1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গের অনেক মাদ্রাসায় মেয়েরাও খেলে নিঃসঙ্কোচে

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

খেলাধুলা হয়, সংস্কৃতি চর্চাও হয়৷ পশ্চিমবঙ্গের হাই মাদ্রাসায় কোনো কিছুতেই কোনো নিষেধ নেই৷ তবে খারিজি মাদ্রাসা এসব বিষয়ে বেশ রক্ষণশীল৷

https://p.dw.com/p/3ifr4
পশ্চিমবঙ্গের ডিসকাস থ্রো চ্যাম্পিয়ন রেশমা খাতুনকে (বামে) তার মাদ্রাসা শিক্ষকই খেলায় নিয়ে এসেছিলেনছবি: privat

‘‘ডিসকাস তো হাফপ্যান্ট পরেই ছুড়তে হয়৷ তাতে কে কী বলল, আমার কিচ্ছু যায় আসে না,’’ বললেন রাজ্যস্তরের ডিসকাস থ্রো চ্যাম্পিয়ন রেশমা খাতুন৷ দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী৷ বর্ধমানের একটি হাই মাদ্রাসায় পড়েন৷ তার মাদ্রাসা শিক্ষকই রেশমাকে অ্যাথলেটিক্সে নিয়ে এসেছেন৷ খুব গর্বের সঙ্গে একজন অ্যাথলিট হিসেবে নিজের পরিচয় দেন রেশমা৷ তার পরিবারও উৎসাহ দেয়৷ তবে গ্রামে কেউ কেউ রেশমার পোশাক নিয়ে কটাক্ষ করেছেন৷ রেশমার বক্তব্য, ‘‘সে সব আমি পাত্তাও দিই না৷ পেশাদার অ্যাথলিট হয়ে উঠতে চাই৷’’ তবে রেশমার শিক্ষক এখন চিন্তিত৷ এরপর রেশমার জন্য আরো ভালো কোচ দরকার, তারই খোঁজ করছেন তিনি৷

Indien Diskuswerfer Reshma Khathun
রেশমাকে মেডেল পরানো হচ্ছেছবি: privat

কেসিকে হাই মাদ্রাসার খেলাধুলার শিক্ষক তুহিন আলি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনিও শোনাচ্ছিলেন তার ছাত্র-ছাত্রীদের কথা৷ ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক্সে এখন রাজ্য কাঁপাচ্ছেন তার ছাত্র-ছাত্রীরা৷ তুহিনের বক্তব্য, খেলাধুলা না করলে ছেলে-মেয়েদের সম্পূর্ণ বিকাশ হয় না৷ ফলে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা অত্যন্ত জরুরি৷ তাদের মাদ্রাসায় সবরকম খেলার ব্যবস্থা আছে৷ এবং খেলার সময় পোশাক নিয়েও বাড়াবাড়ি করা হয় না৷ তার কথায়, ‘‘ছেলেরা তো বটেই, প্রয়োজনে মেয়েরাও হাফ প্যান্ট টিশার্ট পরে খেলায় অংশ নেন৷’’

সমস্যা হয় না? প্রশ্ন শুনে হেসে ফে৷ ‘‘কোথাও কোনো সমস্যা নেই, এমন বলছি না৷ শুনেছি, কোথাও কোথাও বাধা আসে৷ তবে আমরা বর্ধমানের মানুষ৷ আমাদের অঞ্চলে সমাজ অত রক্ষণশীল নয়৷ ছেলে-মেয়েরা আনন্দ করে খেলাধুলা, গানবাজনায় অংশ নেয়৷’’

ভারতের সব রাজ্যে মাদ্রাসার ধরন এক রকম নয়৷ বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গে হাই মাদ্রাসা বোর্ড তৈরি হয়েছিল৷ ঠিক যেভাবে মূলস্রোতের মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক বোর্ড আছে, তেমনই রয়েছে মাদ্রাসা বোর্ড৷ সাধারণ বোর্ডে যে পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয়, মাদ্রাসা বোর্ডেও সেই পাঠ্যক্রমই পড়ানো হয়৷ সরকারি মাদ্রাসাগুলিতে অতিরিক্ত আরবি ভাষার পঠনপাঠন হয়৷ সংস্কৃতি চর্চা এবং খেলাধুলোর জন্য আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা রয়েছে এই মাদ্রাসাগুলিতে৷ এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের মাদ্রাসার সংখ্যা ৬১৪টি৷ মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় এই মাদ্রাসাগুলিকে৷ হাই মাদ্রাসা, উচ্চমাধ্যমিক হাই মাদ্রাসা, অর্থাৎ, যেখানে একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় এবং সিনিয়র মাদ্রাসা, যেখানে সাধারণ পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি ধর্মশিক্ষারও ব্যবস্থা থাকে৷ এই প্রতিটি মাদ্রাসাই সরকারের তৈরি বা সরকারি অনুদানে চলে৷ এ ছাড়াও রয়েছে আন-এইডেড হাই মাদ্রাসা৷ এই মাদ্রাসাগুলি সরকারি অনুদান পায় না, কিন্তু সরকারি পাঠ্যক্রম মেনে ক্লাস নেয়৷ আর এর বাইরে রয়েছে খারিজি বা মক্তব বা নিজামিয়া মাদ্রাসা৷ এর সংখ্যা কারো জানা নেই৷ মূলত ধর্মশিক্ষা হয় এই ধরনের মাদ্রাসায়৷

