1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নাক তো কাটাই ছিল, দায় কেবল প্রবাসীদের?

১০ জুলাই ২০২০

প্রবাসী বললেই এখন আমরা বুঝি কিছু ব্যক্তি যারা বিমানবন্দরে নেমে কোয়ারান্টিনে থাকতে চাচ্ছেন না৷ অথবা করোনাবাহী ‘বিমান বোমা' নিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের নাক কাটা যাওয়ার কথা৷ কিন্তু এটা কি প্রবাসীদের পুরো চিত্র?

https://p.dw.com/p/3f77I
Singapur Hilfsarbeiter
ছবি: Reuters/E. Su

বাংলাদেশ জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর ২০২০ সালের হিসেব বলছে বিশ্বে এখন এক কোটি ৩০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক বৈধভাবে কাজ নিয়ে বিভিন্ন দেশে বাস করছেন৷ শিক্ষার্থী, দক্ষ কর্মী এবং অবৈধ শ্রমিকদের সংখ্যার তো কোনো হিসেবই নেই৷ ফলে ধরে নেয়া যায় এ সংখ্যা দুই কোটির কাছাকাছি হতে পারে৷

প্রবাসীদেরমধ্যে যেমন উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভালো বেতনে ভালো চাকরি করা মানুষ আছেন, তেমনই আছেন না খেয়ে না পরে ছোট বাসায় গাদাগাদি করে থাকা মানুষও৷ বরং পরের ক্যাটাগরির মানুষই প্রবাসে বেশি হবেন৷ দেশে থেকে বা নিউজে দেখে আসলে প্রবাসীদের বড় এই অংশের সমস্যা বা প্রতিকূলতা বোঝাটা কষ্টকরই৷ জার্মানিতেথাকার সুবাদে ইউরোপের প্রবাসীদের জীবনটা বেশ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে৷ কয়েকটা উদাহরণ দেই৷

বিদেশ আসা অনেকের কাছেই একটা স্বপ্নের মতো৷ সেই স্বপ্নের কারণে সমস্ত সঞ্চয় ত্যাগ করে, পরিবার দূরে রেখে হলেও মানুষ হাজার হাজার মাইল দূরে বাস করতে বাধ্য হন৷ এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় বনের রাস্তায়৷ সারাটা দিন তার কাজ হলো রাস্তার পাশে বা ডাস্টবিনে পড়ে থাকা মদের বোতল কুড়িয়ে জমা করা৷ সে খালি বোতল দোকানে জমা দিলে বোতলপ্রতি মেলে সর্বোচ্চ ২৫ পয়সা৷ ১০০টা বোতল জমা দিলে পকেটে আসে মাত্র ২৫ ইউরো৷ কিছু জমি বেচে, কিছু ধার করে ৮ লাখ টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে প্রথমে মধ্যপ্রাচ্য, পরে ইটালি, তারপর এখন তার আশ্রয় জার্মানিতে৷ অথচ, সেই টাকা শোধ করার পারিবারিক চাপে দিনে একবেলা কেবল ডাল আর ভাত খেয়েই দিন কাটতো তার, ছোট্ট একটা রুমে আরো তিন জনের সঙ্গে ছিল তার শোয়ার ব্যবস্থা৷ শেষ পর্যন্ত জার্মানিতেও থাকার অনুমতি না মেলায় তাকে পালাতে হয়েছে পর্তুগালে৷

ইটালিতে এত বেশি বাঙালি হয়ে গেছেন যে এখন অনেকেই কাজ পাচ্ছেন না৷ রোমের বিখ্যাত কলোসিয়ামের সামনে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল অন্তত ২০ জন বাংলাদেশি বিক্রেতার৷ কারো হাতে সেলফি স্টিক, কেউ বিক্রি করার চেষ্টা করছেন স্কার্ফ, কেউ জলের বোতল৷ কিন্তু অন্তত এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও আমি কাউকে কিছু বিক্রি করতে সফল হতে দেখিনি৷ একজনের বললেন তিনি একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করেন বিকেলে৷ এদের বেশিরভাগই বৈধ শ্রমিক, কিন্তু থাকা-খাওয়ার পর দেশে টাকা পাঠানোর খরচ জোটানোর জন্য তাকে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এখানে এসে দাঁড়াতে হয়৷

