1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নির্বাচনে সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক বাতিক ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

৮ নভেম্বর ২০২০

জন মিল্টন বলেছিলেন, সৃষ্টিকর্তা যখন থেকে মানুষকে বুদ্ধি দিলেন তখন থেকে তিনি নির্বাচনের ক্ষমতা দিলেন৷

https://p.dw.com/p/3l1Ce
USA Wahlen Reaktionen Medien Zeitungen
ছবি: Getty Images/AFP/F. Coffrini

জন মিল্টন বলেছিলেন, সৃষ্টিকর্তা যখন থেকে মানুষকে বুদ্ধি দিলেন তখন থেকে তিনি নির্বাচনের ক্ষমতা দিলেন৷ সমস্যা হলো, পৃথিবীতে সবার প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ আছে বটে, কিন্তু সবার লোভ মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়৷ প্রাপ্য সম্পদ আর অপূরণযোগ্য লোভের মধ্যকার অনাদিকালের যে যুদ্ধ তার মধ্যেই জাগতিক সকল রাজনীতির মারপ্যাঁচ বিদ্যমান৷ এই মারপ্যাঁচের চিরস্থায়ী সমাধান সম্ভব না হলেও একটি আপাত সুখকর ও স্বস্তিদায়ক ঔষধের নাম গণতন্ত্র, যা মোটামুটিভাবে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য৷ গণতন্ত্র যদি একট ঘর হয় তাহলে সেখান প্রবেশের প্রথম ফটকটি হলো নির্বাচন৷ নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র চলে আসবে- এমন নিশ্চয়তা দেয়া না গেলেও নির্বাচনকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র যে সম্ভব নয় সেটি নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক নেই৷ নির্বাচনহীন গণতন্ত্র যেমন অর্থহীন, তেমনি গণতন্ত্রবিহীন নির্বাচন পঙ্গু৷

গত কয়েকদিন ধরে বিশ্বের এমন কোন সংবাদমাধ্যম নেই যার অন্যতম প্রধান খবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নয়৷ কখনও কখনও তা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে হতে পারে৷ জুনের পর করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোক মারা যাওয়ার দিন যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলোতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন৷ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বলেই কি গণমাধ্যম এমন কাভারেজ দেয়? চীন, রাশিয়ার মতো অন্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর সরকার নির্বাচন বিশ্বব্যাপী এমনটা প্রচার পেতে দেখা যায় না৷ নির্বাচন প্রক্রিয়ার উৎকর্ষতা, গণতান্ত্রিক চর্চা আর যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা দেশটির জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারমাধ্যমের এমন হুমড়ি খেয়ে পড়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে৷

নির্বাচন যে একটি শক্তি, একটি মাধ্যম, একটি উৎসব তা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রতি চার বছরে একবার সারা বিশ্বকে জানান দেয়৷ দেশটির নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, এই শক্তি আর উৎসবকে অবাধ আর প্রতিযোগিতামূলক করতে কল্পনার চেয়ে বেশি ভূমিকা গণমাধ্যমকে রাখতে হয়৷ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র আর নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে গণমাধ্যমের সম্পর্ক হলো গাড়ির সাথে তেলের মতো৷ গণতন্ত্র যদি একটি গাড়ি হয় তাহলে সরকার হলো ইঞ্জিন আর দেশের জনগণ হলো গাড়ির মালিক৷ তেলের মান ভাল না হলে ইঞ্জিনে বাতিক ধরতে সময় লাগে না৷ বাংলাদেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রে নির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্রীয় নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণার ব্যবস্থা নেই৷ অ্যামেরিকায় গণমাধ্যমের উদ্যোগে তৈরি হয় ‘ডিসিশন ডেস্ক’ যেখান থেকে ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হয়৷ গণমাধ্যমের ওপর আস্থাশীলতা আর বছরের পর বছর সে আস্থার প্রতিদান দেয়ার কারণেই দেশটিতে এমন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে৷ এই একটি ইস্যুতে এসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত৷

অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে, প্রত্যাশা পূরণ হয়৷ এই প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে গণমাধ্যমই ভোটারদের তথ্যের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে৷ গণমাধ্যম শুধু নির্বাচনের নানা বিষয়ই তুলে ধরে না, বরং নির্বাচনে দুর্নীতি, অনিয়ম রোধ করার পাশাপাশি যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে জনগণকে সজাগ করে৷ ভোটার তথা জনগণ, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল, নির্বাচকমন্ডলী ও নির্বাচনি মাঠের স্টেকহোল্ডারদের চোখ-কান হিসেবে ভূমিকা পালন করে গণমাধ্যম৷

Bdnews-Deutsche Welle Talkshow
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: bdnews24.com

চলতি বছরের মার্কিন নির্বাচনে আমরা দেখলাম ডনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলার অভিযোগ এনে দেশটির প্রধান সারির সংবাদমাধ্যমগুলো তার বক্তব্যের সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়৷ সিএনএনসহ বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলো শিরোনাম করেছে ট্রাম্প ‘সবচেয়ে বড় অসৎ বক্তব্য’ দিয়েছেন৷ এমনকি ট্রাম্পের পক্ষের ফক্স নিউজও তার সমালোচনা করতে ছাড়েনি৷ অবশ্য ট্রাম্পকে বর্জনের ঘটনা এটিই প্রথম নয়৷ কংগ্রেস নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে গত ৩০ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি বিদেশিদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব লাভের সুবিধা বাতিল করবেন, যা ছিল অভিবাসনবিরোধী ভোটের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক অঙ্গীকার৷ বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) প্রেসিডেন্টের বক্তব্য হিসেবে যথারীতি তা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে৷ কিন্তু আধা ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে তারা তা প্রত্যাহার করে নিয়ে বার্তা সংস্থাটি টুইটে ঘোষণা করল প্রেসিডেন্টের এই দাবি সঠিক নয় বলে তারা সংবাদটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের যে অধিকার দেওয়া আছে, তা বাতিলের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের নেই৷

২০১৬ সালের নির্বাচনের সময়ও আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলোর নিজস্ব ও স্পষ্ট অবস্থান দেখেছি৷ এরিজোনা অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত দৈনিক দ্য এরিজোনা রিপাবলিক ১১৫ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল৷ পত্রিকাটি শুরু থেকে ২০১২ সালের নির্বাচন পর্যন্ত রিপাবলিকান দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালায়৷ কিন্তু ২০১৬ সালের নির্বাচনে তারা রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন না দিয়ে হিলারিকে সমর্থন দিয়েছিল৷ পত্রিকাটি জানিয়ে দিয়েছিল, ডনাল্ড ট্রাম্প অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার উপযুক্ত নন৷ একটি সংবাদ মাধ্যম কতটা স্বাধীন হলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সহজেই অনুমেয়৷ 

সংবাদমাধ্যমের এই আচরণ হঠাৎ করে জন্ম নেয় না৷ বিষয়টি এমন না যে, মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো নির্বাচন আসলেই অতিমাত্রায় স্বাধীন ও জনমুখী হয়ে যায়৷ গণমাধ্যম নির্বস্তুক কোন সত্তা নয়৷ দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে গণমাধ্যম পরিচালিত হয়৷ বিশ্বে এমন কোন গণমাধ্যম ব্যবস্থা নেই যেটি সে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিপরীতে নিজস্ব সিস্টেম বা ব্যবস্থা তৈরি করতে পেরেছে৷ নির্বাচনী সংবাদ বা নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমের পরিবেশনা তাই দেশ ভেদে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন হয়৷