সরকারি এবং সরকারের সাহায্যপ্রাপ্ত মাদ্রাসাগুলি থেকে প্রতি বছর মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পাস করে প্রায় সাত-আট লাখ ছাত্র-ছাত্রী, যার মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ৬০ শতাংশ৷ প্রায় ২০ শতাংশ অমুসলিম ছাত্র৷ এই ২০ শতাংশ অমুসলিম ছাত্রের অধিকাংশই হিন্দু৷ তারা এখানে পড়তে আসেন পড়াশোনার মানের জন্য৷ মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষকদেরও শতকরা ১৭ ভাগ অমুসলিম৷ ফলে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি এবং সরকার পরিচালিত মাদ্রাসাগুলির মধ্যে এক ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি প্রচলিত আছে, এ কথা বলাই যায়৷ এখানকার ছাত্রছাত্রীরা ভবিষ্যতে উচ্চপদস্থ চাকরি করেন, শিক্ষকতা করেন৷ খেলাধুলা এবং সংস্কৃতি জগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে৷

Bengalen Madrasa Studenten
পশ্চিমবঙ্গের একটি মাদ্রাসাছবি: DW/P. Samanta

তেমনই এক ছাত্রী শাহানাজ খাতুন৷ দশম শ্রেণির এই ছাত্রী পারাজ হাই মাদ্রাসার ছাত্রী৷ রাজ্য স্তরে দাবা খেলে এর মধ্যেই সংবাদ শিরোনামে এসেছেন৷ শাহানাজের বাবার কথায়, ‘‘মেয়ে দাবা খেলে, এ তো আনন্দের কথা৷ আপত্তি করবো কেন? শুধু আমরা নই, প্রতিবেশীরাও ওকে উৎসাহিত করেন৷ আর ও খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পেরেছে ওর মাদ্রাসা শিক্ষকদের জন্য৷ সমস্ত প্রশিক্ষণ তাঁরাই দেন৷’’

ইসরারুল হক মন্ডল মাদ্রাসার শিক্ষক৷ দীর্ঘদিন ধরে মাদ্রাসা আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলছিলেন, ‘‘সমস্যা হলো খারিজি মাদ্রাসা নিয়ে৷ ওই ধরনের কোনো কোনো মাদ্রাসায় রক্ষণশীল শিক্ষা দেওয়া হয়৷ খেলাধুলা, গান-বাজনা কিচ্ছু করতে দেওয়া হয় না৷ কেবলই ধর্মশিক্ষা হয়৷’’ বস্তুত এই খারিজি মাদ্রাসাগুলি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা বিতর্ক হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে৷ এর সংখ্যা কত, তা নিয়েও দ্বন্দ্ব আছে৷ কারো মতে প্রায় দশ হাজার, কারো মতে সংখ্যাটা তার চেয়েও বেশি৷ ওই সমস্ত মাদ্রাসায় শিক্ষা পেয়ে মূলস্রোতের কাজকর্মে যোগ দেওয়া যায় না৷

Syamantak Ghosh
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে বাংলাছবি: privat

দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ নিয়ে গবেষণা করছেন সাংবাদিক মিলন দত্ত৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, এ ধরনের মাদ্রাসার সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে৷ পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় এ ধরনের মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে৷ রক্ষণশীল চিন্তাভাবনার পাঠ দেওয়ার চেষ্টা করে এ ধরনের মাদ্রাসাগুলি৷ কিন্তু এর বিপরীত স্রোতও আছে৷

ডয়চে ভেলে যোগাযোগ করেছিল মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামের নারী নাসরিন তানজিমার সঙ্গে৷ নাসরিনের গ্রামে দুইটি স্কুল আছে৷ একটি খারিজি মাদ্রাসা, অন্যটি আরএসএস পরিচালিত সরস্বতী বিদ্যামন্দির৷ নাসরিন নিজের সন্তানকে ওই দুই স্কুলের কোনোটিতেই পাঠাতে চাননি৷ নিজেই তৈরি করেছেন একটি স্কুল৷ গ্রামের অধিকাংশ শিশু এখন সেই স্কুলে আসে, খেলাধুলা গানবাজনা সবই হয় সেখানে৷ কোনো কোনো পরিবার এসব নিয়ে প্রথম দিকে আপত্তি তুলেছিল৷ কিন্তু নাসরিন তাদের বুঝিয়েছেন৷ এখন আর কোনো সমস্যা নেই বলেই নাসরিনের দাবি৷

ইসরারুলের একটি চমৎকার কথা উপসংহার হিসেবে ব্যবহার করা যাক৷ ‘‘পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ আসলে দুই ভাগে ভেঙে আছে বলা যায়৷ একদিকে প্রগতিশীল মানুষ, অন্যদিকে রক্ষণশীল৷ এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই৷ আমাদের কাজ হলো, মানুষকে প্রগতির দিকে নিয়ে যাওয়া৷ আমরা সফল, কারণ, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতী৷ সংস্কৃতি, খেলাধুলো সর্বত্র৷’’ ইসরারুলের শেষ কথা৷ যারা ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলা করতে দেন না, সংস্কৃতি চর্চা করতে দেন না, তারা আসলে 'কুয়োর ব্যাঙ’৷