মালদ্বীপে দুজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল যাদের কাজ একটি রিসোর্টে গাছ থেকে নারিকেল পাড়া৷ একজনের কোনো কাগজ না থাকায় বাড়ি যান না ৮ বছর, অন্যজন বৈধ হলেও তার কাগজ মালিকের কাছে বন্ধক৷ মধ্যপ্রাচ্য়ের কথা আর নাই বা বললাম৷

এখন আমরা সবাই করোনার বিপদে রয়েছি, দেশে বাস করা বাংলাদেশিরাও, প্রবাসীরাও৷ কিন্তু দুটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে প্রবাসী বিদ্বেষ এবং রেমিট্যান্স নিয়ে হাস্যরস করা হয়েছে, তা খুবই দুঃখজনক৷ দেশেও আমরা সাধারণ ছুটিতে কেন শ্রমিকেরা দলবেঁধে গ্রামের বাড়ি যায়, সেটা বোঝার চেষ্টা না করে নিজেদের নিরাপদ স্থানে বসে থেকে তীব্র সমালোচনা করেছি৷ প্রবাসীরাও কেন বিপদের সময় নিজের দেশে স্বজনের কাছে ফিরতে চায়, সেটাও আমরা ঢাকায় বসেই হাসিঠাট্টার বিষয়ে পরিণত করেছি৷

প্রশ্ন উঠবে, এসে কোয়ারান্টিনে থাকলেই এ বিদ্বেষ সৃষ্টি হতো না৷ কিন্তু আমরা কি জানি কতজন প্রবাসী করোনাকালে দেশে ফিরেছেন, আর সে তুলনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা প্রবাসীর সংখ্যা কত? ব্র্যাকের হিসেব অনুযায়ী লকডাউনের আগে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের বাইরে থেকে সাড়ে চার লাখ বাংলাদেশি ফিরে এসেছেন। এরমধ্যে দেড় থেকে দুই লাখ প্রবাসী শ্রমিক। তাদের মধ্যে সৌদি আরব থেকে ৪১ হাজার, আরব আমিরাত থেকে ৩৮ হাজার। মালয়েশিয়া থেকে ১৯ হাজার ফিরে এসেছেন। মার্চের পর থেকে এখন পর্যন্ত ফিরে আসা প্রবাসীর সংখ্যা আরো বেশি হবে৷ সে তুলনায় ইটালি থেকে আসা কয়জন প্রবাসীই এত বড় হয়ে গেল যে আমরা তাদের দশকের পর দশক রক্ত জল করা শ্রম, সুনাম আর অর্থ বিদ্বেষ দিয়ে ঢেকে দিবো?

ইটালি ও স্পেনের মতো বেশ কয়েকটি দেশেই প্রবাসীদের বিরুদ্ধে নিয়ম না মানার অভিযোগ উঠেছে৷ কিন্তু সেসব দেশে অন্য প্রবাসীরাই তাদের এ নিয়ে সমালোচনা করছেন৷

এবার আসুন, যারা করোনায় দেশে ফেরেননি, তাদের অবস্থাটা জানি৷ বাংলাদেশে যদি এখন ১৬ কোটি মানুষের বাস হয়, এই লেখা লিখার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে মারা গেছেন দুই হাজার ২৭৫ জন৷ করোনায় প্রাণ হারানো প্রবাসীর সংখ্যাটা জানেন? ব্র্যাক বলছে, ৫ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে আক্রান্ত অন্তত ৭০ হাজার বাংলাদেশি, ১৯ দেশে মারা গেছেন অন্তত এক হাজার ৩৭৭ জন৷ আক্রান্তের হিসেবে বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ২৭ শতাংশ, প্রবাসে সে হার এক দশমিক ৯৬ শতাংশ৷

অর্থনীতির প্রথম চাপটা স্বাভাবিকভাবেই নিম্নবিত্তের উপরেই আসে৷ প্রবাসীদের মধ্যেও বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত, কেউ মধ্যবিত্ত, অল্পসংখ্যক রয়েছেন উচ্চবিত্তের কাতারে৷ মধ্যপ্রাচ্যে এমনিতেই শ্রমিকদের, বিশেষ করে গৃহকর্মীদের ওপর নানা নির্যাতনের কথা উঠে আসে গণমাধ্যমে৷ করোনার লকডাউন চলাকালে সে নিপীড়ণ নতুন মাত্রা নিয়েছে৷ লকডাউনে সব বন্ধ থাকায় বাড়িতে বেড়েছে কাজের পরিমাণ কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে বেতন৷ মালয়েশিয়ায় লকডাউনে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি নির্যাতন নিয়ে আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলায় বাংলাদেশের ছাত্র রায়হান কবিরকে খুঁজছে দেশটির পুলিশ৷ এই মুহূর্তে মালয়েশিয়ায় ডিটেনশন সেন্টারে ভয়াবহ নিপীড়ণমূলক পরিবেশে এটকে রাখা প্রবাসী শ্রমিকদেরবিষয়ে আপনি কিছু বলবেন না? আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে এমন ব্যবহারে মালয়েশিয়ার নাক কাটার দায়িত্ব কার?