বাংলাদেশের মতো অনেক দেশ আছে যেগুলো সাংবিধানিকভাবে বা কাগজে-কলমে গণতান্ত্রিক হলেও বাস্তবে পূর্ণমাত্রায় গণতন্ত্র কখনই ভোগ করেনি বা নানা কারণে করতে পারেনি৷ এসব দেশে একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্র – দু'ধরনের সরকার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো আংশিকভাবে কাজ করে৷ এসব দেশকে এখন বলা হচ্ছে হাইব্রিড রেজিম বা শঙ্কর-শাসিতব্যবস্থার দেশ৷ ইকোনকিম ইনটেলিজেন্স ইউনিট এসব দেশের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে৷ দেশগুলোতে নির্বাচনে যথেষ্ট অনিয়ম ও কারচুপি হয়, সরকার- বিরোধী দল ও মতকে প্রচণ্ড চাপে রাখে, দুর্নীতির ব্যাপকতা ও আইনের শাসনের দুর্বলতা স্পষ্টত প্রতীয়মান, দুর্বল সুশীল সমাজ, বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন নয় এবং সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়৷ এসব দেশগুলোতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈধতা লাভের হাতিয়ার হিসেবে নির্বাচনকে দেখা হয়৷ দেশগুলোতে গণমাধ্যম বা সংবামাধ্যমগুলো ততটুকুই স্বাধীনতা ভোগ করে যতটুকু সরকার দেয়ার ইচ্ছে পোষণ করে৷

নির্বাচনি সংবাদ কাভারেজের ধরণ ও আধেয় এবং জাতীয় নির্বাচনে সংবাদমাধ্যমগুলোর আচরণ সামষ্টিক পর্যায়ের চারটি চলকের ওপর নির্ভর করে –রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি, গণমাধ্যম সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান, গণমাধ্যমের মালিকানা কাঠামো এবং রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতার সংস্কৃতি৷ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সহজে অনুমেয় বৈশিষ্ট্যগুলো হলো- উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নেতৃত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠা দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যকার নিয়ত সহিংসতা, ‘ফার্স্ট পাষ্ট দ্য পোষ্ট' বা ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারণের নির্বাচনে বিজয়ীর সব কিছু ভোগের মানসিকতা এবং যে কোন মূল্যে নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের মত করে গড়ে তোলা৷ নব্বইয়ের পর থেকে গণতন্ত্রের সূর্য নতুন করে দেখা দেয়ার পর মনে হয়েছিল বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে৷ কিন্তু গত ৩০ বছরে গণমাধ্যমব্যবস্থার যে ধারণা বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছে সেটি বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যাবে না৷ দেশটিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে গণমাধ্যমের সংখ্যাকেই বোঝানো হয়েছে৷ কোন সরকার কত টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিলো, কত আন্ডারগ্রাউন্ড প্রেসের প্রসার ঘটালো তা দিয়েই দেশটির গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার সংস্কৃতির বিচার করা হয়৷ কিন্তু যে হারে গণমাধ্যমের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিকাশ ঘটেছে সে অনুপাতে বাড়েনি আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা৷  ফলশ্রুতিতে এখন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের 'সেন্স অব আইডেনটিটি’র নির্ধারক হচ্ছে ‘কোন সাংবাদিক কোন দলের কত বড় সমর্থক’৷

