহল নয়৷'‌'‌ বিদেশি পর্যটকদের তাজমহলের রেপ্লিকা উপহার দেওয়ারও সমালোচনা করেছিলেন তিনি৷ বলেছিলেন, ‘‌‘‌এটা ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ নয়৷'‌'‌

তবু তো ভালো ২০১৭ সালের ইউপি'‌র ট্যুরিজম বুকলেটে তাজমহল অনুপস্থিত৷ কিন্তু এর বদলে কেউ যদি সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তম পত্নী মমতাজ মহলের সমাধি ভবনটি বিক্রি করে দিতেন?‌ প্রশ্ন নয়, ব্যাপারটা ঘটনা৷ ১৮৩১ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল, যাঁকে আমরা সতীদাহ রদ করার জন্য অত্যন্ত ‘‌প্রগতিশীল'‌ মনে করি, তিনি এই তাজমহলকেই নিলামে চড়িয়েছিলেন৷ এই সত্য ঘটনার কথার সূত্র একটি বই—‌‘ দ্য জার্নাল অফ ফ্যানি পার্কস: বেগমস, থাগস অ্যান্ড ইংলিশম্যান',, সম্পাদনা করেছেন উইলিয়াম ডালরিম্পল৷ ২৬ জুলাই, ১৮৩১৷ কলকাতার বিশেষ খবর উল্লেখ করে লিখেছেন, গভর্নর জেনারেল আগ্রা দুর্গের ভেতরের অত্যন্ত সুন্দর মোতি মসজিদ বিক্রি করে দিয়েছেন৷ বিক্রি করে ভারত সরকার পেয়েছে ১,২৫,০০০ টাকা (‌প্রায় সাড়ে ১২ হাজার পাউন্ড)‌৷ এখন মসজিদটি ভাঙার কাজ চলছে৷ তাজমহলও বিক্রির জন্য নিলামে চড়েছিল৷ কিন্তু সরকার যে দাম আশা করছিল, তা জোটেনি বলেই বিক্রি হয়নি৷ দু'‌লাখ টাকা দর একজন ব্যবসায়ী হেঁকেছিলেন৷

তাজমহলের নাম বাদ!

শুধু দরে বনেনি বলেই নয়, ফ্যানি লিখছেন, বিক্রি করলে ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের ক্ষেপে যাওয়ার আশঙ্কাও ছিল৷ এরপর ফ্যানি লিখেছেন, এ ঘটনা সত্য হলে তা কি লজ্জাজনক হতো না?‌ যদি ইংল্যান্ডের বর্তমান রাজা মাত্র সাড়ে বারো হাজার পাউন্ডের জন্য ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে রাজা সপ্তম হেনরির চ্যাপেলটি বেচে দেন, তাহলে যে কাণ্ড হতো, তাজমহল বিক্রির অপচেষ্টাও কি তার তুল্য নয়?‌ এরপরই দিনলিপিতে ফ্যানির প্রশ্ন,‌ কোন অধিকারে গভর্নর জেনারেল তাজমহল বিক্রির কথা ভাবলেন?‌ তাঁর কি মৃতকে অসম্মান  করার অধিকার আছে?‌ উনি কোন সমাধি স্তম্ভটি বেচার কথা ভেবেছিলেন, যা এক অনন্যসুন্দরী সম্রাজ্ঞীর স্মৃতিতে নিবেদিত, স্থাপত্যে বিশ্বের বিস্ময়‌৷ এটা অসম্ভব যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক সমিতি কোর্ট অফ ডিরেক্টর্স তাজমহলের পাথরের জন্য বেচার কথা চিন্তাও করতে পারে৷ শুনেছি, এক হিন্দু তাজমহলের মার্বেল পাথর দিয়ে বৃন্দাবনে তার আরাধ্য দেবতার মন্দির বানাবে৷ তিনি তাজের জন্য দু'‌লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন৷

স্যার যদুনাথ সরকারের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, তাজমহল গড়তে শাহজাহানের খরচ হয়েছিল পঞ্চাশ লাখ টাকা৷ এবং সে খরচ হয়েছিল বেন্টিঙ্ক-এর অপচেষ্টার দু'‌শ' বছর আগে৷ ষোড়শ শতাব্দীর তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে নির্মিত হয় তাজমহল৷ বেন্টিঙ্ক ভারত শাসন করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে— ১৮২৮ থেকে ১৮৩৫, মোট ৭ বছর৷

‌ইতিহাসবিদ অশোক মিশ্র বলছেন, ‘‌‘‌বিজেপি-‌শাসিত যোগী আদিত্যনাথ সরকারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷ তা না হলে এমন হাস্যকর কান্ড কেনইবা ঘটানো হবে৷ ‌ভারতবর্ষের বাইরের পর্যটকদের কাছে তাজমহল একটি অবশ্যদর্শনীয় স্থান৷ পর্যটকরা তাজের সৌন্দর্য উপভোগ করলে উত্তরপ্রদেশ, তথা ভারত লাভবান হয়৷ তাজের সম্মানহানির চেষ্টা আগেও বহুবার হয়েছে৷ ইতিহাস অনুযায়ী, একবার তো তাজমহল বিক্রি করার চেটাও হয়েছিল৷ বিদেশের কাছে ভারতের সম্মান ক্ষুন্ন করা হলো মাত্র৷'‌'‌ এ ঘটনা যে শুধু উত্তররপ্রদেশের জন্যই দুর্ভাগ্যজনক তা নয়, বিষয়টি গোটা ভারতের জন্যই লজ্জাজনক৷ প্রতিবছর পর্যটন মরশুমে ভারতে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন তাজমহলে৷ ফি-‌বছর পর্যটনে দেশের রাজকোষে সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা পড়ে তাজমহল থেকেই৷ এখন শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে তাজমহলকে পর্যটনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার মানে হলো ইতিহাসকে অস্বীকার করা৷ সেইসঙ্গে অবশ্যই দেশের রাজস্বে ক্ষতির শিকার হওয়া৷ প্রশ্ন উঠছে, যোগী সরকার যদি এমন ভুল করেই থাকে, কেন্দ্র সরকার তার দায় এড়ায় কীভাবে?‌ এর আগে উত্তরদেশেই সাধারণ পাঠ্যসূচী থেকে মির্জা গালিবের হিন্দি ও উর্দু শায়েরি, উর্দু শব্দাবলী বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে৷ তবে কেন্দ্রই বা আর কোন মুখে রাজ্যের সমালোচনা করবে!‌ খোদ কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা না পড়ানোর সুপারিশ জমা পড়েছে৷ সেই সুপারিশ আবার পাঠিয়েছে ভারতীয় জনতা পাটির মাতৃসম সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শিক্ষা বিষয়ক শাখা সংগঠন থেকে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য