ইউরোপে বেশিরভাগ শ্রমিক কাজ করেন রেস্টুরেন্টে, নির্ভর করেন পর্যটনের ওপর৷ এসব ক্ষেত্রই করোনার লকডাউনে সরাসরি বিপর্যয়ে পড়েছে৷ ফলে সবার আগে খাঁড়ার ঘা পড়েছে মরার প্রবাসীদের ওপরেই৷

HA Asien | Anupam Deb Kanunjna
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

এই কথাগুলো কি প্রবাসীদের গালি দেয়ার সময় আমরা মাথায় রাখি?

আমরা রেমিটেন্স নিয়েও হাসিঠাট্টা করছি৷ কিন্তু পুরো দেশের আয় যখন বন্ধ হয়ে আছে তখনও জুন মাসে প্রবাসীরা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে রেমিট্যান্স পাঠানোর রেকর্ড করেছেন৷ লকডাউনের মধ্যেও জুন মাসেই প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১৮৩ কোটি ডলার৷ জুন মাসে পুরো দেশের রপ্তানি আয় কত জানেন? ২৭১ কোটি ডলার৷

হ্যাঁ, অবশ্যই কিছু প্রবাসীর দোষ রয়েছে৷ তারা তথাকথিত উন্নত দেশে দীর্ঘদিন বাস করেও দেশে-বিদেশে আইনের প্রতি সম্মান জানানো শেখেননি, টাকা পাঠিয়ে নিজেকে দেশের রাজা মনে করার মানসিকতা রয়ে গেছে৷ কিন্তু এই সংখ্যাটি আসলে কত? এর জন্য ‘প্রবাসীদের' একটা জাতিতে পরিণত করে জাতিবিদ্বেষ সৃষ্টিটা বরং বাংলাদেশের জন্যই লজ্জার৷

বিশ্বব্যাপী আমাদের নাক কাটা গেছে প্রবাসীদের জন্য? ভালো করে ভেবে দেখুন ইটালির সংবাদপত্রে সংবাদটা কী হয়েছে? ‘বাংলাদেশ ভুয়া সার্টিফিকেট দিচ্ছে৷' তো এ দায় একা প্রবাসীদের দিচ্ছেন কেন? ভুয়া সার্টিফিকেট তারা কোথায় পেয়েছেন? রিজেন্ট হাসপাতাল যাদের নমুনা পরীক্ষা না করেই সার্টিফিকেট দিলো, তারা তো দেশেই ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ এর আগে কোরিয়া, জাপানে ফ্লাইট বন্ধ হলো, নাক কাটা যায়নি?

এই যে বাংলাদেশে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য মানুষ জেলে যাচ্ছে, কবিতা লেখার জন্য খুন হচ্ছে, হঠাৎ মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় না, নির্বাচন নিজের মতো করে হয়ে যাচ্ছে, একজন সংসদ সদস্য কুয়েতে জেলে আছেন, রাজনীতিবিদরা যা ইচ্ছা বলে যাচ্ছেন, এগুলো নিয়েও তো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ হচ্ছে৷ কখনই নাক কাটা যায়নি? নাকি সে দোষও দিন শেষে প্রবাসীদেরই?

আমাদের দেশ হিসেবে নিজেদের মান বাড়াতে হবে৷ আমাদের ধারণা কেবল বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকেরাই এমন আচরণ করেন­? জার্মানদের অনেকেই করোনার সময়েও উদ্ভট আচরণ করছেন৷ প্রতিটি দেশেই এমন কিছু মানুষ রয়েছেন, কিন্তু সেসব দেশের বেশিরভাগ দেশ হিসেবে শক্তিশালী বলে এত সহজে ‘নাক কাটা গেলো' বলে আঁতকে ওঠে না৷ ফলে আগে দেশটাকে ঠিকঠাক করা দরকার৷ সার্বিক সিস্টেম ঠিক না হলে কেবল নাক না, একসময় নিজেরাই দেশের হাত-পা কেটে ফেলে রাখবো, কেউ তাকাবেও না৷