গণমাধ্যম কর্মীদের রাজনৈতিক বাতিকের কারণে সরকারি বা বেসরকারি, কিংবা গোষ্ঠীগত চাপ, কিংবা হুমকি, কোনো ক্ষেত্রেই কোনো ভূমিকা নিতে পারছে না সাংবাদিকরা৷ বাংলাদেশে দু-একটি পত্রিকা ছাড়া সে অর্থে কখনই ইউরোপের দেশগুলোর মতো ‘পার্টি প্রেস’ বা দলীয় সংবাদপত্র তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি৷ কিন্তু ‘কর্পোরেট ও রাজনীতির বন্ধন' (কর্পোরেট-কাম-পলিটিশিয়ান ক্লায়েনটিলিজম) বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের জন্য স্বাধীনভাবে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে৷ বাংলাদেশে এখন এমন কোন টিভি চ্যানেল নেই যেটির লাইসেন্স রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয়নি৷ সংবাদপত্রগুলো সরকারি বিজ্ঞাপন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ভর্তুকি কি পরিমাণ পাবে তার নির্ধারক হচ্ছে দলীয় আনুগত্য৷ গণমাধ্যমের রাজনীতিকরণের কারণে অনেক বড় ঘটনায় এখন আর গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত হয় না৷ ২০০১ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও পরাজিত পক্ষের ওপর যে আক্রমণ হয় তার খবর গণমাধ্যমগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়৷ স্বাধীনতার পর থেকে ৫০টিরও বেশি গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালা করা হয়েছে৷ এগুলোর সারসংক্ষেপ হলো তথ্য অধিকার আইন এবং ডিজিটাল আইনের মত পুরোপুরি বিপরীতধর্মী আইনের সহাবস্থান৷ উপরন্তু ‘সেলফ সেন্সরশিপ' নামক এক অবধারণগত অসঙ্গতি গণমাধ্যমের ভেতর রাজনৈতিক রোগকে মহামারী আকারে ছড়িয়ে দিচ্ছে৷  

বিশ্বব্যাপী নির্বাচনে গণমাধ্যমের ‍আচরণ, ‍ভূমিকা ও প্রভাব নিয়ে যেসব গবেষণা হচ্ছে সেগুলোকে মোটামুটি দুটো ভাগে ভাগ করা যায়৷ এক: রাজনীতির গণমাধ্যমীকরণ (মিডিয়াটাইজেশন অব পলিটিক্স) এবং দুই: গণমাধ্যমের রাজনীতিকরণ(পলিটাইজেশন অব মিডিয়া)৷ এই দুটি ধারণার মূল বিষয়বস্তু হলো, গণমাধ্যম ও রাজনীতি দুটি ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হলেও একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত৷ গণমাধ্যম তার কিছু নীতি দ্বারা পরিচালিত হয় যেগুলোকে গণমাধ্যম শাস্ত্রের ভাষ্য অনুযায়ী ‘মিডিয়া লজিক’ বলে৷ অন্যদিকে রাজনীতিও তার নিজস্ব কিছু নীতি দ্বারা পরিচালিত হয় যেগুলোকে বলা হয় ‘পলিটিক্যাল লজিক’৷ যখন মিডিয়া লজিক রাজনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে তখন তাকে গণমাধ্যমের রাজনীতিকরণ বলে আর পলিটিক্যাল লজিক গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তার করলে তাকে বলে গণমাধ্যমের রাজনীতিকরণ৷ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে মিডিয়া লজিক এতটাই শক্তিশালী হয় যে রাজনীতিবিদরা গণমাধ্যমের নীতির সাথে নিজেদের খাপ-খাওয়াতে বাধ্য হয়৷ মিডিয়া লজিক সমাজে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করার অর্থ হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গই কেবল নয়, এটিই গণতন্ত্র৷ অন্যদিকে একনায়ক কিংবা হাইব্রিড রেজিমের দেশগুলোতে রাজনীতির নীতি দ্বারা গণমাধ্যম শাসিত হয়৷ এখানে রাজনীতিবিদরাই শেষ কথা, গণমাধ্যম তাদের স্বপ্নপূরণের উপায় মাত্র৷ 

নির্বাচন মানেই গণজোয়ার, ভোটযুদ্ধ, জয় পরাজয়ের খেলা৷ নির্বাচনের সময় গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের কাছে সাধারণ মানুষের কিছু স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে৷ তারা আশা করেন বস্তুনিষ্ঠতা, পক্ষপাতমুক্ত খবর এবং ভারসাম্যপূর্ণ বিচার-বিশ্লেষণ৷ হাইব্রিড দেশগুলোতে এ প্রত্যাশা বহু দূরের আলোকবর্তিকা৷